বীথির ‘উইমেন্স ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমি’
নারীরা ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে বাহিরে বের হতে পারত না- সেই সময় অতীত হয়েছে। সময় এখন পাল্টেছে। এখন সময় সেই নারীদেরও। নারী এখন কৃষি মাঠ থেকে আকাশে পর্যন্ত ডানা মেলে উড়তে শিখেছে। নেতৃত্ব, বিজ্ঞান, খেলাধুলা, আবিষ্কার, বিপ্লব, বিদ্রোহ, রাজপথ, এমনকি আকাশও পাড়ি দিচ্ছে অকুতোভয় সৈনিকের মতো। দায়িত্ব নিয়ে। তেমনই এক অনন্যা আরিফা জাহান বীথি। ২৩ বছর বয়সী এই তরুণী সাবেক নারী ক্রিকেটারও। নিজ জন্মস্থান রংপুরে নিজের জমানো টাকা ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় গড়ে তুলেছেন 'উইমেন্স ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমি’। যা দেশের প্রথম নারী ক্রিকেট একাডেমিও বটে। দুইশত পাশজন অদম্য স্বপ্নবাজ তরুণীকে কোন ধরনের ফি ছাড়াই ক্রিকেট প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এই নারীর ক্রিকেট একাডেমি। এই একাডেমির ৮ জন তরুণী বিকেএসপি’তে খেলছেন। অদম্য তরুণী বীথির সংগ্রামী জীবনের আঁকাবাঁকা পথের কথা লিখেছেন – অরণ্য সৌরভ
রংপুর নগরীর নুরপুরে বেড়ে উঠা অদম্য এই তরুণী চার ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয়। শৈশব-কৈশোরেই দারিদ্রের সাথে লড়াই শুরু করেন তিনি। তার শৈশবেই বাবা স্বল্প বেতনের চাকরিটা হারায়। ফলে অভাব-অনটনের সংসারে নেমে আসে অশান্তির কালো ছায়া। অশান্তির মেঘ ভারী হতে থাকে পরিবারে। মা ও বড় বোনের কারণে আত্মহত্যার পথ থেকে নিজেকে সরিয়ে আনেন বীথি। বুকের ভেতর হতাশা ও দুঃখকে মাটিচাপা দিয়ে শুরু করে বেঁচে থাকার লড়াই। জীবন সংগ্রামে মায়ের সঙ্গে যোগ দেন স্কুল পড়ুয়া বীথি। বাড়ির সামনে মুদি দোকান শুরু করেন মা ও মেয়ে। এভাবে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে যায় বীথির। বড় ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকা বীথি স্থানীয় এক কোচের অধীনে শুরু করেন ক্রিকেট প্রশিক্ষণ।
বীথির নিজের ভেতর জেদ চেপে বসেছিল। জেদ ছিল পরিবারে সচ্ছলতা ফেরানোর। বীথির মতে, সেদিন যদি আত্মহত্যা করতাম তাহলে আজ আর ক্রিকেটার বীথি হয়ে উঠা হতো না। হতাশায় নিমজ্জিত তরুণদের উদ্দেশ্যে বীথির বার্তা হল, হতাশায় আত্মহত্যার মতো পথে না গিয়ে জীবনের শেষ থেকেই আবার শুরু করা উচিৎ। কারণ তিনি মনে করেন, শেষ থেকে শুরুই সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে দিতে বিরাট ভূমিকা রাখে।
নারী হয়ে ক্রিকেটে আসার গল্পটা একটু বেদনাদায়ক ছিল ক্রিকেটার আরিফা জাহান বীথির। তিনি বিশ্বাস করেন যারা এই বেদনাটুকু মেনে নিতে পারেন তারাই সফল হন। মেয়ে হয়ে ক্রিকেট খেলায় পরিবার থেকে শুরু করে পাড়া-প্রতিবেশীর অনেকের কাছেই অনেক সময় বিভিন্ন কটু কথা শুনতে হয়েছে। এমনকি এখনো শুনতে হয়। কোন মেয়ে যেন ক্রিকেটে আসতে বাঁধা বিপত্তির শিকার হতে না হয় সেই কথা বিবেচনা করেই বীথির একাডেমি শুরু করার উদ্যোগ।
আরিফা জাহান বীথির ভাষ্য, অনেক মেয়েই ক্রিকেটে আসে না ছেলেদের সাথে অনুশীলন করতে হয় বলে। কিন্তু তাদের স্বপ্ন ক্রিকেটার হবার। এছাড়া অর্থ সংকট বা অর্থের অভাবেও অনেকেই ক্রিকেট অনুশীলন করতে পারেনা; সেইসব কথা বিবেচনা করেই বিনামূল্যে অনুশীলন করানোর উদ্দেশ্যেই একাডেমির যাত্রা শুরু করি।
তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাঠ শেষ করে ডিগ্রিতে পড়ছেন রংপুর বেগম রোকেয়া কলেজে। সালেমা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ার সময় ক্রিকেটের সাথে জড়িয়ে পরেন আরিফা জাহান বীথি, এরপর ভালোবাসা আর ভালোলাগা দুই’ই গড়ে উঠে ক্রিকেটের প্রতি। স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ক্রিকেটে ভালো পারফরম্যান্স করায় জেলা পর্যায়ে খেলার সুযোগ পান। ২০১০ সালে পেশাদার লিগ খেলা শুরু করেন বীথি। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ, ওরিয়েন্ট স্পোর্টিং ক্লাব, ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট একাডেমিতে ফার্স্ট ডিভিশন খেলেছেন বীথি। কিন্তু ২০১৭ সালে হঠাৎ করেই ক্রিকেট ক্যারিয়ারে আসে বড় ধাক্কা। ঢাকা ফার্স্ট ডিভিশনের এক ম্যাচ চলাকালীন নাক দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে বীথির। ডাক্তার সব পরীক্ষা করে বলেন নাকে ইনফেকশন হয়েছে। ক্রিকেট খেলা না ছাড়লে বীথির ৮০ শতাংশ ক্যান্সার হওয়ার শঙ্কা রয়েছে- এমনটিই জানিয়েছিলেন চিকিৎসক। তাই ২২ গজের পিচে ব্যাটিং করা বীথির ক্রিকেট জীবনের আলো ম্লান হয়ে আসে।
