করোনা মোকাবেলার লড়াইয়ের নেতৃত্বে যে নারীরা
আইসল্যান্ড থেকে শুরু করে তাইওয়ান, জার্মানি থেকে নিউজিল্যান্ড, সর্বত্রই এখন নারীর জয় জয়কার। নারীরাই বিশ্বকে দেখিয়ে দিচ্ছেন যে কীভাবে করোনা ভাইরাসের মতো মারাত্মক মহামারিকে সামাল দিতে হয়। অনেকেই হয়তো বলবেন, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক- এগুলো ছোট দেশ বা অঞ্চল তাই সম্ভব হয়েছে। কিন্তু জার্মানির বেলাতেও কি তারা একই কথা বলবেন? নিঃসন্দেহে জার্মানি অনেক বড় এবং প্রথম বিশ্বের একটি দেশ। সেদিক থেকে যুক্তরাজ্য একটি দ্বীপরাষ্ট্র হলেও সামগ্রিকভাবে সেখানে পরিস্থিতি কিন্তু ভয়াবহ।
এক কথায়, এই নারী নেতৃরা এই সংকটকালে পুরো বিশ্বকে এক ধরনের আকর্ষণীয় এবং ব্যতিক্রমধর্মী নেতৃত্ব উপহার দিচ্ছেন। শিক্ষা দিচ্ছেন বিশ্ব নেতৃত্বকে। দেখিয়ে দিচ্ছেন, কিভাবে সংকট মোকাবেলা করতে হয়। বুঝিয়ে দিচ্ছেন, পরিবার হোক আর দেশ হোক, সংকট মোকাবেলার দক্ষতায় নারীরাই এগিয়ে।
শেখ হাসিনা
বিশ্বের দুই শতাধিক দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশেও দেখা দিয়েছে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ। এই ভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে লকডাউনসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জনগণকে অবশ্য পালনীয় হিসেবে ইতোমধ্যে ৩১ দফা নির্দেশনা প্রদান করেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর এ সকল নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে- এই ভাইরাস সম্পর্কে সচেতনতা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, করোনা উপসর্গ দেখা দিলে লুকিয়ে না রেখে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া, হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা রোগীদের সঙ্গে মানবিক আচরণ, ত্রাণকার্যে স্বচ্ছতা বজায় রাখা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম জোরদার করা।
সেই সঙ্গে ক্ষুদ্র-মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পখাতের জন্য প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকা এবং কৃষিতে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি করোনার কারণে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে আগামী বাজেটে সারের ক্ষেত্রে আরো ৯ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। স্বল্প-আয়ের মানুষদের বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ, ১০ টাকা কেজি দরে চাউল বিক্রয় কার্যক্রম, নিম্ন আয়ের মানুষদের আর্থিক সুবিধা প্রদান, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলাদের জন্য ভাতা, গৃহহীন মানুষদের জন্য গৃহ নির্মাণ কর্মসূচিসহ বেশ কয়েকটি খাতে সর্বমোট সাড়ে ৯৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন তিনি।
অ্যাঞ্জেলা মার্কেল
জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল। করোনা ভাইরাস সংকটের শুরুতেই তিনি পরিষ্কারভাবে তার নেতৃবৃন্দকে বলে দিয়েছেন, এই ভাইরাস অত্যন্ত ভয়াবহ। দেশের ৭০ শতাংশ নাগরিক এতে আক্রান্ত হতে পারে। তিনি এটিকে 'গুরুতর' উল্লেখ করে সবাইকে এই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে বলেন।
তিনি যতটা গুরুত্বের সঙ্গে বলেছিলেন, তারাও সেভাবেই কাজ শুরু করে। একেবারে প্রথম থেকেই শুরু হয় পরীক্ষা। ফলাফলও এখন চোখের সামনে। অন্যান্য দেশগুলোর মতো অস্পষ্টতা ও হুমকির বিষয়টি অস্বীকার বা আড়াল করার চেষ্টাও করেনি জার্মানি। সে কারণেই প্রতিবেশী অনেক বড় দেশগুলোর থেকেও এখানে মৃতের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম।
করোনা সংকটকে জার্মানির জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে বর্ণনা করে দেশবাসীকে সতর্ক করে দেন মার্কেল। সংকট মোকাবেলায় তার সব পদক্ষেপের প্রশংসা হচ্ছে। করোনায় কম মৃত্যুহারের জন্য জার্মানির প্রশংসার সময়ও আসছে তার নাম। এমনকি অন্যান্য দেশের তুলনায় জার্মানি আগেভাগেই চলাচলের ওপর কড়াকড়ি ও বিধিনিষেধ লঘু করতে পারে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
সাই ইং-ওয়েন
করোনা সংকট মোকাবেলা বিশ্বে সবচেয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া নারী নেত্রী তাইওয়ানের সাই ইং-ওয়েন। এমনকি তার নেতৃত্বে বিশ্বে সবার আগে ও সবচেয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দেশগুলোর একটি হলো তাইওয়ান। চলতি বছরের জানুয়ারিতে যখন করোনার রোগের উপসর্গ দেখা দিতে লাগলো, দেশটির নেত্রী সাই ইং-ওয়েন রোগের বিস্তার প্রতিরোধে ১২৪টি পদক্ষেপ নিলেন। তবে অন্যান্য দেশের মতো লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেন নি তিনি। নিজ দেশে করোনা মোকাবেলা করে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে এক কোটি মাস্ক পাঠাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম সিএনএনের মতে, বিশ্বে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সর্বোত্তম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তাইওয়ান। দেশটিতে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন মাত্র ৬ জন।
