Skip to content

৭ই মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | মঙ্গলবার | ২৪শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিমলা

বিমলার আগের সেই শরীর নষ্ট  হয়ে গেছে; যত্নের অভাবে তার গায়ের মধ্যে ময়লাও পড়ে আছে। অধীর রোজ দোকানে যাবার সময় বিমলার দিকে একনজর তাকায় কেবল, কিন্তু আগের সেই মায়াটা আর চোখে নেই তার। অধীরের মেয়ে লিপি মুলতঃ বিমলাকে খুব ভালোবাসে তাই অধীর তাকে ছাড়তে পারেনা। লিপি ক্লাস সেভেনে পড়ে।লেখাপড়ায় বেশ ভালো, গ্রামেরই স্কুলের ছাত্রী সে। অধীর  অনেক আগেই চেয়েছিল বিমলাকে বিক্রি করে দিতে। লিপির অধিক পীড়াপীড়ি সে যাত্রায় থেকে যায় বিমলা। অধীরের স্ত্রী সীমারও  মেয়ের ভালোবাসার প্রতি খানিকটা সমর্থন আছে কিন্তু স্বামীর মতামতের বাইরে স্পষ্ট করে কিছু বলতে চায়না।

 

বিমলা অধীরদের বাড়ির অনেক পুরনো গাভী। তার কয়েকটা বাচ্চা বেশ বড় হয়ে গেছে। মাস ছয় হয় সর্বশেষ বাচ্চা দিয়েছে সে। আগের মতো আর দুধ দিতে পারেনা। বয়সের সাথে সাথে দানের পরিমাণও কমে যায় কারণ শরীরটাই আর নিজের থাকেনা। এমনই এক প্রস্থানের কিনারায় দাঁড়িয়ে বিমলা কেবল চেয়ে থাকে তার আদরের মনিবের দিকে। নির্ভরশীলতা এমনই এক অসহায়ত্ব যা অন্যের করুণার দিকে চেয়ে বেঁচে থাকতে হয়। খানিকটা পরে লিপি বিমলাকে খাবার দিতে আসে। বিমলা মনের আনন্দে খেতে থাকে। লিপি  বিমলার শরীরে হাত বুলিয়ে দেয়। হঠাৎ লিপি লক্ষ্য করে বিমলার চোখ গড়িয়ে জল পড়ছে। লিপির মনে খুব ব্যথা লাগে। মনে মনে বলতে থাকে কেঁদোনা, আমিতো আছি। একসময় বিমলার কতো যত্ন করতো অধীর। প্রতিদিন নদীতে নিয়ে যেতো স্নান করানোর জন্য, সময় সময় ঘাস এনে দিতো মাঠ হতে। আজ আর তেমন যত্ন হয়না বিমলার। যে ভালোবাসা প্রয়োজনের খাতিরে তৈরি হয়, প্রয়োজন সংকীর্ণ হয়ে আসলে ভালোবাসাটাও আর থাকেনা। পশু এবং মানুষ সবাই যেন এই নিয়মকে এড়িয়ে চলতে পারেনা। লিপি সেই ছোটো সময় থেকেই বিমলার খুব কাছের হয়ে আছে। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার আগে ও ফেরার পর বিমলার কাছে আসে। লিপি কাছে আসলেই বিমলা মুখ দিয়ে লিপির হাত স্পর্শ করে তার আবেগকে প্রকাশ করে। না পাওয়ার মাঝে যখন ছোটোখাটো কিছু আসে তখন হৃদয়ের দুকূল উপচানো আনন্দ চোখের জলে গড়িয়ে পড়ে।  এই বোধহীন প্রাণীটিও লিপির আদরের ছোঁয়ায় ভেতরের আনন্দ চোখ – মুখ দিয়ে বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ করে।

 

বিকেল হলে লিপি প্রতিদিন বিমলাকে আনতে মাঠে যায়। কোনোদিন আসতে দেরি হলে তার মা সীমা এগিয়ে যায় তাদের নিয়ে আসতে। সীমা প্রায়ই মেয়ের এমন গাভী প্রেম পাড়ার অন্যদের সাথেও কম বেশি আলোচনা করে। যার ফলে গ্রামের সবাই লিপিকে দেখলেই প্রথমে গাভীর কথা জিজ্ঞেস করে। খোয়াই নদীর তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ছোট এই গ্রাম, রাধাপুর নামেই সমধিক পরিচিত। লাউয়ের ডগার মতো সরু এই নদী কতো জীবন্ত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজো বেঁচে আছে। অনাবিল এই সবুজের মাঝেই লিপিবদ্ধ হয় লিপির শৈশবের কথা আর বিমলার চোখের মায়ায় আটকে থাকা সন্ধ্যা বেলার ঝিঙে ফুলের অসমাপ্ত আত্মজীবনী। 

