গতিময় কনে ও ফেসবুক পাড়ার একদল হিংসুটে
বাংলাদেশি মনোভাব থেকে আগে একটা বিষয় নিয়ে আসুন ময়নাতদন্ত করি মনে ও লিখে। তাহলে ‘মুখ বিভাগ’ এর গুরুত্ব অনুধাবিত হবে। সম্প্রতি, ‘ফারহানা আফরোজ’ নামের যোশর, বাংলাদেশের একজন মেয়ে বাইক রাইডার থেকে ‘বাইকলেডি’ নামে খ্যাতি পেয়েছেন। এর পিছনে তার নিজেরই কিছু কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ‘মুখ বিভাগ’ এর অভিযোগ সমূহ যেগুলো দাখিল হয়েছে তা নিচে পয়েন্ট আকারে দিচ্ছি:
১ (ক) করোনা কালীন সময়ে উৎসববাজি।
১ (খ) নারী হয়ে জন্মে বাইকবাজি।
১ (গ) বাংলাদেশি সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে বাইকাঘাত ( বাইক দ্বারা আঘাত)।
১ (ঘ) বিবাহিত নারীর বিবাহ উৎসবও নাকি সম্ভব।
১ (ঙ) ফেবুখ্যাতি অর্জন।
১ (চ) নড়বড়ে ধর্মীয় মূল্যবোধ।
১ (ছ) পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবক্ষয়ের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
খুব ভালমতো লক্ষ্য করলে বুঝতে পারবেন ‘মুখ বিভাগ’ এর পক্ষ থেকে আনিত অভিযোগগুলোকে আমি এতোটাই গুরুত্বের সাথে নিয়েছি যে, কোনোভাবেই কোনো অভিযোগকে ২ নাম্বার বানাতে পারিনি। মোটামুটি সবগুলোকে ১ নাম্বারে রাখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আলোচনা এখনো শুরু করি নি। আমি নিজের কিছু মতামত তুলে ধরবো আজ এবং অবশ্যই সেটা এই বিষয়ক আমার পাঠ্য বিভিন্ন পত্র পত্রিকা ও অনলাইন প্রতিবেদনগুলোকে সামনে রেখে। কারণ ফারহানা আফরোজকে ব্যক্তিগতভাবে আমি চিনি না আর আলোচ্য ঘটনার মুহূর্তে আমি সশরীরে সেখানে উপস্থিতও ছিলাম না। তাই আমার উচিৎ উনাকে নিয়ে যা কিছুই লিখবো তা যেন অত্যন্ত সর্তক ও সম্মানিত অবস্থানে থাকে। নইলে আমার নিজেকেই অশ্রদ্ধার পাত্র বানানো হবে।
প্রথমেই বলে নেই আমি কট্টর নারীবাদী বা নরবাদী কোনোটিই নই। মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে যেটা ন্যায় সংগত মনে হয় সেটাকেই আমি প্রাধান্য দিয়ে থাকি। আর বাড়তি কথা না বাড়িয়ে মূল বক্তব্যে প্রবেশ করছি।
একটা ভাইরাস সারা বিশ্বে প্রায় আট লাখ মানুষকে খুন করে ফেলেছে। এমন ভয়াবহ অবস্থাতে যে কোনো বড় সমাবেশ, অনুষ্ঠান আসলেই এড়িয়ে যাওয়াটা বেশ বুদ্ধিমানের কাজ বলে আমরা জানি। কে কোথায় কি করছে সেটাতে যুক্তিতর্ক দেখিয়ে আমরা অবশ্যই ভুল কাজে সাপোর্ট দিবো না। কিন্তু শুধুমাত্র বাইক চালনার ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি ফারহানা একাই বাইকে ছিলেন, যেখানে সামাজিক দূরত্ব লঙ্ঘন হয় নি এবং পত্রিকায় সাক্ষাৎকার অনুযায়ী, রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকাতেই তিনি এই সময়টাকে বেছে নিয়েছে তার ইচ্ছাপূরণের জন্য। আর যার যার বাসাবাড়ি তার ব্যক্তিগত জায়গা। তার ভিতর আমরা না হয় নাই বা প্রবেশ করি বিনা অনুমতিতে।
