এইচএসসির ফল: প্রাসঙ্গিক কিছু কথা
আজ ২৬ নভেম্বর (রোববার)। ২০০৩ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। এতে কেউ ভালো ফল করেছেন, কারও কারও ফল আশানুরূপ হয়নি। যারা প্রত্যাশিত ফল পেয়েছেন, তাদের অভিনন্দন। যাদের ফল আশানুরূপ হয়নি, তাদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই। তাদেরও অভিনন্দন জানাই। আমাদের মনে রাখতে হবে, পরীক্ষার ফলই জীবনের সব কিছু নেই। জীবন অনেক বড় ব্যাপার, জীবনে অনেক কিছুই করার আছে। সুতরাং পরীক্ষার ফলকে কেন্দ্র করে হতাশায় নিমজ্জিত হওয়ার কিছু নেই।
অভিভাবকমণ্ডলী সন্তানের কাছে সবসময় সফলতার গল্প শুনতেই পছন্দ করেন। কিন্তু জীবনে হার-জিত অবশ্যম্ভাবী। কারণ হার আর জিত একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। হয় মানুষ জয়ী হয় নতুবা পরাজয় বরণ করতেই হয়। তবে মানুষ পৃথিবীতে হারার জন্য জন্মায় না। একটা না একটা সময় অবশ্যই মানুষ জয়ী হয়। কিন্তু আমরা জয়ী হওয়াকে যতটা সাদরে গ্রহণ করতে পারি, হারকে নয়। জীবন একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাপন করতে হয়। সেই প্রক্রিয়ার পথে নানারকম প্রতিবন্ধকতা আসতেই পারে। তবে সেটাকেই জীবনের শেষ বলে ধরে নেওয়া বোকামি।
আমাদের পরিবার, সমাজের চিন্তাধারা এমনভাবে গড়ে উঠেছে, তারা সন্তানের বিশেষ করে মেয়ের ক্ষেত্রে খুব বেশি আধিপত্যপ্রবণ। ফলে মেয়ের জীবনযাপন, বিধিনিষেধ পরিবার এবং সমাজের চাহিদানুযায়ী গড়ে ওঠে। চলতি বছর সব শিক্ষাবোর্ড মিলিয়ে পরীক্ষায় মোট পাস করেছেন ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৮৫২ জন পরীক্ষার্থ। শুধু ৯টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডে পাসের হার ৭৫ দশমিক ৯ শতাংশ।
ব্যক্তিভেদে প্রত্যেকের জ্ঞান ভিন্ন। তবে আমাদের সমাজ একটা নিক্তিতে মানুষের জ্ঞান, মেধার পরিমাপ করে। কিন্তু সবসময় তা সত্যি নয়। বিভিন্ন কারণেই পরীক্ষার ফল সন্তোষজনক নাও হতে পারে। এর কারণে সন্তানকে ভর্ৎসনা করে, কটু কথা বলে তার মন বিষিয়ে দেওয়া উচিত নয়। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা জীবনের পরীক্ষায় যেন ভালোভাবে এগিয়ে যেতে পারে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। মেধার সঙ্গে ভালো ফল অর্জনের কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, আরজ আলী মাতুব্বর, লালন সাঁইজীরা সাহিত্য-সংস্কৃতিতে এত বৃহৎ অবদান রাখতে পারতেন না। আজ আমরা যাকে পুঁথিগত বিদ্যা দিয়ে পরিমাপ করছি, তা নিতান্তই সমাজ পরিচালনার একটি অংশ মাত্র। কিন্তু তার জন্য জীবনকে বিষিয়ে তোলার মানে হয় না।
সন্তানের সন্তোষজনক সাফল্য পিতা-মাতাকে গৌরবান্বিত করে। কিন্তু সন্তানের সফলতা-ব্যর্থতায় সমান ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। ভালো ফল অর্জনে তাকে যেমন অহংকারী বা দাম্ভিক হতে শেখানো যাবে না, তেমনি ব্যর্থতায় মৃত্যুর মুখে ঠেলেও দেওয়া যাবে না। আমরা জানি, পড়ে গেলে ধুলো ঝেড়ে নিজেকেই উঠে দাঁড়াতে হয়। সেই কাজটি আপনার সন্তানকেই করতে হবে। কিন্তু অনুপ্রেরণার অংশ হতে পারেন আপনি। ভুলেও তাকে আত্মহননের পথে ঠেলে দেবেন না।
অভিভাবকদের সন্তানের জ্ঞান বিকাশের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। পারদর্শী করে তুলতে হবে জীবন সম্পর্কে। সেইসঙ্গে ভালো রেজাল্ট করতে পারে সেভাবে পড়াশোনাও করাতে হবে। এরপর যদি সত্যি সন্তোষজনক ফল না আসে তার জন্য সন্তানকে মানসিকভাবে চাপ সৃষ্টি করা উচিত নয়। কারণ পরিবার, সমাজের এত বিশ্রী চাপ নেওয়ার ক্ষমতা ছোট্ট বয়সে গড়ে ওঠে না। তাই সন্তানের ওপর মানবিক হোন। উদার হোন।
আর রেজাল্ট খারাপের সঙ্গে ভর্ৎসনা করার মানসিকতা পরিহার করতে হবে। বরং যতটুকু অর্জন বা ব্যর্থতা সাদরে গ্রহণ করতে শেখান। এতে সন্তানের জীবনবোধ তৈরি হবে। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে সন্তোষজনক রেজাল্ট হয়নি বলেই যে তাকে পরের ঘরে যেতে হবে; এই ধ্যান-জ্ঞান পরিহার করতে হবে। বরং কিভাবে সাফল্যের পথে এগিয়ে যেতে পারে সে বিষয়ে সচেতন করতে হবে। এখন গ্রামাঞ্চলে বিশেষভাবেই এই প্রথা প্রচলিত আছে। পরীক্ষার ফলকে কেন্দ্র করে অভিভাবকরা হুটহাট সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, বাল্যবিয়ে ক্ষতিকর। এক ফলকে কেন্দ্র করে মেয়েকে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু বানিয়ে না দেওয়া। প্রত্যেক পিতা-মাতাই সন্তানকে ভালোবাসেন বলেই চিরকাল আমরা জানি বা মানি। কিন্তু যেই অভিভাবকেরা ছোট্ট কন্যাকে বাল্যবিয়ে দিচ্ছেন সত্যিকার অর্থে তাদের ভালোবাসা কোথায়? জেনেবুঝে মেয়েকে হত্যা করছেন না?
পরীক্ষার রেজাল্ট কখনোই মেধা নির্ধারণ করতে পারে না। তাই সন্তানকে জ্ঞান অর্জনে উৎসাহী করুন। জীবন চলার পথে প্রতিবন্ধকতা দূর করার শিক্ষা দিতে হবে। সর্বোপরি মেয়ে বা কন্যা সন্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সচেতন হোন। তাদের প্রতি অবিচার বন্ধ করুন। যেকোনো ছুতোয় তার জীবনকে হুমকির মুখোমুখি দাঁড় করানো থেকে বিরত থাকি।