লকডাউন শিথিলের দিকে বিভিন্ন দেশ
করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর লকডাউন জারি করা হয়েছে বিশ্ব জুড়ে। এতে সংকটে পড়েছে অর্থনীতি। এরপর ‘জীবন না জীবিকা কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ’ এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সবার মধ্যে। ফলে করোনার প্রকোপ বাড়লেও লকডাউন তুলতে শুরু করেছে বিভিন্ন দেশ। বিশেষ করে আমেরিকায় লকডাউন না তোলা হলেও মানুষ ঘরের বাইরে বেরিয়ে পড়েছে। অথচ দেশটিতেই সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ঘটেছে। ব্রিটেনে লকডাউন শিথিল না হলেও কিছু স্থানে যানজট সৃষ্টি হয়েছে। তবে জাপানে জরুরি অবস্থার মেয়াদ বেড়েছে।
লকডাউন তোলা নিয়ে গোটা বিশ্ব যখন দোলাচলে তখন করোনা সংক্রমণ হয়েছে প্রায় ৩৬ লাখ মানুষের মধ্যে। ওয়ার্ল্ডো মিটারের পরিসংখ্যান বলছে, সোমবারের মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৩৫ লাখ ৯১ হাজার ৭০৩। মৃত্যু হয়েছে দুই লাখ ৪৯ হাজারের বেশি মানুষের। সুস্থ হয়েছেন ১১ লাখ ৬৫ হাজার ৮৭৮ জন। কিন্তু চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানীদের অনেকেই বলছেন, যেসব দেশে করোনা পরিস্থিতি সামান্য ভালো হয়েছে, সেখানে ফের ফিরে আসতে পারে এই মরণব্যাধি। সম্প্রতি আফগানিস্তানে এক জরিপের রিপোর্ট বলছে, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে রাজধানী কাবুলের এক তৃতীয়াংশ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হবেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও আগেভাগে লকডাউন শিথিল নিয়ে সতর্ক করেছিল।
সংক্রমণ বাড়লেও ঘরের বাইরে আমেরিকানরা: গতকাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় আক্রান্ত ১১ লাখ ৮৯ হাজার ২৪ জন। মারা গেছে ৬৮ হাজার ৬০৯ জন। সংক্রমণের হার এখনো কমেনি। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানিয়েছেন, লকডাউন তুলে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক ছন্দে ফেরার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। বস্তুত রবিবার থেকেই দেশের জনগণ রাস্তায় বের হতে শুরু করেছেন। বিক্ষোভে মাস্ক ছাড়াই অংশ নিচ্ছেন অনেকে।
নিউ ইয়র্কের মতো করোনাপ্রবণ জায়গায় রবিবার রৌদ্রস্নান করতেও বেরিয়ে পড়েছিল মানুষ। এ নিয়ে চিন্তিত হোয়াইট হাউজে করোনা টাস্ক ফোর্সের সমন্বয়ক ডেবোরা বার্ক্স। তিনি বলেছেন, এভাবে জনগণ রাস্তায় বের হলে সংক্রমণ কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবশ্য জানিয়েছেন, অর্থনীতি সচল রাখতে লকডাউন তুলতেই হবে। তবে কোথায় কীভাবে লকডাউন তোলা হবে, তার সিদ্ধান্ত নেবেন রাজ্যের গভর্নররা। যুক্তরাষ্ট্রে অর্ধেকের বেশি রাজ্যে লকডাউন শিথিল হয়েছে।
আরো অনেক দেশে লকডাউন শিথিল শুরু: দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে লোকজন বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে ঘরে থাকার পর গতকাল সকাল থেকে ইতালিতে সরকার লকডাউনের বিধিনিষেধ ধীরে ধীরে তুলে নিতে শুরু করেছে। এই দেশটিতেই সর্বপ্রথম লোকজনকে ঘরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
এক সময় করোনা ভাইরাস মহামারির কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল এই ইতালি। প্রধানমন্ত্রী জোসেপে কন্টি বলেছেন, লকডাউন পুরোপুরি তুলে নেওয়ার বিষয়টি নির্ভর করবে সংক্রমণের গতি-প্রকৃতির ওপর। তবে তিনি সতর্ক করেছেন, বিধিনিষেধ শিথিল করাকে যেন ‘আমরা করোনা ভাইরাস থেকে পুরোপুরি মুক্ত’ সেভাবে দেখা না হয়।
ব্রিটেনে সংক্রমণ এবং মৃত্যু দুইটাই বাড়ছে। দেশটিতে আক্রান্ত ১ লাখ ৮৬ হাজার ৬০০ এবং প্রাণ গেছে ২৮ হাজার ৪৪৬ জনের। এজন্য সরকার লকডাউনও শিথিল করেনি। কিন্তু লন্ডনসহ কয়েকটি শহরে গাড়ি চলাচল বেড়েছে। গাড়ি চলাচল ২ শতাংশ থেকে ১৩ শতাংশ বেড়েছে। কোথাও কোথাও যানজটও দেখা গেছে।
স্পেনে সাত সপ্তাহের মধ্যে এই প্রথম বয়স্করাও হাঁটাহাঁটি করতে বাইরে বের হতে পারছেন। ফ্রান্সও আগামী সপ্তাহে লকডাউন তুলে নেবে। ১১ মে থেকে ফ্রান্সে বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারবে পর্যায়ক্রমে। কোথাও কোথাও কিছু বাণিজ্য চালু হবে। পর্তুগালে ছয় সপ্তাহ ধরে চলছিল জরুরি অবস্থা। দেশটি এখন তিন ধাপে অচলাবস্থা নিরসনের পরিকল্পনা করেছে।
লকডাউন নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানে স্কুল-কলেজ খোলার প্রস্তুতি শুরু করেছে সরকার। বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন, স্কুল-কলেজ খুলে দিলে নতুন করে করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতি তৈরি হবে। জার্মানিতেও স্কুল-কলেজ খোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এছাড়া ডেনমার্ক, নরওয়ে, চেক রিপাবলিক, পোল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, আলবেনিয়া, গ্রিস, দক্ষিণ আফ্রিকা ও নাইজেরিয়াসহ আরো কিছু দেশ লকডাউন শিথিল করেছে।
থাইল্যান্ডে খুলে দেওয়া হয়েছে কিছু খাবার দোকান ও পাব। হংকং সরকার কিছু কিছু কর্মক্ষেত্র খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জর্ডানে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বাধা নেই। তিউনিশিয়ায় খুলে দেওয়া হচ্ছে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ শিল্প। মিসরে অভ্যন্তরীণদের জন্য হোটেল খুলে দেওয়া হচ্ছে। তবে সেখানে সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে ২৫ শতাংশ। ইরানে অনেক শহরে মসজিদ খুলে দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় স্কুলও খোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
জাপানে জরুরি অবস্থার মেয়াদ বৃদ্ধি: জাপানে জরুরি অবস্থার মেয়াদ মে মাসের শেষ দিন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। গতকাল সরকারের এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দেশটি করোনা ভাইরাসের বড়ো ধরনের প্রকোপ এড়াতে সক্ষম হলেও শনাক্ত হয়েছে ১৫ হাজার মানুষ। মারা গেছে প্রায় ৫০০ জন। জরুরি অবস্থা বুধবারেই শেষ হওয়ার কথা ছিল।
সূত্র: ডয়চেভেলে, বিবিসি ও আলজাজিরা