বাংলার একমাত্র মহিলা নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী
নারীশিক্ষা, সমাজ সংস্কার, জনকল্যাণ সেবাব্রতে নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী এক অনন্য চরিত্র। দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম শাসকদের একটি সম্মানী উপাধি ছিল নওয়াব। কেবল বাংলা নয়, তিনি ছিলেন পুরো দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র মহিলা নওয়াব। নারীশিক্ষার প্রবর্তক হিসেবে তৎকালীন সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তিনি।
নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ১৮৩৪ সালে কুমিল্লা জেলার (তৎকালীন ত্রিপুরা) লাকসাম থানাধীন প্রসিদ্ধ পশ্চিমগাঁও জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আহমেদ আলী চৌধুরী ছিলেন হোমনাবাদ-পশ্চিমগাঁও এর বিরাট জমিদার। তার মায়ের নাম আরাফান্নেসা চৌধুরাণী। সেসময় পূর্ববাংলার সমাজব্যবস্থা নানাভাবে পশ্চাৎপদ ছিল। তারপরও সেই পিছিয়ে পড়া সমাজকে এগিয়ে নিয়ে একজন নারী হয়ে সবার অগ্রভাবে ছিলেন ফয়জুন্নেসা। সেই সময় রক্ষণশীল সমাজে মুসলমান পরিবারে মেয়েদের শিক্ষার তেমন ব্যবস্থা ছিলোনা। কিন্তু ছোট থেকেই পড়ালেখার প্রতি ফয়জুন্নেসার ছিল বিশেষ আগ্রহ। মেয়ের আগ্রহ দেখে তাই তার বাবা আহমেদ আলী চৌধুরী তার জন্য গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করেন। গৃহশিক্ষক তাজউদ্দিন মিঞার অবদানে বাংলা, আরবি, ফার্সি ও সংস্কৃত এ চারটি ভাষায় জ্ঞান লাভ করে। জানা যায়, ফয়জুন্নেসার একটি লাইব্রেরি ছিলো। বিভিন্ন সাহিত্য ও ধর্মগ্রন্থের বইয়ে লাইব্রেরিটি ছিলো বেশ সমৃদ্ধ।
নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ছিলেন পিতা-মাতার প্রথম সন্তান। পিতা আহমদ আলী চৌধুরী ছিলেন অত্যন্ত বিদ্যোৎসাহী মানুষ। মেয়ের বিয়ের জন্য বিভিন্ন প্রস্তাব আসলেও মেয়ে বয়োঃপ্রাপ্ত না হওয়ায় তিনি প্রস্তাবগলিতে রাজী হননি। ১৮৪৪ সালে আহমদ আলী চৌধুরী মারা যান। পরবর্তীতে ১৮৬০ সালে মা আরফান্নেছা ফয়জুন্নেসার ফুফাতো ভাই পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের জমিদার মুহম্মদ গাজী চৌধুরীর সঙ্গে তার বিয়ে দেন। ফয়জুন্নেসা ছিল গাজীর দ্বিতীয় স্ত্রী। তিনি দুই কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। জানা যায়, বিয়ের সময় তিনি গাজীর প্রথম বিয়ে সম্পর্কে জানতেননা। পরবর্তীতে যখন সতীনের ব্যাপারে জানতে পারেন, বিষয়টি তার আত্মসম্মানে আঘাত করে। ফলে তিনি স্বামীর ঘর ছেড়ে চলে আসের বাবার বাড়িতে। এখানে এসে তিনি জমিদারির হাল ধরেন।
হোমনাবাদ পরগনার জমিদারীর ভার নিজের হাতে নেন তিনি। একজন নারী হয়েও সে সময়ে জমিদারির কঠোর দায়িত্ব তিনি সফলভাবে পালন করতে পেরেছেন। জমিদারী লাভের পরপরই তিনি জনগণের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। সেকালের সমাজ ব্যবস্থার সবরকম বাঁধা পেরিয়ে তিনি সম্পূর্ণ কুসংস্কার মুক্ত সমাজ গঠনে মনোযোগ দিয়েছিলেন। সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড এবং দীন-দরিদ্রের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন। মেয়েদেরকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য তিনি সব সময় উৎসাহিত করতেন। ১৮৭৩ সালে তিনি নারীশিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে কুমিল্লায় একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এটি উপমহাদেশে বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের প্রাচীনতম স্কুলগুলির অন্যতম। কালক্রমে এটি একটি কলেজে রূপান্তরিত হয় এবং এর নাম হয় নবাব ফয়জুন্নেসা কলেজ।
