ছেঁড়া স্যান্ডেল থেকে দেশের দ্রুততম মানবী
একসময় গ্রামের মাটির পথ ধরে দৌড়ানো সেই মেয়েটিই আজ বাংলাদেশের দ্রুততম মানবী হয়েছেন ১৬ বার। তিনি শিরিন আক্তার, এক অনন্য অধ্যবসায় ও সংগ্রামের নাম। শিরিনের সাফল্যের পথচলা সহজ ছিল না। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই, পরিবারের অনাগ্রহ, প্রতিকূলতার পাহাড় সব পেরিয়ে তিনি আজ দেশের গর্ব।
২০০৬ সালের এক দুপুর। স্কুল বন্ধ থাকলেও শিরিন জানতে চাইলেন সেদিন প্র্যাকটিস আছে কি না। কোচ আকবর আলী জানালেন প্র্যাকটিস না থাকলেও খেলা আছে। শিরিন দেরি না করে ছুটলেন। কিন্তু পথেই ছিঁড়ে গেল তাঁর স্যান্ডেল। বাড়ি ফেরার চিন্তা না করে সেটাকে বগলে নিয়েই পৌঁছে গেলেন স্টেডিয়ামে।
সেদিন মেয়েদের ট্রায়াল শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কোচের প্রশ্নে শিরিন রাজি হয়ে গেলেন ছেলেদের সঙ্গে দৌড়াতে। সবার মধ্যে সেরা হলেন তিনি। তখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, অ্যাথলেটিকস না জিমন্যাস্টিকস কোনটি বেছে নেবেন? শিরিন জানতেন না কী বলবেন। শুধু বললেন, “আমি দৌড় খেলতে চাই।”
সেখান থেকেই শুরু হলো তাঁর নতুন যাত্রা। তিনি সুযোগ পেলেন বিকেএসপিতে (বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান)। কিন্তু পরিবারের সায় পাওয়া সহজ ছিল না।
শিরিনের বাবা ছিলেন কৃষক। চার বোনের সংসারে মেয়েকে খেলাধুলায় পাঠানোর চিন্তা সহজ ছিল না। কিন্তু কোচ আকবর আলী এগিয়ে এলেন। তিনি বাড়িতে গিয়ে বুঝিয়ে বললেন, বিকেএসপি শিরিনের জীবনে বড় সুযোগ এনে দিতে পারে।
এরপর এলো সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। বিকেএসপি থেকে চিঠি এল শিরিনের নামে। গ্রামে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল কিন্তু মা-বাবার মন খারাপ। শিরিন কাঁদতে লাগলেন। কারণ তিনি জানতেন এটিই তাঁর স্বপ্নের পথে প্রথম ধাপ। অবশেষে ছোট মামা তাঁকে ভর্তি করিয়ে দিলেন বিকেএসপিতে।
ভর্তির কয়েক মাস পরের ঘটনা। এক প্রতিযোগিতায় সিনিয়রদের দৌড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু এক বড় আপু অসুস্থ হয়ে পড়লেন। শিরিনের কাছে জানতে চাওয়া হলো, তিনি ৪০০ মিটারে দৌড়াবেন কি না। দ্বিধা না করে রাজি হলেন তিনি।
নিজের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। এমনকি দৌড়ের পোশাকও সঙ্গে আনেননি। অন্য একজনের দেওয়া পোশাক পরে দৌড়ালেন। কিন্তু ৩০০ মিটার পার হতেই ক্লান্তিতে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। জ্ঞান ফেরার পর চারপাশে সবাই আনন্দে চিৎকার করছে “তুমি প্রথম হয়েছ!”
এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। বিকেএসপিতে ভালো রেজাল্ট করলে বেতন মওকুফ হয়। তাই শিরিন আরও মনোযোগ দিলেন খেলায়। এক বছর পর থেকেই তাঁর বেতন মওকুফ হলো। ২০০৭ থেকে ২০১২ পর্যন্ত তিনি দেশের দ্রুততম বালিকা ও কিশোরী ছিলেন।
২০১৪ সালে জাতীয় অ্যাথলেটিকসে ১০০ মিটারে স্বর্ণপদক জিতে শিরিন দেশের দ্রুততম মানবী হন। সেই বছরই বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে খেলোয়াড় হিসেবে যোগদানের সুযোগ পান।
শিরিন শুধু খেলোয়াড় নন পড়াশোনাতেও এগিয়ে গেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেছেন। এখন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পোর্টস সায়েন্সে মাস্টার্স করছেন।
২০২৪ সালে ১৬ তম বারের মতো দ্রুততম মানবীর খেতাব জিতেছেন শিরিন। কিন্তু প্রতিবার তাঁর অনুভূতি নতুনের মতো। প্রথমবারের মতোই রোমাঞ্চিত হন তিনি।
শিরিনের সাফল্য শুধু তাঁর নিজের নয় এটি দেশের প্রতিটি মেয়ের জন্য অনুপ্রেরণা। তিনি বলেন, “অনেকেই বলেন, মেয়ে হলে যেন শিরিনের মতো হয়। শুধু খেলোয়াড় হিসেবে নয় মানুষ হিসেবেও। এই কথাগুলো আমাকে অনুপ্রাণিত করে, শক্তি জোগায়।”
শিরিন আক্তার প্রমাণ করেছেন, ইচ্ছাশক্তি থাকলে যেকোনো প্রতিকূলতা জয় করা সম্ভব। ছেঁড়া স্যান্ডেল হাতে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা আজ দেশের দ্রুততম মানবীর গৌরবময় পরিচয়ে রূপ নিয়েছে।