আর কত এভাবে ঝরবে শারমিনের প্রাণ
যত দিন যাচ্ছে, ততই যেন নারীদের নিরাপত্তা সংকুচিত হয়ে আসছে। আগে নারীরা ঘরের বাইরে খুব বেশি অনিরাপদ ছিল। বর্তমানে ঘরে-বাইরে সমানভাবেই অনিরাপদ। নারী মানেই যেন এখন অন্যের ভোগদখলের সম্পত্তি। বাবা-মা বা পরিবার-পরিজন কোনো রকমে মেয়েকে শ্বশুর বাড়ির শরণাপন্ন করতে পারলেই তাদের দায়-দায়িত্ব সব শেষ হয়ে যাচ্ছে! সন্তান আদৌও একটি ভিন্ন পরিবেশে গিয়ে কতটা সুখী-স্বাচ্ছন্দ্যে আছে, সে বিষয়ে তেমন কোনো অভিভাবক জানতে আগ্রহী হন না।
বরং পুরুষতন্ত্রের ধারণা মেয়ে হিসেবে জন্মালে তার গন্তব্যই স্বামীর ঘর-সংসারে সীমাবদ্ধ। আর এই বদ্ধমূল সংস্কারের জন্য যুগ পাল্টালেও নারীদের ভাগ্যের কোনোই পরিবর্তন ঘটছে না। সংবাদকর্মী শারমিনের মতো অসংখ্য নারীর সঙ্গে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে নীরবেই নির্যাতন চলছে। কিন্তু যখন শারমিনদের হত্যা বা আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটছে, তখন হয়তো কিঞ্চিৎ সময়ের জন্য সবাই নড়ে-চড়ে বসছে। তবে অধিকাংশ নারীদের প্রতি এমন নির্যাতনের ঘটনা চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। তাহলে সত্যি কি এ সমাজ নারীদের আর মুক্তি দেবে না? শারমিনের মতো অকালেই নিজেকে হত্যা বা আত্মহত্যার উপদানে পরিণত করতে হবে?
আর যারা বাড়ির নারী সদস্য বা স্ত্রীর প্রতি এভাবে অন্যায় করবে তারা পার পেয়ে যাবে। আধুনিক যুগে এসে আমরা আবার গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি! সমাজের মাঝে গজিয়ে ওঠা এসব অরাজকতার কোনোই সুরাহা হচ্ছে না!
যে সমাজে নারীকে তার যোগ্য মূল্যায়ন, সম্মান, শ্রদ্ধা করা হয় না, সে সমাজ উন্নতও হতে পারবে না। একটি মৃত্যু শুধু রহস্যের জালে বেঁধে দিয়ে আর কত নারীর মৃত্যু এভাবে ধামাচাপা পড়বে। অপরাধী আদৌ শাস্তি পাবে কি না, তাও নিশ্চিত নয়। যে বা যারা এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে, তারা তো পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেই। কিন্তু শেষমেশ তার মৃত্যুর সত্য উদঘাটন না করলে পরবর্তী সময়ে অপরাধীরা আরও সুযোগ পাবে।
গণমাধ্যম বরাতে জানা যায়, সংবাদকর্মী শবনম শারমিনের (৩০) মৃত্যু নিয়ে রহস্য সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশ বলেছে, এটি হত্যা না কি আত্মহত্যা, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার আগে বলা যাচ্ছে না। শারমিনের স্বামী সাইদুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলে অনেক রহস্যের জট খুলতে পারে। ঘটনায় ২৮ ডিসেম্বর আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে সাইদুল ইসলামের বিরুদ্ধে হাতিরঝিল থানায় মামলা করেছেন শারমিনের বোন শবনম পারভীন।
পুলিশ জানিয়েছে, শারমিনের লাশ অন্তত পাঁচ দিন ধরে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছিল। সেই খবর স্বজন ও সহকর্মীদের কেউই জানতেন না। লাশ উদ্ধারের পর থেকে সাইদুল ইসলামের খোঁজ নেই। তিনিও একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সংবাদকর্মী বলে জানা গেছে। গত মঙ্গলবার (২৭ ডিসেম্বর) রাতে ঢাকার মগবাজারের একটি পাঁচতলা ভবনের পঞ্চম তলার ফ্ল্যাট থেকে শারমিনের গলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত মার্চ মাস থেকে শারমিন ও স্বামী সাইদুল এই ফ্ল্যাটে ছিলেন। বিয়ের পর থেকেই তাদের মধ্যে টানাপড়েন চলছিল। স্ত্রীর লাশ উদ্ধারের পর সাইদুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকার বাইরে আছেন বলে জানিয়েছেন।
