নিরাপদ হোক শিশুর ভবিষ্যৎ
নিদ্রাচ্ছন্নভাবে হেলে পড়তে না পড়তেই অনাকাঙ্ক্ষিত শোরগোলে জেগে উঠলাম। বেরিয়ে এসে ঘটনা পর্যবেক্ষণে বুঝলাম পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া একটি শিশুকে মোবাইল গেম খেলতে না দেওয়ায় বাড়ির তৈজসপত্র ভাঙচুর করেছে। সেটি নিয়েই তাকে বকাঝকা করছিল তার বাবা-মা। আজকের সামাজিক প্রেক্ষাপটে অস্বীকার করার জোঁ নেই, মোবাইল গেম আসক্তি ছোট্ট ছোট্ট শিশু থেকে তরুণ প্রজন্মের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। যে বয়সে একটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা অর্জনে খেলাধুলা কিংবা শারীরিক কসরতে ব্যস্ত থাকার কথা; কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় সেই বয়সের একটি শিশু আজকাল ইন্টারনেট কিংবা মোবাইল গেমে নিমগ্ন থাকে।
আজকাল কোন রেস্টুরেন্ট, দাওয়াতের জায়গা কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডারত অবস্থাতেও শিশু-কিশোরদের গেম আসক্তি যেন পিছু টানে না। বর্তমানে পৃথিবীতে ২২০ কোটি মানুষ ভিডিও গেম খেলে। যাদের অধিকাংশই শিশু-কিশোর। যার বদৌলতে গ্লোবাল ভিডিও গেম বাজারের আর্থিক মূল্য দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০৯ মিলিয়ন ডলার। প্রতিবছর স্মার্টফোন ও ট্যাবলেট গেমিং ১৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে পাবজি অর্থাৎ প্লেয়ার্স আননোন ব্যাটেল গ্রাউন্ড নামের একটি অনলাইন গেম তরুণ প্রজন্মের নিকট অতি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন এ গেম খেলে ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ । পাবজির মতো শুধুমাত্র অনলাইন গেম নয় বরং টেম্পল রান, সাবওয়ে সারফারস, ব্যাডল্যান্ড, ফ্রুট নিনজা, লিম্বো, মাইনক্রাফ্ট পকেট এডিশন, ওয়ার্ল্ড অব গু এবং স্ম্যাশ হিটসহ বিভিন্ন অফলাইনভিত্তিক গেম আজ শিশুদের জনপ্রিয়তার শীর্ষে। আমরা যে প্রজন্ম পেরিয়ে এসেছি সে সময় শিশু-কিশোরদের হাতে স্মার্টফোন ছিল না বললেই চলে কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের প্রায় প্রতিটি শিশু-কিশোররা স্মার্টফোনের ছোঁয়া পাচ্ছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বিটিআরসির তথ্যমতে- দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বর্তমানে রেকর্ড পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ কোটি ৬৪ লাখ ১০ হাজার। ২০১৬ সালের তথ্যমতে ব্যবহারকারীদের ৩৫ শতাংশ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা। এ সংখ্যা যে নেহাতেই বেড়ে গেছে তা সহজেই অনুমেয়।
ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের মাঝে গেমিং আসক্তি বেড়ে যাওয়ার প্রভাবশালী কারণ আজকালকার অভিভাবকরা সন্তানকে শান্ত রাখতে মুঠোফোনসহ বিভিন্ন ইলেট্রনিক যন্ত্রপাতি তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। অনেক সময় নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে সন্তানকে নিজের চোখের সামনে রাখতে মুঠোফোন কিংবা ল্যাপটপ তুলে দিয়ে আপাতত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে অভিভাবকরা। অনেকে কর্মস্থলে ব্যস্ততার দরুনও শিশুকে সময় দিতে না পেরে স্মার্টফোন কিংবা ল্যাপটপ তুলে দিয়ে থাকেন। কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি না এই সাময়িক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে গিয়ে ভবিষ্যৎ এ না জানি অস্বস্তিকর নিঃশ্বাসে ভুগতে হয় আমাদের।
আজকাল অনেক পরিবারে এমনও শিশু রয়েছে যাদের মোবাইল গেম খেলতে না দিলে পড়াশোনা করতে চায় না, খাবার খেতে চায় না, রাগারাগি করে, বাবা-মার কথা শোনে না। একসময় শহরাঞ্চলের শিশুদের মাঝে গেমিং আসক্তি বিদ্যমান থাকলেও শুধু শহরাঞ্চল নয় এখন গ্রামীণ পর্যায়ের শিশুদের মাঝেও এ বিষফোঁড়া জন্মলাভ করেছে। কেননা শহরাঞ্চলে বাবা-মার কর্মস্থলে ব্যস্ততার দরুন অভিভাবকরা শিশুদের হাতে তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়া দিত। আমাদের গ্রামীণ নারীরা পূর্বে শুধুমাত্র সন্তান লালন-পালন ও ঘরের কাজেই লিপ্ত ছিল। কিন্তু বিশ্বায়নের সাথে তাল মিলিয়ে আজ গ্রামীণ নারীরাও দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, নিযুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্রে। যার ফলে এখনকার মায়েরা পূর্বেকার মায়েদের মতো শিশুদের সময় দেওয়া কিংবা দেখাশুনা করা কমে এসেছে। ফলে অনেক বাবা-মা-ই সন্তানের হাতে তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়া দিচ্ছেন।
