প্রবীণ নারীরা পরিবারের বোঝা নয়, অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার
একটি বয়সের পর মানুষ খুব অসহায় হয়ে পড়ে। জীবনযাপনে যেমন পরিবর্তন আসে ঠিক তেমনই পরিবর্তন ঘটে স্বাভাবে বা আচরণেও। পুরুষের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা থাকে বিধায় তাদের জীবনে সমস্যাগুলো কিঞ্চিৎ কম। আর তাদের দেখভালের জন্য বিশেষত পাশে থাকেন সঙ্গিনী। কোনো পুরুষ যদি বিপত্নীক হন, তবে অধিকাংশই আবারও নিজের জীবনকে রাঙিয়ে তুলতে ব্যবস্থা করেন। ভিন্ন-ভিন্ন ধারায়। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে এই বয়সটা এতটা ঝুঁকিপূর্ণ যে নারীরা সঠিকভাবে জীবন পরিচালনা করতে বেশ হিমশিম খান।
প্রবীণ বলতে মূলত আমরা ষাটোর্ধ নারী-পুরুষকেই বুঝি। বাংলা প্রবাদে প্রচলিত আছে, ‘নারী নাকি কুড়িতেই বুড়ি হয়’। ভিত্তিহীন হলেও সমাজের মাঝে যুগ যুগ ধরে ফুলেফেঁপে উঠেছে এই বস্তাপচা সংস্কার। মানসিক সুস্থতাই পারে এ ধরনের প্রথার মুখে আগুন দিতে। যাইহোক এই প্রথা যদি সমাজে প্রচলিত থাকে তবে ভাবতেই হয় ষাটোর্ধ্ব নারীর জীবনের কী রূপ হাল হতে পারে! প্রবীণ নারীরা এই বয়সে বেঁচে থাকেন অনেক কষ্ট বুকে চেপে। কারণ এই সময়টাতে তারা খুব কাছের মানুষদের ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলেন। অনেকেই তার জীবনসঙ্গীকেও হারিয়ে নিঃস্ব জীবনযাপন করতে থাকেন। ফলে নারীদের জন্য খুব কঠিন একটা সময় পার করতে হয় প্রবীণ বয়সে। এসময় একমাত্র মানসিক সাপোর্ট তাকে নতুনভাবে বাঁচতে সহোযোগিতা করতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গ্রামেই ৮০ ভাগের ওপর মানুষ বাস করে। আর শহরের তুলনায় তাই গ্রামীণ নারীদের সংখ্যাও বেশি। আমরা জানি যে, আমাদের সমাজ বাস্তবতায় গ্রামের নারীরা মূলত পরিবারকেই বেশি সময় দেয়। রান্নাঘরেই তাদের জীবনের বেশি সময়টা অতিবাহিত হয়। তার পাশাপাশি কিছু নারী চাকরিজীবীও আছেন। তবে হাতেগোনা। এর বাইরে কিছু আছেন যারা স্বামীর সঙ্গে কৃষিকাজে সহোযোগিতা করেন, শ্রমজীবী নারীও রয়েছেন। তবে খেয়াল করে দেখলে অতি সহজেই অনুমেয় যে, এগুলো সবই ক্ষণস্থায়ী রূপ নারীদের। কারণ তাদের বয়স যখন ষাটোর্ধ্ব হয় তখন তারা না সঠিকভাবে রান্নাঘর সামলাতে পারেন, না শ্রমজীবী হয়ে কাজ করতে পারেন! ফলে তখন এই প্রবীণ নারীটি হয়ে পড়েন পরিবারে বোঝাস্বরূপ। তার এতদিনের দীর্ঘ জীবনে সন্তান এবং পরিবারের জন্য তিনি যে স্বার্থত্যাগ করলেন, সেটা তখন সন্তানদের কাছে অধিকাংশক্ষেত্রেই ধোপে টেকে না। তাই প্রবীণ নারীকে পরিবারের গলগ্রহ হয়ে বাকি জীবনটুকু পার করতে হয়। এক্ষেত্রে ইতিমধ্যে প্রবীণ নারীটির স্বামীর মৃত্যু ঘটলে তাকে আরও নিঃসঙ্গ, অসহায়, অসাঢ় জীবনে অভ্যস্ত হতে হয়।
ধীরে ধীরে তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে নানা জটিলতায়ও ভুগতে থাকেন। পরিবারের সদস্যদের এহেন আচরণ তাকে আরও মুষড়ে দেয়। প্রবীণ নারীটি তার জীবনের অফুরন্ত অবসরে তাই জায়নামাজ, পূজাপাঠে সময় অতিবাহিত করেন। কিন্তু দিনশেষে তার অর্থাভাব, মনের সব চাহিদা অপূরণীয় থেকে যায়। মন খুলে কথা বলার মতো পাশে কাউকে পান না।
বাইরের দেশে প্রবীণ নারীরাও কাজের সুযোগ পান। আর আমাদের দেশের মতো বহির্বিশ্বে ষাটোর্ধ বয়সে কেউ এতটা অসহায় হয়েও পড়েন না। সেক্ষেত্রে তাদের জীবনযাপন, ধরন-ধারণ পুরোপুরি ভিন্ন। কিন্তু এদেশের প্রবীণ নারীরা বেঁচে থেকেও জীবিত লাশের মতো জীবনযাপন করেন। আগের যুগে যৌথ পরিবারে বয়স্ক নারী-পুরুষের একটা বেঁচে থাকার অবলম্বন ছিল। তাদের মতকে গুরুত্ব দেওয়া হতো। নাতি-নাতনি, পরিবারের ছোট সদস্যদের নিয়ে একটি মনোমুগ্ধকর পরিবেশ পেতেন তারা। গল্প বলে, অভিজ্ঞতা শেয়ার করে তাদের সময়টা স্বতঃস্ফূর্ত ধারায় পার করতে পারতেন। কিন্তু মানুষ এখন যান্ত্রিক জীবন পার করছেন। বেশিরভাগই ইলেকট্রনিক ডিভাইসে আসক্ত। ফলে পাশের মানুষটিরও ঠিকঠাক খোঁজ নেন না বা ইচ্ছে পোষণ করেন না। সেক্ষেত্রে প্রবীণদের কথা তো হিসেবের বাইরে। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণ নারীদের জীবন আরও ঝুঁকিতে!
প্রকৃতিগতভাবেই নারীদের শারীরিক পরিবর্তনও ঘটে পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশের পর। তাই তার মধ্যে মেজাজ-মর্জির ওঠানামা, শারীরিক দুর্বলতা, জীবনযাত্রায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তারপরপরই জীবনের একের পর এক বাক বদল ঘটে এসময়টাতে। ফলে প্রবীণ নারীরা হয়ে পড়েন অসহায়। একাকীত্ব তাদের গ্রাস করে ফেলে। অঢেল সময় অলস পার করতে করতে তারা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসব সমস্যার পরিত্রাণ ঘটাতে সর্বোচ্চ সহোযোগিতা করতে পারেন পরিবারের সদস্যরা।
তারাই পারেন প্রবীণদের সুস্থ, সুন্দর, মনোরম পরিবেশ দিতে। তাদের এই পরিবেশ নিশ্চিত করার মধ্যে দিয়ে তারাও লাভবান হয়ে উঠবেন। কারণ শহরাঞ্চলে নারী-পুরুষ এখন উভয়ই কোন না কোন কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করছেন ফলে বাড়ির আগত সন্তানটি কিন্তু বেড়ে ওঠার সুস্থ পরিবেশ পাচ্ছে না। যদি পরিবারগুলো নতুনভাবে নিজেদের মানসিকতা বদলায় তবে আবারও সংগঠিত হতে পারে প্রবীণদের জীবন। সেইসঙ্গে পরিবারে একটা ঐক্য তৈরি হবে। বড়দের কাছে সন্তানেরা শ্রদ্ধাবোধ শিখবে, ধৈর্য্য, নমনীয়তার শিক্ষালাভ করবে। অভিজ্ঞতা দিয়ে জীবনের প্রতিটি পথ কিভাবে পার করতে পারে প্রভৃতি জ্ঞান লাভ করবে। প্রবীণদের বোঝা নয় বরং পরিবারের মাঝে
ভাতৃত্বের বন্ধন প্রগাঢ় করার মাধ্যম তারা। এই অস্থিতিশীল পরিবেশে কাছের মানুষ খুব দরকার। যারা দিনশেষে একটু স্বস্তির আশ্রয় হবে। আর বাবা- মা বা পরিবারের প্রবীণ সদস্যরাই পরম আশ্রয় হতে পারে। যদি তাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সম্মান জাগ্রত করা যায়। আসুন প্রবীণদের প্রতি নমনীয় হই। আমরা যাদের অনুজ তাদের প্রতি বিনম্র থাকি। যদি আমরা সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশ গড়ে তুলতে পারি তবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও একটি নির্মল, কোমল, প্রাণবন্ত পরিবেশ পাবে। তাই প্রবীণ নারীদের মানসিক সাপোর্ট দেওয়া এখন সময়ের দাবি।