মৃত্যুদন্ডেই কি স্বস্তি মিলছে আমাদের?
ধর্ষণ একটি জটিল সমস্যা। হাস্যকর হলেও মনে হয়, এই বছর ধর্ষণের খবরও কোয়ারেন্টাইনে চলে গিয়েছিলো। কিন্তু না, তেমন কিছু হয়নি। ধর্ষণের বিরুদ্ধে এর আগেও বহুবার আন্দোলন হয়েছে। দেশ উত্তাল হয়ে উঠেছিলো বহুবার। সেসব নামের উদাহরণ টানতে টানতে ক্লান্ত হয়েছে মন। দিনশেষে আমরা স্ক্রল করেছি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। আর যেমনটা ভেবেছিলাম, ধর্ষকরাও হয়তো কোয়ারেন্টাইনে যায়নি। সেই খবরই যেন বারবার পত্রিকার কালো অক্ষরে, টেলিভিশনের ক্ষুদ্র পর্দা আর শিরোনামে এসেছে। সেই উদাহরণগুলোও টানতে এখন ভীষণ বিরক্ত লাগে। ক্লান্তি আর অবসাদে মন ভরে যায়।
ধর্ষণের কারণ নিয়ে বহু অভিমত আছে। সেসব নিয়ে আমার আলোচনা নয়। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড বলে কতক দিন পরই রায় দেয়া হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বহু মানুষের আক্ষেপ ছিলো ধর্ষণের শাস্তি বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম হলেও, বাংলাদেশে তেমন শাস্তি নেই। ধর্ষণের মতো জটিল একটি বিষয়ের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের পক্ষেই সকলের অবস্থান। নৈতিক দৃষ্টিকোণে আমিও সেই স্থানেই অবস্থান করছি। কিন্তু এটি সামান্য একটি রায় মাত্র। বাস্তবতা আমাদের কি বলে?
ধর্ষণের মতো সমস্যার পেছনে সংস্কৃতির বিরাট প্রভাব আছে। একটা সময় ধর্ষণের জন্যে নারীকেই দায়ী করা হতো, এখনো করা হয়। নারীকে অবশ্যই একজন পুরুষ অভিভাবকের অধীনে থাকতে হবে এমন ভাবনাটাই প্রচলিত হয়ে আসছিলো। আবার কেউ কেউ সেই অভিভাবকত্বের দায়টুকু নিজের ঘাড়েই নিতে পারতো। এরা জানে যে সেই নারীকে সে কিছু করলে ক্ষমতার জোরে পার পাওয়া যাবে। এভাবে রাজনৈতিক মদতপুষ্টতা, সামাজিক ভাবনা এবং নারীর অর্থনৈতিক শৃঙ্খলতাকে অনেকদিন পর্যন্ত করে রেখেছে গৃহবন্দি।
ধর্ষণ রয়ে গেছে সামান্য বিচ্ছিন্ন ঘটনা। গণমাধ্যমের সক্রিয়তা আমাদের সামনে ধীরে ধীরে এই ধর্ষণের ঘটনাগুলো তুলে এনেছে। আমরা শুধু নির্ধারন করেছি ধর্ষক এবং ধর্ষিতাকে। আমরা এখনো ভাবছি ধর্ষককে নিয়ে। আমরা ধর্ষণের প্রভাবকগুলো দমানোর জন্যে আইন করার কথা কখনো ভেবে দেখেছি?
একজন ধর্ষকের শাস্তি হবে মৃ্ত্যুদন্ড। তাতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশ কি আছে? আমি বলছিনা এই রায় বাজে বরং অনেকাংশে নিরর্থক। অনেকেই ভেবে বসবেন এবং তর্ক জুড়ে বসবেন, ‘এই যে রায় দিয়েছে তাতেও মন ভরেনা? বসতে দিলে খেতে চাওয়ার স্বভাব বাঙালীর গেলোনা।’ কিন্তু সামান্য রায় নিয়ে আনন্দিত হওয়ার মতোও কিছু না এটি। কারণ ধর্ষকের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হবে যখন সে প্রমানিত হবে।
একজন ধর্ষিতার শরীরে বহন করা চিহ্নগুলোকে দিয়েই প্রমানিত হবে ধর্ষকের কুকর্ম। আর সেই প্রমান নিশ্চিতকরনের যে প্রক্রিয়া- সেটুকু নিয়ে কি কোনো আইন প্রণয়ন হয়েছে? আইন মানেই কি শুধু অপরাধীর শাস্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা? নাকি কোনো শাস্তি বিধান করার জন্যেও একটি সরলীকৃত নিয়ম? এই বিষয় নিয়েও আসলে ভাবতে হবে।
একজন ধর্ষককে কি সর্বাবস্থায় মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে? যদি প্রমানিত হয় সে মানসিক বিকারগ্রস্থ কিংবা তার বয়স আঠারো এর নিচে? তখন আসলে রাষ্ট্র ধর্ষকের শাস্তি কিভাবে নিশ্চিত করবে? বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি চাইলে মৃত্যুদন্ড মওকুফ করতে পারে। তার মানে ধর্ষকের মৃত্যুদন্ড এড়ানোরও অসংখ্য উপায় আছে। তাই আসলে ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদন্ড- এর পক্ষে নাকি বিপক্ষে বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর দেয়া নিরর্থক।
মূল সমস্যাকে চিহ্নিত না করতে পারাটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। কিন্তু আমরা যেন ভুলে বসতে শুরু করেছি, সমস্যার গভীরেও সমস্যা থাকতে পারে। অনেকেই , এমনকি অনেক নারীও নিজের লাইফস্টাইলের সাথে নিরাপত্তার অধিকার গুলিয়ে ফেলছেন।
যেকোনো সময়েই, যেকোনো সরকারের আমলেই আমাদের সংস্কৃতি কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করে। তারা নিজেদের অধিকারের গরিমার জন্যেও নারীকে ভোগ করে। যখন সেটা কথায় হয়না, জোর করে আসে। নিরাপত্তা কিংবা নারীকে অবমাননার জন্যে অনলাইনে কি কোনোদিন নিরাপত্তা বিষয়ক আইন করা হয়?