নারী বা নর যাই বলুন না কেন, জীবনের অনেক সময় এমন হয় আমরা আমাদের অনেক ইচ্ছা পূরণ করতে পারি না। কখনো পরবর্তীতে সুযোগ আসে কিন্তু এমন হয় যে, মন টানে না। সময় অনেকটা বেশি স্রোতে সেই ইচ্ছে পূরণের স্বপ্ন থেকে আমাদের ভাসিয়ে অজানা তীরে জীবন বৈঠা ধরিয়ে দেয়। কখনো কখনো বোধ করি আমরা সেই না পাওয়ার কষ্টে নিজের অজান্তেই মানসিক বিকারগ্রস্ত প্রাণিতে পরিণত হয়ে যাই। অন্যের ইচ্ছা পূরণ দেখলে কলিজাতে ধুপ করে আগুন জ্বলে উঠে। তখন আমরা ‘মুখ বিভাগ’ এর কর্মচারী হয়ে নোংরা কথা বলা শুরু করি। প্রথমে একজন, দুইজন এরপর পুরো সমাজ , রাষ্ট্র। তাতে কার ক্ষতি, কিসের ক্ষতি হলো, ভেবেছেন কি! না ভেবে থাকলে দয়া করে ভাবুন।
পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, ফারহানা বাইক চালান প্রায় তেরো বছর হলো। যতদূর সম্ভাবনা, তিনি একজন লাইসেন্সধারী বাইকচালক। বাইক চালিয়ে এবং ট্রাফিক আইন মেনে তিনি সেখানে ইচ্ছা ও প্রয়োজন তিনি যেতেই পারেন। গায়ে হলুদের সাজ দিয়ে বাইক চালানো দণ্ডনীয় অপরাধ, এমন বিষয় বাংলাদেশের আইনে আছে বলে আমার ঠিক জানা নেই। বিভিন্ন বাংলা ছায়াছবি অথবা উৎসব, শোভাযাত্রা, রাজনৈতিক প্রচারণাতে যদি শত শত বাইক রাজপথ জুড়ে চলতে পারে তাহলে কয়েকজন আত্মীয় আর বন্ধুবান্ধব নিয়ে ফারহানার বাইক যাত্রাটা কেন বাইকবাজি হলো, আমার ঠিক মাথায় আসছে না। এখন নারীরা বাইক চালাচ্ছে এটা আসলে কোনো আলোচনার বিষয়ই না। তাহলে সমস্যা কোথায়! একটা মানুষ তার ইচ্ছা পূরণ করেছে তাই কি! নাকি আপনারা একবিংশ শতাব্দীতে লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে ভাবছেন। আমাদের দেশে একটা কথা আছে, ছেলেরা বিয়ে করে আর মেয়েরা বিয়ে বসে। মেয়েরা বিয়ে বসতে গিয়ে কেন বাইকে বসবে এটা প্রশ্ন দাঁড়িয়ে গেলো। বিস্তারিত আলোচনা করেও আসলে এর সমাধান আমরা পাবো না যদি না নিজেদের চিন্তাকে পরিবর্তন করি।
বাংলাদেশের সংস্কৃতি বলছে, গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে মেয়েরা নেচে নেচে হলুদ মঞ্চে আসবে বা বজ্রাসনে বা পালকিতে অথবা কোলে অথবা সখীদের ধরা ওড়নার নীচে হেঁটে আরও কিছু থাকতে পারে। কিন্তু এর বাইরে কোনো কিছু করলে সেটা কিভাবে সংস্কৃতির মূল্যবোধ পরিপন্থী! হেলিকপ্টারে করে বরযাত্রী যদি ডিজিটাল বাংলাদেশের সৃজনশীলতা হয় তবে বাইকে গায়ে হলুদের কনের প্রবেশ কেন এত জ্বলুনির কারণ, সেটা অসুস্থ মস্তিষ্কসমূহের কাছে প্রশ্ন রেখে যাচ্ছি।
