শালীনতা-অশালীনতা বোধের ব্যাপার
“Humans are essentially memetic creature” – এরিস্টটল তাঁর বিখ্যাত পোয়েটিক্সে যখন এই সামান্য কথাটি ঘোষণা করেন, তখনও হয়তো অনেকে বুঝতেই পারেনি কথাটির অর্থ। সত্য এবং মিথ্যা, আলো এবং অন্ধকার এই চারটি বিষয়ের আলোকেই চলে আসে শালীনতা ও অশালীনতা। পৃথিবীতে কিছুই নিরপেক্ষ নয়, সবকিছুই আপেক্ষিক। দৃষ্টিভঙ্গিই অনেক সময় অনেক কিছু নির্ধারণ করে দেয়। যে ব্যক্তি বলেছিলেন “ভবিষ্যৎ নিয়ে না ভেবে বর্তমানকে নিয়ে ভাবো” – তার উক্তি যেমন সত্য, তেমনি “ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবাই জ্ঞানীর কাজও অনেকটাই সত্য।"
কিন্তু এখানে ভবিষ্যৎ কিংবা বর্তমান নিয়ে আলোচনা মুল বিষয়বস্তু নয় আলোচনা মূলত শালীনতা এবং অশালীনতা নিয়ে। আর এই পুরো বিষয়টাকে কখনই আমরা নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করতে পারবো না। বিজ্ঞানের কথামতোই, পৃথিবীর সবকিছুই আপেক্ষিক। শালীনতা আর অশালীনতার ব্যাপারও অনেকটাই আপেক্ষিক। এই গেলো বছর অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের শাড়ি নিয়ে একটি বক্তব্য বেশ হইচই ফেলে দিয়েছিলো। সেই আলোচনাতে এখন যাবোনা।
আসলে দৃষ্টিভঙ্গিই শালীনতা এবং অশালীনতার পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। তবে আপাতদৃষ্টিতে শালীনতা বলতে একজন ব্যক্তির সার্বিক উপস্থাপনা এবং আচরণকেই বোঝায়। কিন্তু এক দেশের বুলি অন্য দেশের গালির মতোই শালীনতাও রূপ বদলাতে পারে। উপমহাদেশের কোনো ব্যক্তির বাড়িতে কেউ যদি উপহার হিসেবে এক বোতল মদ নিয়ে যায় তাহলে আর দেখতে হবেনা।
তবে সময়ের নিরিখে আমরা শালীনতা বলতে পোশাক–পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস এবং চলাফেরার ধরনকেই বুঝি। ইংরেজি কায়দায় যাকে অনেকে বলে ম্যানার। তাই সামান্য দুটো শব্দের মধ্যে যে ভয়ংকর জটিলতা লুকিয়ে আছে, সেগুলো শব্দ প্রকাশ করা অনেকটাই কঠিন হয়ে উঠে।
প্রতিটি সমাজের রয়েছে নিজস্ব প্রথা, জীবন–যাপনের ধরণ। কখনো কখনো সেসবের আদান প্রদান ঘটে। আবার কখনো একটি সমাজের সংস্কৃতি অন্য সমাজকে পরিবর্তন করে দিতে পারে। একটি উন্নত বা প্রভাবশালী সভ্যতা তার অনুগত সভ্যতাকে প্রভাবিত করে। জীবনধারার পরিবর্তনের সাথে সাথে শালীন–অশালীনের পরিবর্তন ঘটে।
হাজার বছর আগেই তখনো বাংলা ভাষাকে আমরা ঠিক বাংলা বলতে পারতাম না। যখন সেটি গৌড়ীয় প্রাকৃত রূপে আত্মপ্রকাশ করে, তখনো অনেকেই একে অশালীন ভাষা হিসেবে দাবি করে। এমনকি আঠারো শতকেও সাধু ভাষাকে লেখার একমাত্র শালীন রূপ হিসেবে ব্যবহারের চিন্তারও অনেক পরিবর্তন এসেছে।
পরিবর্তন এসেছে মানুষের কথার ভঙ্গিমায়, পোষাকে এবং চলনে। কিন্তু সমাজ শালীন ও অশালীনতার পার্থক্যের জন্যে পোশাককেই সাধারণত দায়ী করে এসেছে। বর্তমান সময়ে পোশাকই বিভিন্ন সমাজে শালীনতার পার্থক্য গড়ে দেয়। সমাজের প্রতিটি মানুষ আত্মবাদী এবং তারা সাব্জেক্টিভিটির প্রভাবে অন্যদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। যার ফলে অনেক সময় একই পোশাক কারো কাছে শালীন এবং কারো কাছে অশালীন বলে ঠেকে।
শালীনতার কিংবা অশালীনতার পার্থক্যকে মোটেও অপরাধ বলা যায় না বরং একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের প্রেক্ষিতে বেমানান জিনিসগুলোকে রুচিহীন বলা যায়। যার ফলে সমাজের মধ্যকার অপরাধগুলোর ক্ষেত্রেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে। যুক্তি দিয়ে বিচার করতে করতে গেলে আমরা কখনই সহজ সমাধানে পৌঁছুতে পারিনা।
এই গেলো বছর অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের শাড়ি নিয়ে একটি উক্তি গণমাধ্যমে বেশ হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলো। তিনি দাবী করেছিলেন শাড়ি একটি যৌনাবেদনপূর্ণ পোশাক। বহুদিন পর এই কথাটি আমার মনে পড়লো। যতটুকু মনে হয়, একটি মানবশরীরের কোনো অংশকেই আমরা অনাকাঙ্ক্ষিত দাবি করতে পারিনা। তবে যৌনতার সাথে সম্পৃক্ত অংশগুলোকে যতটুকু সম্ভব আবৃত করে রাখাটাই শালীনতা।
এই শালীনতা কিংবা ঢেকে রাখার বিষয়টা অবশ্যই নির্দিষ্ট অঞ্চল ও সংস্কৃতিভিত্তিক। কিন্তু অনেক সময় সৌন্দর্য অসৌন্দর্য্যবোধটা একজন ব্যক্তির নিজের কাছে। বিশাল একটি মনের কথা টেনে আনা যেতে পারেই। কিন্তু পুরোটাই ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। শালীন ও অশালীনতা সময়ের পরতে পরিবর্তিত হতে শুরু করে। এখন মানুষ বেশ খুশিমনেই জ্যাজ কিংবা র্যাপ সং শুনে থাকে। সময় আস্তে আস্তে বদলাবে। কিন্তু যে অশালীনতা অপরাধ এবং সমাজের মধ্যে ক্রমশ অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। নাহলে, ভুক্তভোগী অশালীন তাই অপরাধ করেছি এরকম কথা দিয়েই নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা শুরু হবে।
বিশেষত নারীরা শালীনতা ও অশালীনতা তর্কের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। দেশে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ কিংবা গুরুতর অপরাধগুলো সংগঠিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলাতে হবে। কোনো বস্তুকে অশালীন না ভেবে দৃষ্টিকে নিয়ে ভাবা উচিত। কারণ পোশাক কিংবা কারো দৈহিক রেখাকে অশালীন ভাবার আগে নিজের দৃষ্টিটাও কি অশ্লীল কিনা তা খতিয়ে দেখার সময় এসেছে।