 

বিমলার প্রতি কিছুটা অবহলা লিপি বুঝতে পারে। মাকে প্রায়ই সে কথাটা বলে। সীমা অবোধ প্রাণীর এই অবহেলাকে তেমন কিছু মনে না করে লিপির কথার এতোটা গুরুত্ব দেয়না। লিপি কেবল বিমলার কথা ভাবে। তাকে আরো একটু সেবা দেওয়ার ফন্দি আঁটে মনে মনে। অধীর দোকান থেকে এসে দু-এক দিন গাভীটি বিক্রি করার কথা সীমার সাথে আলোচনাও করেছে ইতোমধ্যে। লিপি সে কথাগুলো শুনে মনের ভেতর খুব কষ্ট পেয়েছে। বাবাকে কিছু না বললেও মায়ের নিকট তদবির করতে ছাড়েনি সে। গাভীটি বিক্রির পেছনে যে যুক্তি অধীর দেখায় তা একেবারে ফেলে দেবার নয়। মা রে এই গাভীটি বিক্রি করে আরো একটি সুন্দর নতুন গাভী আনবো। তুই তখন একে আরো যত্ন করতে পারবে, বলেই অধীর মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। লিপি কোন উত্তর দেয়না। পাশে দাঁড়িয়ে সীমা বাপ-মেয়ের এমন মান-অভিমানের চিত্র দেখে।  সীমা গাভীর প্রতি লিপির ভালোবাসার কথা ভেবে মনে মনে বলে, কিছু ভালোবাসা এমনিতেই বোধহয়  উঁকি দেয় যার কোনো কুলও থাকেনা জলও থাকেনা কেবল একটা ঢেউ শূন্যতার উঠোনে আশ্রয় নেয়।

 

আজ ক'দিন যাবত লিপি বেশ অসুস্থ, শরীরে প্রচুর জ্বর। শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে তাকে।  পাড়ার রহিম, কুবের এরই মাঝে অধীরকে গাভীটি বিক্রির জন্য বলেছিল। অধীর পরে জানাবে বলে বলেছিল তাদের।  হাসপাতালে যাবার পথে অধীরের সাথে তাদের দেখা হতেই আবার কথাটা জিজ্ঞেস করে ; অধীর মেয়ের এমন অসুখের সময় এ কথাটা আর তুলতে চায়না।  তাদের কথার উত্তর পরে দিবে বলে জানিয়ে দেয়। হাসপাতালে লিপিকে ভর্তি করা হল; রোগের সঙ্গে লড়ছে লিপি। মনের মাঝে বিমলার আনাগোনা কিন্তু রয়েই যায়, বাবার কাছে সাহস করে বলতেও পারছেনা কিছু। মা হলে অনায়াসে বলতে পারতো তা। একটা সময় এসে মেয়েরা মায়ের কাছে সব খুলে বলতে সাহস পায়, যদিও মেয়েরা বাবাদের বেশি ভালোবাসে। তবু কঠিনের প্রলেপ মেশানো বাবার বাহ্যিক অবয়ব যেন মেয়ের নিকট একটা আদর্শ পিতার প্রতিচ্ছবি,  এটাকে শুশ্রূষা করেই ভেতরের মায়াটুকুকে বেঁধে রাখে আজীবন।

 

অধীর কাছে আসলে লিপি তাকে বিমলার কথা জিজ্ঞেস করে। অধীরের মা গাভীটির নাম বিমলা রেখেছিলো। সেই থেকে সবাই তাকে বিমলা বলেই ডাকে। তিনি গত হয়েছেন প্রায় বছর দেড়েক আগে। অধীরের মা-ও গাভীটিকে খুব ভালোবাসতেন। তারই উত্তরসূরি হিসেবে লিপির মধ্যে তার ছোঁয়া লেগেছে।
বিমলা ভালো আছে, বলেই অধীর চলে যায়। লিপি কেবল বিমলার কথা ভাবতে থাকে আর মনে মনে বলে যদি মাকে একটু জিজ্ঞেস করা যেতো !  কিছু পরে ডাক্তার আসে, সাথে অধীরও আসে। ডাক্তার লিপিকে দেখে সব ঠিক আছে বলে তাদের হাসপাতাল ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নেবার কথা বলে চলে যায়। মুক্তির আনন্দ লিপিকে যতোটা না নাড়া দিয়েছে তার চেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছে সে যে তার প্রাণের বিমলাকে গিয়ে একনজর দেখবে। মনে মনে কতো পরিকল্পনা সে এঁকে বসে আছে!

