কিশোরী মুক্তিযোদ্ধা: বীরপ্রতীক তারামন বিবি
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে এই বাংলাদেশ। প্রিয় জন্মভূমিকে শুত্রুমুক্ত করতে জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন অনেক নারী-পুরুষ। লড়াই করেছেন অসংখ্য বীর বাঙালি নারী৷
তবে তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে ত্যাগী ও দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়েছেন যাঁরা তাঁদের মধ্যে একজন হলেন তারামন বিবি বীরপ্রতীক৷ সরকারিভাবে খেতাবপ্রাপ্ত দুইজন নারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তিনি একজন। মুক্তিযুদ্ধের পর তার অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীরপ্রতীক খতাবে ভূষিত করে।
তারামন বিবির আসল নাম তারা বানু। যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে স্নেহভরে তারামন বলে ডাকতেন। পরবর্তীতে তিনি তারামন নামেই পরিচিত হন। তারামন বিবির জন্ম ১৯৫৭ সালে কুড়িগ্রাম জেলার রাজীবপুর উপজেলার কোদালকাটি ইউনিয়নের শংকর মাধবপুর গ্রামে৷ তাঁর বাবার নাম আবদুস সোবাহান এবং মা কুলসুম বেওয়া৷ বাবা-মায়ের সাত সন্তানের মধ্যে তৃতীয় সন্তান ছিলেন তারা বানু। অভাবের কারণে শৈশবে লেখাপড়ার সুযোগ পাননি তিনি। পরিবারকে আর্থিক সহায়তা করতে তিনি মানুষের বাড়িতে কাজ করতেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিলো ১৪ বছর। মুক্তিযুদ্ধে তিনি ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেছেন।
মুহিব হালদার নামক এক মুক্তিযোদ্ধার মাধ্যমেই যুদ্ধে প্রবেশ তারামন বিবির। মুহিব হালদার ছিলেন তাঁর গ্রামের পাশের একটি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের দায়িত্বে। তিনি তারামনকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কাজ করার জন্য উৎসাহ দেন। তিনি তারামনকে তাঁদের ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্নাবান্নার প্রস্তাব দেন। কিন্তু তারামনের মা এতে রাজি হননা। পরবর্তীতে মুহিব হালদার তারামনকে ধর্মমেয়ে হিসেবে গ্রহণ করেন। এরপর তাঁর মা তাঁকে ক্যাম্পে কাজ করার অনুমুতি দেন। তারামন দশঘরিয়ায় মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে রান্নাবান্নার কাজে যোগ দেন। সাহসিকতা, শক্তি ও মনোবলের জন্য তাঁকে অস্ত্র চালানো শেখানো হয়। এরপর থেকে তিনি সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিতে থাকেন।
পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি প্রথম অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন ’৭১ এর শ্রাবণ মাসের এক দুপুরে। সবাই খেতে বসেছে। হঠাৎ করেই পাকসেনারা বোট নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে আক্রমণ করে বসে। তারামন তা সুপারি গাছে উঠে দূরবীন দিয়ে আগেই দেখে মুক্তিযোদ্ধাদের সে সম্পর্কে অবগত করেছিলেন।
মুক্তিযোদ্ধারা খাওয়া বন্ধ করে প্রস্তুতি নেয়। শুরু হয় তাদের যুদ্ধ। সেই সময় অনেকটা আকস্মিকভাবেই তারামন অস্ত্র হাতে নেন। যুদ্ধ করেন পাক বাহিনীর সাথে। সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে৷ তারা পরাস্ত করেন পাক বাহিনীকে। এরপর থেকেই তারামন নিয়মিত অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। বারবার সাহসিকতার সাথে সফল হয়ে ফিরেছেন তিনি।
রান্নাবান্না ও সম্মুখ যুদ্ধের পাশাপাশি তিনি গুপ্তচরের কাজও করেছেন। ভিন্ন ভিন্ন বেশ নিয়ে তিনি পাক বাহিনীর শিবিরে গিয়েছেন তাদের তৎপরতা এবং অবস্থান জানার জন্য। কখনও সারা শরীরে কাদা, মাটি, চক, কালি মেখে পাগলের বেশ ধরে অপারেশনগুলো করেছেন তারামন৷
চুল এলোমেলো করে, বোবা সেজে পাক সেনাদের সামনে দীর্ঘ হাসি কিংবা কান্নার অভিনয় করেছেন৷ কখনও আবার প্রতিবন্ধী কিংবা পঙ্গুর বেশ ধারণ করেছেন। কখনো ভেলা নিয়ে কখনও পাড়ি দিয়েছেন ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী আবার কখনো বা সাঁতরেই পার হয়েছেন নদী। অসাধারণ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন এই বীর নারী।
যুদ্ধের পর থেকে তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসামান্য অবদানের কারণে ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার তাঁকে ‘বীরপ্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে। কিন্তু তিনি সে ব্যাপারে অবগত ছিলেননা। দীর্ঘ ২৫ বছর পর ১৯৯৫ সালে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়। ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বিমল কান্তি দে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান আলী এবং রাজিবপুর কলেজের সহকারী অধ্যাপক আব্দুস সবুর ফারুকীর সহায়তায় তাঁকে খুঁজে বের করেন।
ঢাকায় নিয়ে আসে। ১৯৯৫ সালের ১৯ ডিসেম্বরে তৎকালীন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তারামন বিবিকে বীরত্বের পুরস্কার খেতাব ও পদক তার হাতে তুলে দেন। ২০১৮ সালে ১ ডিসেম্বরে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ৬২ বছর বয়সে নিজ বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। রাষ্ট্রীয় মর্যাদার সাথে তাঁকে রাজিবপুর উপজেলায় কাচারীপাড়া তালতলা কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়।
ইতিহাসের পাতায় তারামন বিবি এক সাহসের নাম। তাঁদের মতো সাহসীদের কারনেই আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। তাঁদের প্রতি আমরা গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি।