শিশুর বাড়তি খাবার শুরুর আগে কিছু বিষয়!
অনেক পরিবারেই সদ্য জন্মগ্রহণ-কৃত বাচ্চা থেকে ২-৩ বছরের বাচ্চাদের বাড়তি খাবার নিয়ে কিছু ভুল-তথ্য শুনে থাকি। বিষয়টিকে ঘিরে বিভিন্ন আতংক বিরাজ করে সমাজে। সে জায়গাটি থেকে ডাঃ লুনা পারভীন(এমবিবিএস, ডিসি এইচ, শিশু বিশেষজ্ঞ, বহির্বিভাগ, ঢাকা শিশু হাসপাতাল) এর মতামত নেওয়া।
প্রথম কথাই হলো যারা নতুন মা, যদি সঠিক তথ্য জানা না থাকে তবে প্রয়োজনে অবশ্য একজন শিশু বিশেষজ্ঞ অথবা নিউট্রিশনিষ্টের কাছ থেকে পরামর্শ নিন। আশেপাশের অভিজ্ঞ অনেকের ভুল পরামর্শ আপনার বাচ্চার জন্য বরং ক্ষতিকর হতে পারে। বাচ্চার ৬ মাস পূর্ণ হলেই কেবল বাড়তি খাবার দেয়ার চেষ্টা করবেন। তার আগে কোনভাবেই দুধ ছাড়া অন্য কোন খাবার দেয়া যাবে না। অনেকেই বুকের দুধ পায় না বলে সুজি, চালের গুড়া, গরুর দুধ আর আধুনিক মায়েরা পিউরি, কিশমিশ, খেজুর, ওটস শুরু করে দেন। ( যেহেতু বাইরের অনেক দেশে চার মাসে উইনিং শুরু করতে বলে বা বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে কিছু আধুনিকা মা যুগের সাথে তাল মেলাতে ভুল করেন)
অধিকাংশ মায়ের অভিযোগ, বাচ্চা খিচুড়ি খেতে চায় না। এখানে বুঝতে হবে যে, আপনার বাচ্চা এতদিন বুকের দুধের মতো বর্ণহীন, পানসে তরল খেয়েছে, হুট করে একটা শক্ত খাবার নিতে ও বুঝতে তার সময় লাগবে। আপনাকে যদি এখন জাপানিজদের মতো সিদ্ধ আর কাচা মাছ, সবজি খেতে দেয়া হয় আপনি পারবেন? খেতে খেতেই একসময় অভ্যাস হয়ে গেলে কিন্তু ঠিকই খেতে পারবেন। সমস্যা হয় খিচুড়ি বানাতে গেলে মায়েরা চাল ডাল তেল লবণের সাথে হলুদ মরিচ, আদা রসুন, কয়েক রকম সবজি সব মিলিয়ে খিচুড়ি বানিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। বাচ্চা খাবে কেন?
বাচ্চার প্রথম খিচুড়ি হতে হবে বুকের দুধের কাছাকাছি কিছু, তাহলে চাল, ডাল, তেল দিয়ে জাউয়ের মত নরম একটা খাবার তৈরি করতে হবে যেটার ১ চামচ খেতে বাচ্চা ১ মাস সময় নিতে পারে, এই ধৈর্য্যটাও থাকতে হবে। আস্তে আস্তে এই খিচুড়ি অভ্যাস হয়ে গেলে তখন যে কোন দুই ধরনের সবজি একেকদিন একেক রকম (যেনো কোনোটাতে সমস্যা হলে বুঝা যায়) দিবেন। এরপর, মুরগির মাংস, মাছ, ডিম দেয়ার অভ্যাস করাবেন সময় নিয়ে। মোটামুটি ৭-৯ মাসের মধ্যে যতটা সম্ভব খাবার চেনাতে হবে নরম করে। এরপর দাঁত উঠার সময় হলে আস্তে আস্তে আরেকটু শক্ত করে খিচুড়ি বা ভাত বা রুটি দেয়ার অভ্যাস করতে হবে।