তার যেন আর দেরি সইছে না। কখন যেন হাসপাতাল ছেড়ে চলে যায় তার ক্ষণ গুনছে। কিছু পর অধীর লিপিকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বাড়ি রওয়ানা দেয়। হাসপাতাল বাড়ি থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে। গাড়ি চলতে থাকে  আপন গতিপথ ধরে। লিপির মনে ছলছল করতে থাকে উচ্ছ্বাসের বন্যা। বাড়িতে মায়ের সাথে ক'দিনের বন্দী জীবনের গল্প করবে সে সাথে বিমলার জন্য মনটা যে কি করছিলো তার আদ্যোপান্ত মাকে সে বলবে। এতো ভাবনার মাঝে একটি প্রশ্ন উঁকি দেয় লিপির মনে। আচ্ছা,  বিমলা কি আমার কথা একবারও মনে করেছে? কাকে বলবে এই কথাটা লিপি ভেবে পায়না। সহপাঠী জয়া কিংবা সাগরিকার নিকট কথাটা বললে খুব লজ্জা পেতে হবে ভেবে ভাবনাটাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে চায়। তবে স্কুলের  আরিফ স্যারের কাছে কথাটা বললে মন্দ হবেনা,  আরিফ স্যার গণিতের শিক্ষক। লিপিকে অনেক আদর করে, ভালো ছাত্রী হিসেবে লিপির একটা অধিকারবোধ জন্ম নিয়েছে স্কুলে। ভাবনার স্রোত নদীর পানির মতো সাগরের দিকে বয়ে চলছে। গাড়ির গতি ক্রমেই কমতে শুরু করছে, গ্রামের অবয়ব জানালার ফাঁকে চুপি দেওয়ার কিছু সময়ের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠে গন্তব্য। 

 

গাড়ি এসে থামল যথাস্থানেই। লিপি গাড়ি থেকে নেমে দেখে তার মা দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েকে দেখে সীমা জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে। যেন কতোবছর মা-মেয়ের দেখা হয়না। লিপি মায়ের বাহুবন্ধন থেকে কোনোরকমে মুক্ত হয়ে সোজা চলে যায় বিমলার কাছে। কাছে গিয়েই থেমে যায় লিপি। বিমলার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। পিছনে পিছনে সীমাও আসে। সীমা তার মেয়েক বলে, জানিস, তুই যাবার দিন থেকে  সে কিছু খায়না। আমি খড় এনে দিয়েছি কিন্তু তা নাক দিয়ে শুঁকে আবার মুখ সরিয়ে নেয়। মায়ের মুখ থেকে কথাটা শুনে লিপির ভিতরটা যেন মোচড় দিয়ে উঠে।  মনে মনে হয়তো এই কথাটাই শুনতে চেয়েছিল সে হাসপাতালের বেডে শুয়ে। ভালো বাসতে বাসতে যখন মানুষ উজাড় হয়ে যায় তখন খানিকটা থমকে গিয়ে সে নিজের গুটিকয়েক প্রশ্নের উত্তর খোঁজে বেড়ায়। যদি  সেটা তার মনের মতো হয় তবেই তার ভালোবাসা পূর্ণতা পায়। সবাই চায় তার ভালোবাসা তার কাছে ঠিক একই গতি নিয়ে  ফিরে আসুক। মায়ের কথার কোন উত্তর না দিয়ে লিপি দৌড়ে গিয়ে বিমলার জন্য কিছু খড় এনে দেয়। বিমলা মনের আনন্দে খেতে থাকে। অবাক হয়ে দেখতে থাকে সীমা। মনে মনে বলে হয়তো সে ছিলোনা বলে অভিমানে বিমলা কিছু খায়নি। লিপি বিমলার শরীরে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে যেন কতদিন তাকে আদর করেনি সে। পশু আর মানুষের এই ভালোবাসা সীমাকে ভাবিয়ে তোলে। সীমা এতো বেশি শিক্ষিত নয়; একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে কিন্তু প্রতিটি আবেগের ব্যঞ্জনা সে বুঝতে পারে তার মনের গভীর থেকে। গাভীর প্রতি মেয়ের এই ভালোবাসার অর্থটাও বুঝে সীমা। এই ভালোবাসায় কোনো  আঘাতের ভয় নেই, প্রতারণার বিষয় নেই ; কেবল দানের তাৎপর্যে পরিপূর্ণ থাকে  দুটি হৃদয়।

