Skip to content

৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শনিবার | ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘মাসিক’ এবং শিক্ষা’র উপহাস

২০১৮ তে মুক্তি পাওয়া বলিউড তারকা অক্ষয় কুমারের 'প্যাডম্যান' সিনেমা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। মেয়েদের স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং এ বিষয়ে আমাদের উপমহাদেশের মফস্বল সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টতই পরিলক্ষিত হয় এই সিনেমায়। প্রশংসা কুড়িয়েছেন বলিউড হিরো অক্ষয়, সিনেমার পরিচালক আর বালাকৃষনান এবং অন্যান্য কলাকুশলীরা। কিন্তু প্রশ্ন হল, সিনেমার সফলতার পাশাপাশি এই সচেতনতামূলক সিনেমা থেকে সমাজ নারীর স্বাস্থ্য সচেতনতা আর 'মাসিক' বা 'পিরিয়ড' নিয়ে কতটা সচেতন হল, কতটা শিক্ষা গ্রহণ করলো?

ঠিক এই প্রশ্নেই এই দেশের অধিকাংশ মানুষ ভ্রু কুঁচকাবে কিংবা মিটিমিটি হাসবে। আর এখানেই আমাদের শিক্ষা'র সবচাইতে বড় 'রঙ্গরস' লুকায়িত। আরেকটু বিশদে গিয়ে ব্যাখ্যা করি, নবম- দশম শ্রেণীর গার্হস্থ্য বিজ্ঞান বইয়ে মেয়েদের মাসিক ও এই সময়ের সচেতনতা বিষয়ক আলোচনা অন্তর্ভুক্ত করেছে, উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমান পর্যায়ের জীববিজ্ঞান সহ আরো কয়েকটি একাডেমিক বিষয়ের পাঠ্যসূচিতে 'মাসিক' বিষয়টি এখন অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে পড়াশোনা নাই।

'মাসিক' কিংবা 'পিরিয়ড' যে আমাদের দেশে এখনো শুধুমাত্র নাটক, সিনেমা আর টিভি কমার্শিয়ালের অংশ হিসেবেই গ্রহণযোগ্যতা পায়, যা বুঝতে আমাদের দেশের 'শিক্ষা' নামক এক 'ট্রাজেডি'কে বিশদভাবে পর্যালোচনা করলেই হয়তো সহজে অনুমেয় করা যায়।

প্রমথ চৌধুরি একটি প্রবন্ধে বলেছিলেন, "আমাদের শিক্ষিত সমাজ মোটের উপর বাধ্য না হলে বই স্পর্শ করেন না। ছেলেরা যে নোট পড়েন, এবং ছেলের বাপেরা যে নজির পড়েন, দুই-ই বাধ্য হয়ে, অর্থাৎ পেটের দায়ে।" লেখকের বক্তব্য একদম স্পষ্ট যে বইয়ের পড়া বিষয় আমাদের জীবনে কোনোরকম প্রভাব ফেলে না, যদি না তা দিয়ে টাকা উপার্জন করা যায়। কিন্তু, যে বিষয় পাঠের মাধ্যমে মানুষের মানবসত্তার বিকাশ হয় না, তা নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় এবং এটাই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সবচাইতে বড় 'ট্রাজেডি'।

বিগত কয়েক দশকের চেষ্টায় 'মাসিক' বা 'রজঃস্রাব' কিংবা মেয়েদের স্বাস্থ্যসচেতনতার অন্যান্য বিষয়সমূহকে একাডেমিক পড়াশোনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা শুধুমাত্র ওই সকল পাঠ্যপুস্তকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। এই শিক্ষা কখনো ক্লাসরুমে দেয়া হয় বা শিখানো হয়, এই উদাহরণ খুবই নগণ্য। যার জন্য শিক্ষার্থীদের কাছে এই বিষয়গুলো হয়ে দাঁড়িয়েছে আরো বেশি রসাত্মক, ফলশ্রুতিতে আমাদের সমাজের সত্যিকারের কর্ণধার, আমাদের অর্ধাঙ্গিনীরা এখনো নিদারুণ মানসিক দুর্ভোগের শিকার হয়।

হ্যাঁ, একবিংশ শতাব্দীতে সচেতনতা বেড়েছে, অনেক মেয়েরা এখন স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করছে, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য বিষয়ক ব্যাপারে নজর দিয়েছে তারা, তবু সামর্থ্য আর শিক্ষার বিস্তৃতির অভাবে বাংলাদেশে এখনো প্রতিবছর নতুন করে ৮ হাজার ২৬৮ জন নারী জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় (তথ্যসূত্র: ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার)। শুধু তাই নয়, সেই সচেতনতাও শুধুমাত্র মেয়েদের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ; ছেলেরা এই শিক্ষার ঊর্ধ্বে অবস্থান করে। আর এই জন্যই বলে আসছি৷ আমাদের শিক্ষাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা উপহাস।

 

আমাদের পাঠ্যক্রমে মেয়েদের 'মাসিক' ও সচেতনতা বিষয়ক সামান্য অন্তর্ভুক্তি থাকলেও শিক্ষার মাধ্যমে হয়নি পরিবর্তন, আর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্পর্কেও এখনো মান্ধাতার আমলের বৈরিতা বিরাজ করে। তাই যুগের পরিবর্তনের সাথে এই দেশে 'মাসিক' বা 'পিরিয়ড' শব্দগুলো 'ট্যাবু' বা 'নিষিদ্ধ' নয়, বরং জ্ঞানের অভাবে গুরুত্বহীনভাবে 'ডার্ক কমেডি' বা 'নিষিদ্ধ কৌতুক' হিসেবে নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে।

আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতির পরেও, শিক্ষকরা খুবই সচেতনতার সাথে পাঠ্যপুস্তকের আলোচিত মাসিক ও নারীর স্বাস্থ্যসচেতনতার বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যান, এটা কৌতুক নয়? স্বাস্থ্য আপারা দেশের সকল নারীদের ঘরে ঘরে গিয়ে জানান দিয়ে আসছে স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার কতটা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু বাস্তবে দেশের জাতীয় বাজেটে স্যানিটারি প্যাডের মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়াটা কৌতুক নয়? অক্ষয় কুমারের সচেতনতামূলক সিনেমা 'প্যাডম্যান' ২৫০ কোটি রুপি'র কাছাকাছি আয় করে হিট ফিল্ম বিবেচিত হয়, কিন্তু আমাদের বোনেরা পিরিয়ডের সময় বাসায় বসে থাকে যাতে তাকে হাসির পাত্র হতে না হয়, এসব কৌতুক না? 

ঠিক আছে, আরেকটা শিক্ষার প্রসঙ্গে টেনে এই ব্যাপারটার ফয়সালা করা যাক। আমাদের ধর্মীয় শিক্ষা মাধ্যমগুলোতে নারীর মর্যাদা অনেক বলে দাবি করা হয়। কিন্তু একই সাথে অধিকাংশ ধর্মচর্চায় নারীর 'মাসিক' বা 'পিরিয়ড'কে একটা অসুখ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমন, খ্রিস্টান ধর্মে রজঃস্রাবরত মহিলা এবং তাদের সাথে সহবাসরত পুরুষ উভয়কেই অশুচি মনে করা হতো। এমনকি মেয়েদের যাজক হতে না পারার অন্যতম কারণ তাদের 'মাসিক'। হিন্দু ধর্মে মাসিক অবস্থায় মেয়েদের রান্না ঘর কিংবা মন্দিরে প্রবেশ নিষেধ, এটা সচেতনতার বশে নয় বরং তারা এই সময়ে মেয়েদের অশুচি মনে করেন তাই। ইসলাম ধর্মে, নারীরা মাসিক অবস্থায় হজ্ব পালনরত থাকলে কাবা শরীফ প্রদক্ষিণ না করলেও চলে। যদিও ধর্মগুরুরা এটাকে নারীদের সুবিধার জন্যই বলে অভিহিত করেছেন। তবে, একথার দ্বিমত চলে না, ধর্মশিক্ষাতেও আমাদের নারীদের স্বাস্থ্যসচেতনতা আর 'মাসিক'-এর ব্যাপারগুলো খুব সূক্ষ্মভাবেই এড়িয়ে চলেন ধর্মগুরুরা। অর্থাৎ ধর্মশিক্ষাতে আজও 'মাসিক' একটা নিষিদ্ধ আলোচনা।

আরেকটা শিক্ষার মাধ্যম আছে, যাকে বলে পারিবারিক শিক্ষা। শিক্ষার সবচাইতে শক্তিশালী ও কার্যকর মাধ্যম হল পারিবারিক শিক্ষা। কিন্তু আমাদের দেশের পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় অধিকাংশ পরিবারগুলোতে যেখানে ছেলেদের স্যান্ডো গেঞ্জি মেয়েদের স্যানিটারি প্যাডের তুলনায় অধিক গুরুত্ব পায়, এবং বেশি সমাদৃত হয়; সেখানে পারিবারিকভাবে মেয়েদের মাসিক নিয়ে আলোচনা করাটা আর ছেলে সন্তানকে 'মাসিক' অবস্থায় মেয়েদের ব্যাপারে কটুক্তি না করার পরামর্শ দেয়াটা খুবই বেখাপ্পাই হয়তো লাগে। আর তাই ছেলে সন্তানরা হয় বেপরোয়া আর 'মাসিক' ব্যাপারটা হয় তাদের কাছে কৌতুক।

আমাদের বর্তমান স্কুল- কলেজের ছেলেদের মধ্যে একটা কৌতুক খুবই জনপ্রিয়, যা তারা তাদের মেয়ে বান্ধবীর সামনে খুব রসের মাধ্যমে উপস্থাপন করে নির্দিষ্ট কিছু সময়ে। শোনাই আপনাদের,
"— বলতো স্যানিটারি ন্যাপকিন আর নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসের মধ্যে মিল কোথায়?
— কোথায়?
— শুনিস নি? গিভ মি ব্লাড, আই উইল গিভ ইউ ফ্রিডম।"

বুঝতেই পারছেন, আমাদের দেশের অধিকাংশ ছেলেদের কাছে 'মাসিক' আর কোন 'ট্যাবু' বিষয় নয়, বরং আমাদের বিভিন্ন মাধ্যমের শিক্ষা এটাকে একটা রসিকতায় পরিণত করে ছেড়েছে। আর নিষিদ্ধ রসিকতাকে যতদিন না পারিবারিক, ধর্মীয় কিংবা একাডেমিক শিক্ষায় পরিবর্তন করা না যায়; এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা একটা 'উপহাস'ই রয়ে যাবে। 

অধ্যাপক মোতাহের হোসেন চৌধুরী অনেকটা সুন্দর ভাবেই হয়তো বলেছিলেন তাই, "লেফাফাদুরস্তি আর শিক্ষা এক কথা নয়। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য জ্ঞান পরিবেশন নয়, মূল্যবোধ সৃষ্টি। তাই যেখানে মূল্যবোধের মূল্য পাওয়া হয় না, সেখানে শিক্ষা নেই।"

 

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