কিন্তু যার রক্তকণিকায় ক্রিকেট উন্মাদনা, সে তো থেমে যাওয়ার পাত্র নন। প্রশিক্ষক হিসেবে আবারও সবুজ ঘাসে পা রাখেন অদম্য এই তরুণী। মাঠের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি নারী ক্রিকেট একাডেমি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এ লক্ষ্যে রংপুর নগরীর প্রায় ৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ক্রিকেট প্রশিক্ষণে আগ্রহীদের খুঁজে বের করেন। পেয়ে যান প্রশিক্ষণার্থী। ২০১৯ সালের ২৬ অক্টোবর তার একাডেমি আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। ক্রিকেট কোচিং ও আউটসোর্সিং করে জমানো ১০ হাজার টাকা ব্যয় হয়ে যায়। তারপর মাকে জানালে, এনজিও থেকে মেয়েকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে দেন তিনি। সেই টাকায় প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য ক্রিকেট খেলার সামগ্রী এবং উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।
ছেলেদের সাথে ব্যাটে-বলে অনুশীলন করবে, তেমনটা পরিবার ও সমাজ ভালো চোখে দেখবে না। এমনকি একজন নারীর ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নও পূরণ হবে না। এছাড়াও অর্থ সংকটের কারণে স্বপ্ন থাকা সত্ত্বেও অনেক নারী ক্রিকেটে আসতে পারবে না- এমন কিছু বিষয় মাথায় রেখে কোন নারী যেন ক্রিকেট থেকে দূরে সরে না যায় সেজন্য জয়িতা বীথি বিনামূল্যে একাডেমিতে অনুশীলন করিয়ে যাচ্ছেন।
ক্রিকেটে আসার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান স্কুলের। স্কুলের শিক্ষক ও বাবা মায়েরা সমর্থন না দিলে হয়ত এতো দূর আসা হতো না বলে মনে করেন বীথি।
একাডেমি প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে বীথি বলেন, সামান্য অর্থ বা পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে শত শত সম্ভাবনাময় নারী আজ তাদের জীবনের নানান স্বপ্ন পূরণ করার সুযোগ থেকে বি ত। একাডেমির মূল লক্ষ্য হল সামান্য অর্থ, পৃষ্ঠপোষকতা বা সহযোগিতার অভাবে যাতে আগামীর সালমা, জাহানারা কিংবা সানজিদা, রুমানাদের হারিয়ে না ফেলি, সেই উদ্দেশে একাডেমি করার উদ্যোগ নিয়েছি। একই সঙ্গে শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী মেয়েদের জন্যও ক্রিকেট খেলার প্রশিক্ষণ প্রদান করা এবং সমাজের মূল স্রোতধারায় মিশতে তাদের সহযোগিতা করা।
আইনজীবী হয়ে অসহায় মানুষের তরে কাজ করার ইচ্ছা থাকলেও, অবশেষে ক্রিকেটার হয়েই মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন বীথি। ক্রিকেটের বাইরেও অসহায় মানুষের জন্যে কাজ করে যাচ্ছেন এই অনন্যা।
ক্রিকেটের বাইরেও বীথি মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। অসহায়, দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। তিনি অসহায়, কর্মহীন ও গর্ভবতী মানুষদের পাশে খাবার নিয়ে দাঁড়ান। মেয়েদের স্যানিটারি ন্যাপকিন দেওয়া, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়া, কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদেরকে উপবৃত্তি দেওয়া, কোরবানির ঈদে অসহায়দের ঘরে মাংস পৌঁছে দেওয়া, সিকিউরিটি গার্ডদের রান্না করে খাবার দেওয়া, বৃদ্ধ মায়েদের ঘর তৈরি করে দেওয়া, বিধবা-তালাকপ্রাপ্তা নারীদের স্বাবলম্বী করার জন্য সেলাই মেশিন দেওয়াসহ নানানভাবে মানবিক মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে।
বীথি বলেন, এখন মেয়েরা সবক্ষেত্রে এগিয়ে। তারা চাইলে অনেক কিছুই করতে পারে। মেয়েদের এগিয়ে নিয়ে যেতে সব সময় কাজ করে যাব।
বীথির স্বপ্ন উইমেন্স ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমি নারীদের ক্রিকেট শেখার পাশাপাশি সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে সাহায্য করবে। এছাড়া আগামী পাঁচ বছরে তার একাডেমি থেকে কমপক্ষে পাঁচজন জাতীয় দলের ক্রিকেটার হয়ে দেশের হয়ে খেলবে এমনটাই তার প্রত্যাশা।