পুলিশের তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হাফিজ আল ফারুক গণমাধ্যমকে জানান, শারমিনের স্বামীর আচরণ রহস্যজনক। তাকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলে অনেক রহস্যের জট খুলতে পারে।
পুলিশ জানায়, শারমিন মার্চে বিয়ে করলেও তা সহকর্মীদের কাছে গোপন রেখেছিলেন। শারমিনের গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহে। একযুগেরও বেশি সময় ধরে পরিবারের সঙ্গে তার তেমন যোগাযোগ ছিল না। তার স্বামী সাইদুল সম্পর্কে শারমিনের স্বজনরা তেমন কিছু জানেন না।
সংবাদ মাধ্যমের যে বিবৃতি সেটি বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায়, এটি আসলেই রহস্যের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এই রহস্যের শেষ কোথায়? এর আগেও এমন ঘটনা যে ঘটেনি এমনটা নয়! বরং সেই মৃত্যুও আজও রহস্যের জালে আবদ্ধ! তাহলে একজন করে নারী প্রাণ হারাবেন এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় আর কিছুদিন পর সব তলানিতে পড়ে যাবে। আর কত শারমিনের এমন মৃত্যু হলে এ সমাজ, রাষ্ট্র সত্যিই নারীর নিরাপত্তা নিয়ে ভাববে? রাষ্ট্রের কি কোনোই দায় নেই? এত দীর্ঘমেয়াদি আইনের জটিলতা পেরিয়ে তাহলে শারমিনদের জন্য কে সুষ্ঠু বিচার এনে দেবে! গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর মারফত জানা যায়, তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ শিথিল ছিল। তবে এই নারীর মৃত্যুর সঠিক বিচারের পেছনে কে বা কারা দৌঁড়াবে! আজ অবধি কত নারীর মৃত্যু বিচারের অভাবে চাপা পড়ে গেছে তার কি হিসাব আছে?
শারমিনদের জন্য এ সমাজের ন্যায় বিচার কবে প্রতিষ্ঠিত হবে? অত্যাচার-নিপীড়নের মাত্রা আরও বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার আগে নারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে দ্রুত অভিযুক্তকে আমলে নিতে হবে। অপরাধ চিহ্নিত হলে কঠিন শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বর্তমান সময়ে এসেও অনেক নারী বলা চলে অধিকাংশ নারী নির্যাতনের শিকার হলেও আইনের আশ্রয় গ্রহণ করেন না। তার কারণ এ রাষ্ট্র শারমিনদের মতো মানুষদেরই বিচার নিশ্চিত করতে পারেনি আর সাধারণ ভুক্তভোগীর কতটা সাহায্য করতে পারে! তাই যদি রাষ্ট্রের শাসনের প্রতি আস্থাশীল করে তুলতে হয় তাই দ্রুত এসব ঘটনার সঠিকতা নিরূপণ করতে হবে।
আজকাল এমন ঘটনা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এগুলো রোধ করা প্রয়োজন। নাহলে প্রিয়জনের প্রতি সামান্য বিশ্বাসটুকুও আর এ সমাজে থাকবে না। সবাই নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কিত হবে! মানুষের মনকে স্থির করতো, মানুষকে আবার ভাতৃত্ব, পিতৃত্ব, মাতৃত্ব, স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা; স্বামীর প্রতি আস্থা বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হলে মানুষকে মানবিকতার শিক্ষা দিতে হবে।
প্রেমের শিক্ষা দিতে হবে। আগের যুগে মানুষ কতটা হৃদয়বান ছিল অপরের দুঃখে বুক পেতে দিতে পারতো নিমিষেই! কোথায় গেলো সেই সুবর্ণ দিন! মানুষের মাঝে এমন বিভৎস হিংস্র রূপ কেনো জেগে উঠছে! আমাদের সমাজ মানবতার শিক্ষায় শিক্ষিত হোক। আপনজনকে বুকে আগলে রাখার দীক্ষা গ্রহণ করুক। পরস্পরের প্রতি সহোযোগিতাপূর্ণ মনোভাব সৃষ্টি হোক। ফিরে আসুক হারানো সেদিন। যেদিন মানুষ হয়ে মানুষের জন্য শুধু শান্তির বার্তা বহন করবে। কোনো হিংস্রতা, দৈন্য, বিকৃত মানসিকতার প্রকাশ ঘটবে না। আর এর মধ্যে দিয়ে শারমিনদের মুক্তি ঘটুক। আর একজন শারমিনও যেন অচিরে পৃথিবী থেকে হারিয়ে না যায়। এই রাষ্ট্র, এই সমাজ সেই শিক্ষায় শিক্ষিত করুক মানুষকে। বিশ্বাস করতে শিখুক ভালোবাসায়। স্বার্থহীন পৃথিবীর জয় হোক।