অন্যের খুব ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আমি ঘাটাঘাটিতে আগ্রহ কম বোধ করি। ফারহানা আফরোজের ব্যক্তিগত ব্যাপারে কথা বলছি খানিকটা বাধ্য হয়ে। তিনি একজন বিবাহিত নারী হয়ে কেন বিয়ের উৎসব করলেন, বিশিষ্ট মানুষদের এই নিয়ে প্রচণ্ড মাইগ্রেনের ব্যথা উঠেছে। যেকোনো ব্যক্তি তার পুরনো স্বামী বা স্ত্রীকে অথবা নতুন কাউকে হাজারবার বিয়ে করলে আপনারা আমার কেন এই অস্থিরতা! অস্থিরতার কারণ একটা ভাল বই পড়া, সুন্দর চিন্তা করা, সৃজনশীল বা সামাজিক কাজের আগ্রহবোধ ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের বড়ই সময়ের অভাব তাই অন্যের শোবার ঘরে কান পেতে রাখাটা আমাদের নৈতিক কর্তব্যে পরিণত হয়েছে আর কিছু নয়।
ফেসবুকে অনেক নোংরামি করেও আজকাল লোকে খ্যাতি অর্জন করছে। কত মুখোশ পড়া মানুষের ছবি, খবর প্রতিদিন তারকাখ্যাতি পাচ্ছে। ফারহানা তার পুরনো ইচ্ছা পূরণের পাশাপাশি যদি ডিজিটাল খ্যাতি অর্জনের এই সুযোগটা কাজে লাগায়। তাহলে কোনোভাবেই আমরা বলতে পারি না তিনি এমন কিছু করেছেন যাতে আইসিটি আইন ভঙ্গ হয়েছে। তাহলে অন্যায় কি করেছেন গায়ে হলুদের সাজে বাইক চালানোর ছবি ভিডিও ফেসবুকে আপলোড দিয়ে এটাও আমার বোধগম্য নয়।
দয়া করে বিশেষ কোনো ধর্ম বা যে কোনো ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করবেন না। নিজেকে সঠিক ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় সুশিক্ষায় আগে শিক্ষিত করুন তারপর মতামত প্রকাশ করুন। একটা বিষয়কে ছুতো করে রাষ্ট্রের সংস্কৃতি ও ধর্মকে গুলিয়ে অশান্তি ডেকে আনাটা ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি।
শেষাংশে বলতে চাই, ফারহানার পরিবার ও ওনার স্বামীর পরিবার উনাকে পূর্ণ সাপোর্ট দিয়েছেন পুরো বিষয়টিতে। আচ্ছা আমরা আসলে কিসে খুশি হই, মেয়েরা যখন শ্বশুরবাড়িতে অপমানিত হয় বিভিন্ন অযৌক্তিক কারণে অথবা খুন হয়ে যায় এমন খবরে! সুখে থাকা মেয়েটিকে কেন আমাদের অসহ্য ঠেকে তার কারণ হয়তো আমাদের অসুস্থ সমাজ ব্যবস্থা ও মানসিকতা। পচা গলা সমাজে বাস করতে করতে আমাদের এখন বিশুদ্ধ বাতাসে দম বন্ধ হয়ে আসে তাই স্বাভাবিক ঘটনাগুলোকে ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে নিজের অস্বাভাবিক সুখী করতে চাই প্রতিনিয়ত। তারপরও বলবো, সময়কে নিয়ে খেলতে নেই, সুযোগ মতো সময় আবার আমাদের খেলা দেখিয়ে দিবে তখন লুকনোর জন্য এক চিলতে জায়গা অবশিষ্ট থাকবে না। আসুন নিজেকে পরিবর্তন করি আর প্রকৃত সুখী হই। ভাল থাকবেন ও ভাল রাখবেন।
লেখক: প্রভাষক, আহসানিয়া মিশন কলেজ, ঢাকা।
গল্প ও প্রবন্ধ লেখক।