তিনি গরীব দুঃখীদের পানির কষ্ট নিবারণের জন্য দীঘি বা পুকুর খনন এবং চলাচলের সুবিধার জন্য অনেক রাস্তাঘাটের ব্যবস্থা করেন। ১৮৯৩ সালে পর্দাশীআহমেদ আলী চৌধুরী, বিশেষত দরিদ্র মহিলাদের চিকিৎসার জন্য তিনি নিজ গ্রামে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। তিনি ‘ফয়জুন্নেসা জেনানা হাসপাতাল’ নামে একটি চিকিৎসালয়ও স্থাপন করেন। ১৮৯৪ সালে হজ্জ পালন করতে গিয়ে ফয়জুন্নেসা মক্কায় একটি মাদ্রাসা ও একটি মুসাফিরখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও অসংখ্য স্কুল, মাদ্রাসা, ছাত্রাবাস, মসজিদ নির্মাণ করেছেন তিনি।
সে সময় ত্রিপুরার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন মি. ডগলাস। ত্রিপুরা অঞ্চল শিক্ষা ও উন্নয়ন খাতে সরকারি অর্থ আসতে দেরি হওয়ায় স্থানীয় ১০জন জমিদারের কাছে ঋণ হিসাবে ১০ হাজার টাকা করে ১ লাখ টাকা চাইলেন। কিন্তু স্বল্প সুদে কেউই তাকে ঋণ দিলেননা। তিনি আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। রাজনৈতিক কারণে ইংরেজদের প্রতি মুসলিমরা একটু বিরূপ হওয়ায় তিনি মুসলিম জমিদারের কাছে সাহায্য চাননি। ভেবেছিলেন মুসলিমরা হয়তো তাকে সাহায্য করবেনা। ডগলাসের এই চিন্তা উল্টো করে দিয়ে হঠাৎ একদিন এই ফয়জুন্নেসার নায়েব পুটুলি ভর্তি নগদ ১ লাখ টাকা নিয়ে এসে ডগলাসের হাতে দিলেন। সাথে একটি চিঠিতে লেখা ছিল, "আমি কাউকে ঋণ দিই না। আপনার পরিকল্পনা জনহিতকর। এটা নিশ্চিত হয়েই এই টাকা ত্রিপুরার কল্যাণে আমি দান করলাম।"
এই মহতী নারী সম্পর্কে ডগলাস ইংল্যান্ডে মহারানী ভিক্টোরিয়াকে জানালেন। রাণী ভিক্টোরিয়া এই জমিদারকে "বেগম" উপাধি দিলেন। কিন্তু ফয়জুন্নেসা এই উপাধি প্রত্যাখ্যান করেন। অন্য জমিদারদের যেখানে 'নওয়াব' উপাধি দেয়া হয় সেখানে তাকে কেন 'বেগম' উপাধি দেয়া হবে। তাই তিনি এই উপাধি গ্রহণ করেননা। এরপর রাণী ভিক্টোরিয়া তার প্রতিনিধিকে ফয়জুন্নেসার সাথে দেখা করতে পাঠান। তার সময়নিষ্ঠতা, সমাজসেবা দেখে তারা মুগ্ধ হয়ে তাকে ‘নওয়াব’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে জাঁকজমকপূর্ণভাবে ৩৫ হাজার টাকা ব্যয়ে সরকারিভাবে ‘নওয়াব’ খেতাব দেয়ার অভিষেক অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়। অভিষেকে তাঁকে মনোহর তারকাকৃতি হীরকখচিত একটি মহামূল্যবান পদক, রেশমী চাদর ও সার্টিফিকেট দেয়া হয়। পুরুষের এই উপাধি একজন নারীকে দেয়ায় কিছু পুরুষ জমিদার অভিযোগ করেছিলো। মহারাণী এ ব্যাপারে বলেন, এটি কোন মহিলা বা পুরুষের জন্য নয়, এটি কর্মের স্বীকৃতি।
এসবের পাশাপাশি সাহিত্যেও তিনি অবদান রেখেছেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম নারী সাহিত্যিক ছিলেন নবাব ফয়জুন্নেসা। নিজের বিদগ্ধ জীবনের রূপক চিত্র হয়ে উঠেছে ‘রূপজালাল’ কাব্যের কাহিনী। তার রচিত আরো দুটি কাব্য হল ‘সঙ্গিত সার’ ও ‘সঙ্গিত লহরী’।
৭০ বছর বয়সে ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের ২৩ সেপ্টেম্বর এই মহিয়ষী নারী পরলোক গমন করেন। বাড়ির পাশে তিনি একটি দশগম্বুজ মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন, যেখানে নারীরাও নামাজ আদায় করতে পারতো। সেই মসজিদের পাশেই শায়িত আছেন নওয়াব ফয়জুন্নেসা।
সমাজ সংস্কারক হিসেবে নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী তৎকালীন সময়ে যা করেছেন তা ইতিহাসে বিরল। অনস্বীকার্য অবদানের জন্য ২০০৪ সালে নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীকে মরণোত্তর একুশে পদক দেয়া হয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নামে ছাত্রীনিবাস রয়েছে।