পেশা নির্বাচনে নারী স্বাধীন হোক
মানুষ সামাজিক জীব। কিন্তু এই মানুষের মধ্যেই সমাজ বিভেদ সৃষ্টি করেছে। নারী- পুরুষ ভেদে সমাজের কিছু বেধে দেওয়া নিয়মই যেন শেষ কথা। সেখানে মানবিক সমাজ গঠনের কিঞ্চিৎ সম্ভবনাও পরিলক্ষিত হয় না। নারীকে শুধু নারী হিসেবে গণ্য করার ফলে জীবনের গতিপথে নানাবিধ বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। নারী মাত্রই ঘরের বাইরে প্রবেশে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা।
তবু আজকের যুগে এসে নারীরা কিছুটা হলেও এই অপপ্রথাকে টপকাতে পেরেছে। কিন্তু জীবনের সর্বত্র তা একেবারেই সম্ভব হয়নি। অন্তত পেশা নির্বাচনের ক্ষেত্রে নারীর রয়েছে নানাবিধ বিধিনিষেধ, প্রতিবন্ধকতা। আমাদের দেশে সব সেক্টরে আজও নারীকে ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারে না মানুষ। আগের যুগে নারী পুলিশ, আর্মি কিম্বা প্রশাসনের যেকোনো ডিভিশনে দেখলেই নাক সিটকে উঠতো। তীর্যক মন্তব্য এবং বাঁকা চোখের চাহুনিতে নারীর জীবন ওষ্ঠাগত হতো। তবে আজও যে নারী এ থেকে পরিত্রাণ পেয়েছে এমনটা নয়। নারীরা ঘরে- বাইরে এর জন্য নানা বিড়ম্বনার শিকার হন। মোদ্দাকথা হলো, নারীরা আজও জীবনযাপন এবং পেশা নির্বাচনে স্বাধীন নয়।
শুধু আমাদের সমাজেই নয় পুরো বিশ্বের পরিসংখ্যান ঘাটলে সহজেই অনুমেয় হবে যে, নারী বিজ্ঞানীর সংখ্যা কয় জন! এতে একটি বিষয় সুস্পষ্ট যে, নারীরা চাইলেই সবক্ষেত্রে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে পারে না। পারিবারিক বাধার পাশাপাশি সামাজিক নানা বাধাবিপত্তির মুখে পড়তে হয় নারীকে। এছাড়া নিরাপত্তার বিষয় তো রয়েছেই। এজন্য নারীরা পুরুষের মতো সবক্ষেত্রে নিজেদের মেধাকে বিকশিত করতে পারে না। একজন পুরুষ পরিবারে অর্থ প্রদান করেই ক্ষান্ত থাকছেন। বাচ্চা লালন-পালন থেকে শুরু করে বয়োজ্যেষ্ঠদের দেখভাল এবং পারিবারিক বন্ধনকে দৃঢ় করতে নানাবিধ সামাজিকতা রক্ষার দায় একজন নারীর। এসব হাজারদিক সামলে নারী নিজের সম্পর্কে হয়ে পড়েন উদাসীন। কাজে মনোযোগী হওয়া, মেধার বিকাশ ঘটানো, জীবনের অর্থ এগুলো সম্পর্কে কোনোই তাগিদ অনুভব করতে পারেন না বেশিরভাগক্ষেত্রে। ফলে নিজের জীবনের চাহিদা- আকাঙ্ক্ষা – বাসনা কোনোটারই সঠিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে অধিকাংশ নারী ব্যর্থ হন। আর এসব অবজ্ঞা – অবহেলা – উদাসীনতা- জ্ঞানের অপ্রতুলতা সবই এসে ভিড় করে কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে জানতে- বুঝতে। তাই নারী চাইলেই হুট করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না জীবন সম্পর্কে।
স্বাধীন বাংলাদেশে এখনও অর্ধেক নাগরিক পরাধীন বললেও অত্যুক্তি হয় না। সেই অর্ধেক নারগিরক কারা? এই প্রশ্নের উত্তর- নিশ্চয় নারী। তারা স্বাধীন দেশের নাগরিক। সংসার জীবন থেকে শুরু করে পেশা নির্বাচন পর্যন্ত যেকোনো সিদ্ধান্তে পুরুষতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল। কঠিন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে প্রতি-নিয়ত তারা সমাজের সব ধরনের প্রতিবন্ধকতাকে রুখে দেওয়ার চেষ্টা করলেও নিজের জীবনে এসে সম্পূর্ণ একা, অসহায়!