 

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রাস্তায় নিয়ন বাতিগুলো উঁকি মারছে। সবুজ পাতায় আলোর সমাবেশ আঁধারের নগ্নতায় বর্ণ হারিয়ে নিরবতায় ডুবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। অধীর সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বিছানায় হেলান দিয়েছে মাত্র। সীমা রাতের খাবার তৈরির কাজে ব্যস্ত হয়ে আছে। ক্লান্তি এখনও দূর হয়নি লিপির তাই পড়ার টেবিলে যাওয়ার কোন আয়োজন করছেনা আজ। দরজা খোলা দেখে রহিম ও কুবের সরাসরি ঘরে চলে আসে। অধীর তাদের দেখে উঠে বসে এবং তাদের কুশলাদি জানতে চায়।
মেয়ের শরীর এখন কেমন আছে, অধীরদা? রহিম জানতে চায়।
এখন ভালোই আছে,  ভয় পেয়েছিলাম কারণ একটাই মেয়ে  তো ভাই, অধীর জবাবে বলে।

কুবের একবার' সত্যি 'শব্দটা উচ্চারণ করে অধীরের আবেগটাকে সমর্থন করে বলে, এখন সময়টা একবারেই খারাপ, অল্পতে যে আমাদের মা-মনির অসুখটা শেষ হয়েছে! 
কই গো সীমা, রহিম আর কুবের এসেছে ; তাদের একটু চা দেওয়ার ব্যবস্থা করো।
হ্যাঁ দিচ্ছি,  রান্নাঘর হতে সীমা জবাব দেওয়ার কিছু সময়ের মধ্যেই চা এসে হাজির হয়। চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে কুবের অধীরকে বলে, গাভীটা বিক্রির ব্যপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে দাদা?

অধীর হ্যাঁ সূচক জবাব দিয়ে তার দাম নির্ধারণ করতে বলে দু'জনকে। একবার অবশ্য সীমাকে ডাকতে চেয়েও থেমে যায় অধীর। পুরুষতান্ত্রিক ভাবটা এখনো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে বসে আছে সমাজব্যবস্থার ভাঁজে ভাঁজে। অনেক আলাপ আলোচনা শেষে গাভীটি বিশ হাজার টাকায় বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়। আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যেই টাকা পরিশোধ করে গাভীটি নিয়ে যাবে তারা এমনই সিদ্ধান্ত আসার পর ঘর হতে বের হয়ে যায় রহিম ও কুবের। তাদের বেরিয়ে যাবার পরই অধীর সীমাকে সব কথা বুঝিয়ে বলে। মেয়ে তখনও ঘুমাচ্ছিলো, শরীরটা অসুস্থ বলে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে সে। সীমার ভিতরে শক্ত একটা ধাক্কা লাগে মেয়ের কথা ভেবে। এতো বছরের পুরনো গাভীটাকে বিদায় দিতে হবে ভেবে সীমারও ভীষণ খারাপ লাগছে। 

 

সকালের সূর্য পূবের আকাশে যথাযথ সম্মান নিয়ে হাজির হয়েছে।  পাখির কলরবে ঘুম ভাঙতে শুরু করেছে গ্রামের মানুষদের। পল্লীবধূ কলসি নিয়ে স্নান সেরে ফিরছে বাড়ির দিকে। কার্তিক মাসের সকালে খানিকটা কুয়াশা পড়ে নতুন ঘাসের উপর। আকীর্ণ চর জেগে উঠা শুরু করেছে পানির বুক ভেদ করে। রাখাল গরু নিয়ে মাঠে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে আগের মতোই।  লিপি ঘুম থেকে উঠে।  শরীরটা বেশ হালকা লাগছে তার। তার মা সীমাও ঘুম থেকে উঠে সকালের সংসার ঘোচাতে ব্যস্ত। অধীর সকালেই চলে যায় দোকানে, গ্রামে সকালেই দোকান খোলার রেওয়াজ প্রচলিত। সকালের নাস্তা অধীর দোকানে করে নেয়। লিপি বিমলার কাছে গিয়ে তার খাবার দেয়। বিমলার মনে যেন এক প্রশান্তি বিরাজ করছে। ঘরে ফিরে লিপি মায়ের কাছে সকালের নাস্তার জন্য আবদার করে। রাত হতেই সীমার মনটা বেশ ক্লান্ত হয়ে আছে। কিভাবে সে মেয়েকে গাভীটি যে বিক্রি হয়ে গেছে তার কথা বলবে, ভেবে পাচ্ছেনা সীমা! অনেক আয়োজন করে শেষপর্যন্ত লিপিকে রাতের ঘটনার কথা বলে দেয় সীমা। লিপি কোনো উত্তর দেয়না কেবল পাথরের মতো বসে থাকে। গভীর বেদনার ভার সইতে না পেরে মানুষ অনেক সময় নিজের থেকে হারিয়ে ফেলে নিজেকে। কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পায়না নিজের মাঝে, লিপিও এমন হয়ে গেছে। ধীর গলায় মাকে শুধু একটা কথা বলে, বয়স হলে তোমাকেও যদি বিক্রি করে দেই মা! তোমার কেমন লাগবে?