তার দেশ তাইওয়ানে করোনা ভাইরাস ভয়াবহ সংকটের জন্ম দেবে বলে আশঙ্কা করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু চীনে সংক্রমণ বাড়া শুরু হতেই চীন, হংকং এবং ম্যাকাও থেকে কারো তাইওয়ানে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে সাই ইং-ওয়েন সরকার। তারপর পর্যায়ক্রমে নেয়া হয় আরো কিছু কঠোর পদক্ষেপ। তার সুযোগ্য নেতৃত্বের কারণে তাইওয়ানে করোনা ভাইরাস এখনো বড় আতঙ্ক হয়ে উঠতে পারেনি৷
জাসিন্ডা আর্দার্ন
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে প্রথমেই নিউজিল্যান্ডকে লকডাউন ঘোষণা করেন জাসিন্ডা আর্দার্ন। তিনি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবেই দেশে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থা জারি করেন। দেশে যখন মাত্র ৬ জন রোগীর শরীরে করোনার উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়, তখন প্রথমে সীমান্ত বন্ধ করে দেন তিনি৷ এরপর তিনি নিউজিল্যান্ডে প্রবেশকারী ব্যক্তিদের সেলফ-আইসোলেশন বাধ্যতামূলক করেন। সেই সঙ্গে নিষিদ্ধ করেন বিদেশিদের প্রবেশ। স্পষ্টতা ও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে আজ নিউজিল্যান্ড অনেকটাই সুরক্ষিত। এখন পর্যন্ত নিউজিল্যান্ডে মৃতের সংখ্যা মাত্র ৪ জন। শুধু তাই নয়, দেশের বাইরে থাকা সকল নাগরিকদের দেশে ফেরাচ্ছে নিউজিল্যান্ড। এক্ষেত্রে প্রত্যেককেই থাকতে হবে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে।
ক্যাটরিন জ্যাকবসদত্তির
বেশিরভাগ দেশই যখন করোনার লক্ষণ দেখা দিলেই মাত্র নমুনা পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেখানে দেশের সকল নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে করোনাভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছেন আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ক্যাটরিন জ্যাকবসদত্তির। দক্ষিণ কোরিয়াকে পরীক্ষার দিক দিয়ে অনেকেই অনুকরণীয় ভাবলেও ইতোমধ্যে জনসংখ্যার অনুপাতে আইসল্যান্ড দক্ষিণ কোরিয়ার চেয়েও পাঁচ গুণ বেশি পরীক্ষা করিয়েছে। দেশটি নাগরিকদের জন্য চালু করা ট্র্যাকিং সিস্টেমের কারণে দেশটিতে লকডাউন আরোপ করতে হয়নি। এমনকি বন্ধ করা হয়নি স্কুলও।
সানা মেরিন
ডিসেম্বরে যখন সানা মেরিন ফিনল্যান্ড রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব নেন, তখন তিনি ছিলেন বিশ্বের কনিষ্ঠতম রাষ্ট্রপ্রধান। মিলেনিয়াল যুগের এই নেতা করোনাভাইরাস সংকট মোকাবেলায় সচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যবহার করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সেখানকার প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে। তিনি বুঝতে পারেন যে, সবাই পত্র-পত্রিকা বা সংবাদমাধ্যম দেখে না। ফলে তথ্যভিত্তিক সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করেছেন।
এরনা সলবার্গ
নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী এরনা সলবার্গও কম সৃজনশীল নন। তিনি টেলিভিশন ব্যবহার করে সরাসরি দেশের শিশুদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ৩ মিনিটের প্রেস কনফারেন্স করার মডেল ব্যবহার করেন তিনি। তার আগে ডেনমার্কের নারী প্রধানমন্ত্রী মেত্তে ফ্রেডেরিকসেনও একই মডেল ব্যবহার করেন।
সলবার্গ আবার আলাদা সংবাদ সম্মেলন করেন, যেখানে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন না। শুধু শিশুরা উপস্থিত ছিলেন। তিনি সারাদেশের শিশুদের প্রশ্ন শোনেন ও সময় নিয়ে জবাব দেন।
মেটে ফ্রেদেরিকসেন
ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী নিজের দেশে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি অবলম্বন করে আসলে ইউরোপকেও পথ দেখিয়েছেন। মার্চের মাঝামাঝি থেকেই করোনা সংক্রমণ রোধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছেন তিনি।
জুং ইউন কিয়ং
দক্ষিণ কোরিয়ার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের পরিচালক তিনি। তবে এই পরিচয় ছাপিয়ে এখন সবাই তাকে 'জাতীয় বীর' হিসেবে চেনে। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর রাতের ঘুম ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। সহকর্মীদের অনুরোধেও অফিস ছাড়তে চাইতেন না। সবার জন্য করোনা-পরীক্ষা নিশ্চিত করতে আন্তরিক পদক্ষেপ নিয়ে সংকট নিয়ন্ত্রণে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এই নারী।
মারলিন আড্ডো
জার্মানির হামবুর্গ-এপেনডর্ফ মেডিকেল সেন্টারে নিজের দলের সঙ্গে কোভিড-১৯ ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টায় ব্যস্ত এখন মারলিন আড্ডো। ভায়রোলজিস্ট মারলিন এর আগে ইবোলা ভাইরাস এবং মার্স করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছেন।
অনেক বছর ধরেই গবেষণায় উঠে আসছে, নারী নেতৃত্বের ধরন হয়তো আলাদা, কিন্তু খুবই উপকারী। অনেক রাজনৈতিক সংগঠন ও কোম্পানি যেখানে নারীদের আরো পুরুষের মতো কাজ করতে বাধ্য করছে, সেখানে এই নারী নেতারাই দেখিয়ে দিলেন, কেন নারী নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্যই পুরুষ নেতাদের শেখা উচিৎ।
সূত্র: ফোর্বস ও ডয়চে ভেলে