বিভিন্ন সামাজিক কারণে পেশা নির্বাচন করার ক্ষেত্রে নারীরা নির্বিকার! পেশা নির্বাচন সম্পর্কে তাদের শৈশব থেকে ভাবতে শেখানো হয় না। বরং নারীদের ঘরোয়া-জীব হিসেবে গড়ে তুলতেই পরিবার-সমাজের থাকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা।
কিন্তু এখন যুগের পরিবর্তন ঘটেছে। একইসঙ্গে জীবন-জীবিকার ধরনেও পরিবর্তন এসেছে। এরপরও নারীর কল্পনার জগৎকে প্রসারিত করার মতো স্বাধীনভাবে পেশা নির্বাচনের অধিকার দেয় না সমাজ।
পুরুষের মতো নারীও স্বাধীন সত্তার মানুষ। তাই নারীকেও আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে তোলা উচিত। এজন্য পরিবার থেকেই নারীর মতপ্রকাশ ও পেশা নির্বাচন করার অধিকার বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে। কিন্তু কন্যা শিশুকে গড়ে তোলাই হয় পোষ মানা টিয়া পাখিটার মতো করে। যাতে পুরুষতন্ত্রের হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলানোর বাইরে নারী আর কিচ্ছু চিন্তা করার সুযোগও না পায়।
আমাদের সমাজের দিকে লক্ষ করলেই নারীদের অবস্থান দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। দেশের অভ্যন্তরে কয়জন ট্রেন চালক, কয় জন বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এমডি- চেয়ারম্যান, ব্যাংকের এমডি, পুলিশের ডিআইজি, বিমান চালক, কয় জন কম্পিউটার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, কয়জন নারী কৃষি উদ্যোক্তা, চিকিৎসাক্ষেত্রেই বা কয়জন নারী সম্পৃক্ত আছেন?
প্রত্যেক বছর অন্তত হাজার হাজার নারী শিক্ষার্থী ডাক্তারি পাশ করে বের হচ্ছে। কিন্তু কয়জন নারী ডাক্তারের নাম শোনা যায়! আর কয়জন নারী ডাক্তারের নাম-ডাক বা প্রচার- রসার রয়েছে! আজকের যুগে এসে এটা খুবই ভাবনার বিষয়। বরং বাংলাদেশের বর্তমান চিত্রে দেখা যায়, ছেলে শিক্ষার্থীর চেয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও মেয়েদের অংশগ্রহণ বেশি। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে গিয়ে নারীরা জায়গা করে নিতে পারছে না। পরিসংখ্যানের সঙ্গে যথেষ্ট গড়মিল। তবে এত শিক্ষা- দীক্ষা অর্জন করে এই নারীরা কোথায় ঘাপটি মেরে বসে থাকলো! কে তাদের খোঁজ নিয়েছে! মেধার দৌড়ে অনেক নারীই পুরুষের চেয়ে অধিকরতর যোগ্যতা রয়েছে বড় দায়িত্ব পাওয়ার কিন্তু শুধু নারী হওয়ার কারণে তাকে অবমূল্যায়ন করা হয়।
এমন হাজরো পেশা রয়েছে যেখানে নারীদের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে! কিন্তু নারী কেন আজও পেশা নির্বাচনে স্বাধীন নয়? কেন তাদের মানসিক শক্তি গড়ে উঠছে না? এর দায় কার! পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রসহ সব ক্ষেত্রে নারীদের কাজের উপযোগী পরিবেশ তৈরি না হলে তাদের মানসিক শক্তি গড়ে উঠবে না।
নারী-পুরুষের দৈহিক গঠন বাদে কোথায় প্রভেদ! নারীদের শক্তি-যোগ্যতা সবই আছে কিন্তু এঁরা আজও পুরুষতন্ত্রের শিকার। পুরুষতন্ত্রের জালে বন্দি। কিন্তু এভাবে আর বেশি দিন চলতে দেওয়া যায় না। সমাজের পরিবর্তন হয়েছে৷ সম্পর্কে- চেতনায়- জীবনযাপনে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। ফলে নারীর পেশা নির্বাচনের ভারও নারীকে গ্রহণ করতে হবে। পরিবার -পরিজনদের চাপিয়ে দেওয়া মতকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে নিজরে জীবনের সুপ্ত প্রতিভাকে অঙ্কুরে বিনাশ করা উচিত নয়। এখনই সময় নারীর আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পেশা নির্বাচনে গুরুত্ব দেওয়া। নারীর পেশা হোক সর্বময়। হার মানা হার পরুক গলে; তবেই নারীর মুক্তি। তবেই নারী শক্তির জাগরণে পৃথিবী হোক পাপ-পঙ্কিলতা মুক্ত।