অসীম পৃথিবীর সমস্ত আকাশটা যেন ভেঙে পড়েছে সীমার মাথায়। কিছু না বলে লিপি চলে যায় স্কুলে; বাবার সাথে তার তীব্র অভিমানে বুকটা ভেঙে টুকরো হয়ে যাচ্ছে।

 

লিপি স্কুলে গিয়ে তার বান্ধবী সাগরিকাকে পায়। কিরে লিপি, তোকে এমন লাগছে কেন? সাগরিকা জানতে চায়। লিপি কোনো উত্তর না দিয়ে আরিফ স্যার কোথায় আছে সাগরিকার নিকট জানতে চায় ! তারপর দুজনেই আরিফ স্যারের নিকট এসে দেখে আরিফ স্যার নিজের চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ছে। 

লিপি কেমন আছো? গত দু'দিন স্কুলে আসো নাই যে? শরীর সুস্থ আছে তো? আরিফ স্যারের এসব কথার কোনো উত্তর না দিয়ে স্যারকে একটু বাহিরে বের হতে বললে উনি বাহিরে আসেন। লিপি সব কথা খুলে বলে কেঁদে ফেলে। স্যার তাকে থামিয়ে দিয়ে শান্ত হতে বলেন এবং এর একটা ব্যবস্থা করবেন বলে লিপিকে আস্বস্ত করেন। কিছু ব্যক্তির কিছু শব্দ থাকে যেখানে নির্ভর করা যায়, আরিফ স্যারও লিপির নিকট তেমনি একজন। লিপি ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরে আসে। মন খুব খারাপ।  সীমা তাকে খাবার কথা বললেও সে খেতে চায়না। বিমলার দিকেও নজর নেই তার। কেবল এক যুদ্ধ জয়ের প্রস্তুতি নেবার আকাশসম কল্পনায় বিভোর হয়ে আছে সে। লিপি বিছানায় শুয়ে আছে দেখে সীমা লিপির মাথার কাছে এসে বসে হাত বুলাতেই ডুকরে কেঁদে ফেলে সে।

মা তুমি বিমলাকে বিক্রি করতে দিও না। আমি তোমার পায়ে পড়ছি মা। সীমা কোনো জবাব দিতে পারেনা। কেবল জানালার ফাঁক দিয়ে চেয়ে থাকে শূন্যের দিকে। ভিতরে বইতে থাকে সুনামির তাণ্ডব। বাড়ির পুরুষদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কথা বলার সাহস অতীতে কেউ দেখায়নি। এ রীতি ভাঙবে কি দিয়ে লিপি ও তার মা!  বাহিরে আমগাছের পাতা ঝরার দৃশ্য দেখতে দেখতে গতকালের মেয়ের কথাটা মনে আসে সীমার। মেয়েকে বিছানায় রেখে বাহিরে বের হয় সীমা। প্রকৃতির মাঝেও ছেড়ে দেবার দৃশ্য দেখতে দেখতে সীমা ভাবে জীব জগতের সকল কিছুই  জীর্ণ সব ফেলে দিয়ে নতুনকে স্বাগত জানায়। এ শিক্ষা চারপাশের পরিবেশ ও আমাদের দৈনন্দিন কাজের থেকে সন্তানরা শিখছে। এজন্য তারাও তো আমাদের সাথে করছে অথচ আমরা তার বেদনা সইতে পারিনা, দোষ দিচ্ছি কেবল তাদের। আমাদের শিক্ষাই তারা বহন করে চলছে জীবনভর। ভাবতে ভাবতে সীমার মনেও লিপির আবদারের ঢেউ লাগে। সীমাও চায় বিমলা বিক্রি না হোক কিন্তু কোনো উপায় খোঁজে পায়না।