৬ থেকে ৯ মাস পর্যন্ত বাচ্চা বুকের দুধ আগে খাবে এর ফাঁকে ফাঁকে দিনে ৩ বার বাড়তি খাবার খাবে চাহিদা মতো, ১ চামচ হলে ১ চামচ, ১ বাটি হলে বাচ্চা খাওয়ার পর যা থাকবে তা ফেলে না দিয়ে মা খাবেন, এতে বুকের দুধ ভালো পাবে বাচ্চা। এরপর ৯ থেকে ১২ মাস পর্যন্ত, বাচ্চা দিনে ৫ বার বাড়তি খাবার খাবে প্রথমে, এরপর খিদে লাগলে বুকের দুধ খাবে। অনেকে ফর্মুলা দুধ, বুকের দুধ খাওয়ানোর পর বাড়তি খাবার চেষ্টা করে। ফলে দেখা যায়, খিদে না থাকায় বাচ্চা খেতে চায় না। মায়েরা বলেন, বাচ্চা খায় না। বাড়তি খাবারের পাশাপাশি পানি খাওয়ানো অভ্যাসও করাতে হবে। প্রতিদিন ২০০ মিলি থেকে বয়সভেদে ১ লিটার পর্যন্ত পানি প্রতিদিন খেতে হবে।
বাড়তি খাবারে যে ভুলগুলো করেন মায়েরা করেন সেদিকে যদি লক্ষ্য করা যায়, প্রথমেই সুজি, সেরেলাক, চালের গুড়া, চিনি, মিছরি, সাবু, ওটস এ ধরনের খাবার দিয়ে শুরু করলে পরে বাচ্চারা আর খিচুড়ি, ভাত ও অন্যান্য শক্ত খাবার খেতে চায় না। কারণ,ঐ খাবার গুলো সহজেই আরামে গিলে ফেলা যায়, কষ্ট করে চিবাতে হয় না। ফলে বাচ্চার মধ্যে শক্ত খাবার খাওয়ার অনীহা জন্মায়। আর এক বছরের নিচে চিনি জাতীয় খাবার দিতে নিষেধ করা হয়, ২ বছরের নিচে গরুর দুধ দিলে বাচ্চার এলার্জিসহ বদহজম, রক্তস্বল্পতা, কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।একই সমস্যা হয় খাবার ব্লেন্ড, পাটায় বেটে অথবা তরল করে খাওয়ালে। তাছাড়া এভাবে শরীরে দ্রুত হজম হয়ে যায়,পুষ্টি হয় না। পরবর্তীতে বাচ্চা আর শক্ত খাবার চিবিয়ে খেতে চায় না, বড় হয়েও তরল খাবারে অভ্যস্ত থাকে। দাঁত গজাতে দেরী হয়, অপুষ্টিতে ভুগে।
বেশির ভাগ মায়েরাই এক খাবার নিয়ে সারাদিন বাচ্চার পিছনে ছুটতে থাকেন। যেভাবেই হোক বাটির সব খাবার বাচ্চাকে গেলাতেই হবে। এতে করে খাবারটা যেমন হজম হয় না তেমনি বাচ্চারও খাবারের প্রতি বিরক্তি চলে আসে।যেকোনো খাবারই আধঘণ্টার মধ্যে বাচ্চা যতটুকু খাবে ততটুকুই খাওয়ানো উচিত। কারণ, খাদ্যনালী থেকে খাবার হজম হওয়ার জন্য যে এনজাইম ও হরমোন নিঃসৃত হয় তা আধঘণ্টা পর্যন্ত থাকে। এরপরের খাবার গুলো তাই আর হজম হয় না, আস্ত আস্ত হয়ে পায়খানায় বের হয়ে আসে অথবা গ্যাস হয়ে পেট ফাঁপায়।
আরেক সমস্যা ফল নিয়ে। ফরমালিন কার্বাইডের ভয়ে এমনিতেই ফল খেতে বলা আজকাল বিব্রতকর। তার উপর ইদানীং মায়েরা পিউরি জ্বরে ভুগছে। আপেল, টমেটো সিদ্ধ করে পিউরি করে খাওয়াবেন নাহলে আনার, মাল্টা, আঙ্গুর রস করে খাওয়াবেন। ১ম কথাই হচ্ছে সিদ্ধ করলে তার পুষ্টিগুণ কতটুকু থাকে? আর রস করলে পেটে গিয়ে যে গ্যাস হয় তার জন্যই তো পেট ফুলে বাচ্চার খাওয়া আরো কমে যায়।
প্রত্যেক মায়েরই স্বপ্ন, তার বাচ্চা বেশি বেশি খাবে এবং সারাদিন ঘন ঘন খাবে। তাহলে কেন তাকে এত আগ্রহ করে ওটস, সুজি, সেরেলাক, সাগু দিচ্ছেন? এই খাবারগুলো পেটে গিয়ে ফুলে দ্বিগুণ হয়, হজম হতে সময় লাগে, বাচ্চার খিদে লাগে কম যা আপনার কাম্য নয়। তাহলে? সব কিছুর এক সময় বা নিয়ম থাকা উচিত। বাচ্চাকে খাওয়ানোর বেলায়ও সেটা কম বেশি মানা উচিত। বাচ্চাকে একেক সময় একেক দিন যা মনে চায় খাবার দিলেন আর আশা করবেন বাচ্চা খিদে লাগলে আগ্রহ করে খাবে তা তো হয় না আসলে।
প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট খাবার খাওয়ালে একসময় দেখা যাবে, ঐ সময় খাবার না দিলে বাচ্চা নিজে খেকেই খেতে চাচ্ছে। এটাকে বায়োলজিক্যাল ক্লক বলে। রোজার সময় আমাদের যেমন দুপুরবেলা খাবারের সময় হলে পেট চিনচিন করে খাবারের জন্য। বাচ্চাকে কোথায় খাওয়াচ্ছেন, কিভাবে খাওয়াচ্ছেন এর উপরও বাচ্চার খাওয়ার আগ্রহ নির্ভর করে। বাচ্চাকে যদি কোলে নিয়ে ঘুরে ঘুরে, টিভি দেখিয়ে, মোবাইলে গান শুনিয়ে খাওয়ান তাহলে বাচ্চার আগ্রহ খাবারে না হয়ে গান বা টিভি বা অন্য কোন দিকে থাকে। ফলে খাবারের মজাটা বুঝে না।
একটা নির্দিষ্ট জায়গায়, বড় বাচ্চাদের বেলায় চেয়ার বা মোড়ায় বসিয়ে থালা বাটি গ্লাস সাজিয়ে খেতে দিলে ও নিজের হাতে খাওয়ার উৎসাহ দিলে বাচ্চা খাবারের মর্ম বুঝে। আবার ছোট বাচ্চার ক্ষেত্রে অনেক মা বাচ্চাকে শোয়ানো অবস্থায় ঠেসে ঠেসে চামচ দিয়ে খাওয়ান। এটা অবশ্যই মারাত্মক ভুল, কারণ এতে শ্বাসনালীতে খাবার ঢুকে যাওয়ার ভয় থাকে ও এতে বাচ্চা মারাও যেতে পারে।
সর্বোপরি, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন খাবারের পাশাপাশি মুখও পরিষ্কার থাকলে খাবারে রুচি আসে। বেশীর ভাগ মায়েরাই জানেন না যে, বাজারে ৬ মাস বয়সী বাচ্চারও ব্রাশ পাওয়া যায় মুখ ব্রাশ করার জন্য। দাঁত না থাকলেও দাঁতের মাড়ি ও জিহ্বা ব্রাশ করা জরুরি। নাহলে মুখে ময়লা জমে জিহ্বায় ঘা হয়, খাবারের স্বাদ না পাওয়ায় রুচি চলে যায় ও লালা পড়ে সারাক্ষণই। কাজেই, বাড়তি খাবার শুরু করার সময় অনেক কিছু বুঝে, ধৈর্য্য নিয়ে খাবার দিতে হয়। দিলেন আর বাচ্চা গপাগপ খেয়ে নিবে এমনটা আশা করা ঠিক নয়।
ধীরে ধীরে বাচ্চাকে খাবার চেনাতে হয় এবং এক চামচ খেলে যেন ঐটুকুই পুষ্টিকর হয় এটা নিশ্চিত করা জরুরি। সবচেয়ে ভালো সময় হচ্ছে, পরিবারের সবাই যখন খেতে বসে, বাচ্চাকে আলাদা চেয়ার, থালাবাটি দিয়ে পাশে বসাতে হবে। একটা দুটো ভাত চটকে জিহ্বায় ঘষে দিতে হবে, আস্তে আস্তে খাবারে আগ্রহ বাড়াতে হবে। সবাইকে খেতে দেখলে বাচ্চাও খাওয়ার আগ্রহ পাবে। এরপরও খাবার নিয়ে সমস্যা হলে, খাবারে কোনো এলার্জি বা খাওয়াতে সমস্যা থাকলে নিউট্রিশনিষ্টের কাছ থেকে খাবারের চার্ট নেওয়া যেতে পারে এবং ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া, পেটের নাড়িতে কোন সমস্যা আছে কিনা সে বিষয়ে নিজেদের অবগত থাকা।