সোশ্যাল মিডিয়াতে যে হারে বিভিন্ন ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও ফাঁস হয় সেগুলো দ্রুত অপসারণের ব্যবস্থা, নারীকে বিভিন্নভাবে ফাঁদে ফেলার অহরহ প্রমাণগুলোকে ধর্তব্যে আনা হয় কিনা জানা নেই। মানে সমস্যাটুকু বিশাল। আর এই সমস্যাগুলোকে ধাঁপে ধাঁপে গুছিয়ে আনলেই ধর্ষককে চিহ্নিত এবং শাস্তি বিধান করার পথ সহজ হয়ে উঠে।
এই গেলো কদিন আগেই, সড়ক দূর্ঘটনা এড়াতে বিভিন্ন আইন করা হলো। মূলত জরিমানা এবং মামলার অঙ্ক বৃদ্ধি করা হলো। তাতে কি সড়কে অনিয়ন্ত্রিতভাবে গাড়ি চালানো বন্ধ হয়েছে। কিন্তু আসলে তেমন কিছু কি হয়েছে? নাকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনির চোখে ধূলো দিয়ে অলিগলিতে বেপরোয়া গাড়ি চালানোর মাত্রা সমানতালেই চলছে? আসলে এসবকিছু বোঝা বা জানা বেশ কঠিন। ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদন্ড- শুধুমাত্র এই শাস্তিতেই হয়তো আমাদের স্বস্তি পেতে হবে।
তবে নিরাপত্তার হাপ জিরোতে পারবো কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। এখনো অনলাইনে কোনো একজন অভিনেত্রীর কোনো ব্যক্তিগত বিষয় উঠে আসলে সকলের উৎসাহ উদ্দীপনার জোয়ারের বিষয়টি আমাদের কারোরই অজানা নয়। প্রতিটি টিনেজ সম্পর্কের চ্যাটবক্সে গোপন ছবিগুলো সাময়িক উত্তেজনা প্রশমনের সহায়ক এবং সম্পর্ক শেষে হেনস্তার একটি অস্ত্র হয়ে উঠে। এগুলোই আস্তে আস্তে নারীকে বিভিন্ন ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’র দিকে ঠেলে দেয়। দায়টুকু তার উপরেই পড়ে যায়। ধর্ষণের চিহ্ন তাকে বহন করতে হয়। সেই বহতা চিহ্ন দিয়ে নিজের প্রতি হওয়া অন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। আর যদি দু একদিন দেরি হয়, চাক্ষুষ প্রমাণের অভাবে ধর্ষক মুক্তি পায়।
তাই মনে হয় ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড যেহেতু দেয়া হবে বলেই সিদ্ধান্ত হয়েছে- আমাদের নতুন কিছু আবার ভাবতে হবে। কারণ এই মৃত্যুদন্ডকে কার্যকর করার জন্য যে আইনের বিস্তৃত জাল বুনতে হয়, তার জন্যেও অন্যান্য আইন প্রয়োজন। একজন ধর্ষক সমাজের মধ্যে রাহাজানি সৃষ্টি করে। তাকে ঘৃনা কিংবা ভালোবাসার গল্প শুনিয়ে লাভ নেই। বরং বিস্তৃত জালের ফাঁদে আটকে নির্মুল করতে হবে। তাই স্বাগত জানাচ্ছি এই রায়কে। তবে একে বলবৎ করার জন্য সহযোগী আইন ও আইনী ব্যবস্থাও জোরদারের আশা করছি। নাহলে, শুরুর প্রশ্নটাই থেকে যাবে- স্বস্তি মিলবে কি?