 

আরিফ স্যার লিপির ব্যপারটা নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। উনি কিসের ভিত্তিতে অধীরকে এসে গাভীটি বিক্রি করতে না করবে তার কোনো যুক্তি খোঁজে পাচ্ছেনা। জগত সংসারে যে নিয়ম প্রচলিত আছে  তার তো কোনো ব্যতিক্রম ঘটাচ্ছে না অধীর। ভাবনার বুদবুদ আরিফ স্যারের মনে উঁকি দিয়ে আবার মিশে যাচ্ছে। এদিকে লিপিকে দেওয়া কথাটা কিভাবে রক্ষা করবে আরিফ স্যার তার চিন্তায় ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছেন তিনি। ভাবনার মাঝেই ঘর হতে বেরিয়ে পড়েন তিনি।

 

সকাল নয়টা বাজতে কিছু বাকি। রহিম ও কুবের অধীরদের বাড়ি এসেই গাভীটিকে দেখতে যায়। ঘরেই বসা ছিল লিপি। তাদের দুজনকে দেখেই লিপি তাদের কাছে গিয়ে বিমলাকে না নেওয়ার জন্য আবদার করতে থাকে। আমি আপনার পায়ে পড়ছি কাকু আপনি বাবাকে বোঝান, বিমলাকে নিবেননা।  বলেই কুবেরের পায়ে ধরতে গেলে কুবের দুহাতে লিপিকে সামলে নিয়ে তাকে আরেকটি সুন্দর গাভী কিনে দিবে বলে সান্ত্বনা দিতে থাকে। লিপির অবুঝ মন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সে সমস্ত সংসার টাকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়।  মা ঘরে নেই; কোথায় যেন আছে? মনের মধ্যে ভেসে আসে আরিফ স্যারের কথা, কেউ কি পাশে নেই তার! কোনো উত্তর পায়না লিপি। অধীর দোকান থেকে বাড়িতে চলে আসে। এসেই কুবের ও রহিমকে গাভীটি বের করে নিয়ে যেতে বলে। লিপি ডুকরে কেঁদে কেঁদে মাকে খোঁজে।  হঠাৎ আরিফ স্যার সাথে পাড়ার একজন মাতব্বর সহ হাজির হয়। লিপির এদিকে কোনো নজর নেই। বাকরুদ্ধ কান্নায় লুটিয়ে পড়ছে মাটিতে।  সীমা গিয়েছিলো পাশের বাড়ির রনদা কাকুর বাড়িতে, তাকে সাথে নিয়ে এসে বাড়িতে দেখে এই অবস্থা।

 

অধীর হঠাৎ এতো গণ্যমান্য লোকের আগমনে হতবিহ্বল হয়ে যায়। কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। এমন সময় আরিফ স্যার ঘটনার আদ্যোপান্ত বলে শেষে একটি কথা বলে, আমাদেরও একদিন প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে অধীর বাবু। তখন কি হবে? আপনার যদি গাভীটি বিক্রি করতেই হয় আমি টাকা দিয়ে সেটি কিনবো এবং লিপিকে তা উপহার হিসেবে এখানে দিয়ে যাবো। অধীর কোনো উত্তর দিতে পারেনা কেবল অস্ফুট গলায় বলে, স্যার। মেয়ের মুখের প্রতিচ্ছবি অধীরের হৃদয়ের আঙিনায় ভেসে উঠে। কুবেরের মুখের দিকে চেয়ে তাকে চলে যেতে বলে অধীর। কঠিনের অবয়ব ভেঙে অধীরের হৃদয়ে আবেগের ফোঁটা চোখের এককোণে চলে আসে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে  তা আর সামলাতে পারছেনা যেন। দু'হাতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে  ডুকরে কেঁদে ফেলে অধীর। উঠোনো দাঁড়ানো সীমার দুই পা থরথর কাঁপছে,  সময়ের আস্তরণে বিমলার চোখে ক্ষয়ের আগমনী ধ্বনি ক্রমেই বিলীনের সুখ নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বিমলা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে জাবর কাটতে কাটতে চেয়ে আছে মানুষগুলোর সিদ্ধান্তের দিকে।

 

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