তাছাড়া গ্রামীণ পর্যায়ে প্রযুক্তির সহজলভ্যতার দরুন আধুনিক সেবা পৌঁছে যাওয়ার গ্রামীণ সমাজের ছোট্ট ছোট্ট শিশুরাও স্মার্টফোনের আওতায় এসে ইন্টারনেট বা গেমিং আসক্তিতে জড়িয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক করোনার প্রেক্ষাপটেই আমরা দেখতে পাচ্ছি- ছ'মাসে পূর্বেও যে শিশু-কিশোরদের হাতে স্মার্টফোনের দেখা মেলা ছিল ভার, আজ তার হাতে রয়েছে চকচকে নতুন একটি স্মার্টফোন। এটি যে শিশুরা শুধুমাত্র অনলাইন ক্লাসে ব্যবহার করছে তা নয় বরং অবসরের দীর্ঘকায় সময়গুলোতে ইউটিউবে বিভিন্ন ভিডিও কিংবা মোবাইল গেম খেলে সময় কাটাচ্ছে ।
গেম কোন নিষিদ্ধ বিষয় নয় তবে এর অপরিমিত ব্যবহার শিশু-কিশোরদের চিন্তা ও আচরণের ওপর মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলে। বিশেষজ্ঞরা বলেন- মোবাইল বা কম্পিউটার গেমের প্রতি আকর্ষণ একটি আসক্তিমূলক আচরণ। এর অর্থ দিনকে দিন আরও বেশি গেম খেলতে চাইবে। আর শিশুমন স্বভাবতই কৌতুহলপ্রবণ তাই ভুলক্রমে একবার তাদের হাতে ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি কিংবা লোভনীয় গেম তুলে দিলে সহজে ছাড়ার পাত্র তারা নয় । গবেষকরা দেখিয়েছেন-স্মার্টফোন বা গেমিং আসক্তির কারণে মানুষের আবেগ কমে যায়, রাগ ও হতাশা বৃদ্ধি পায়, সৃষ্টি হয় অনিদ্রার। গেমের প্রতি আসক্তি শিশুর কর্মদক্ষতা ও সৃজনশীলতা হ্রাসের পাশাপাশি সৃষ্টি করে দৈহিক ও মানসিক সমস্যার। সুতরাং একে হালকা করে দেখার কোন সুযোগ নেই।
একটি শিশুর নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়তে অভিভাবকবৃন্দের এ বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি। গেমিং আসক্তি একটি মানসিক রোগ। এটি অন্যান্য নেশাজাত দ্রবের ( ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা, মদ ইত্যাদি) আসক্তির মতোই। পার্থক্য হলো একটি আচরণগত আসক্তি অপরটি নেশাজাত দ্রব্যের আসক্তি। তাই আপনার সন্তান এতে মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি হয়ে পড়লে দ্রুত কোন সাইকোলজিস্টটের সাহায্য নিন। আপনার ছোট্ট বাচ্চাটি যেন স্মার্টফোনের নাগাল না পায় সেদিকে নজর রাখুন । ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য অনুপযোগী হলে সন্তানের হাতে স্মার্টফোন তুলে দিবেন না। একান্তই যদি ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দেন সেক্ষেত্রে সময়সীমা বেঁধে দিন, তার সঙ্গে চুক্তিতে আসুন।
বাসার কম্পিউটার কিংবা স্মার্টফোনটি সন্তান যেন আপনার সামনেই ব্যবহার করে সেদিকে লক্ষ রাখুন। সময় করে শিশুকে নিয়ে বিভিন্ন পার্ক বা কোথাও বেড়াতে যান। খেলার মাঠের প্রতি তাদের উৎসাহ দিন। ছবি আঁকাসহ বিভিন্ন সৃষ্টিশীল কর্মের প্রতি শিশুদের মনোযোগী করান । ছোট্ট বেলা থেকেই শিশুর হাতে স্মার্টফোনের পরিবর্তে বিভিন্ন গল্প বা উপন্যাসের বই তুলে দিন। শিশুদের মাঝে বেশি বেশি বই পড়ার অভ্যাস যেন গড়ে ওঠে তার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করুন। এতে করে একদিকে যেমন আপনার সন্তান ইন্টারনেট কিংবা গেমিং আসক্তির মতো মানসিক রোগ থেকে রক্ষা পাবে অপরদিকে আপনার সন্তানের মানসিকতা, সৃজনশীলতা, মেধা ও মননশীলতাও বৃদ্ধি পাবে। আসুন, সচেতনতার মাধ্যমেই একটি শিশুর সুন্দর ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলি । সুকান্ত ভট্টাচার্যের সেই অমোঘ বাণী আপনিও দীপ্তকন্ঠে বলুন- এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি/নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।