স্মৃতির পাতায় শহীদ জননী
শহীদ জননী ও কথাসাহিত্যিক জাহানারা ইমামের ২৮তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই মহীয়সী নারীর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি একাধারে ছিলেন মমতাময়ী মা, দেশপ্রেমী, আত্মত্যাগী। দেশের জন্য নিজের সন্তান হারিয়েও ছিলেন অবিচল, অটল। যেকোনো উপায়ে দেশকে স্বাধীন করতে হাজারো সন্তানকে উদ্বুদ্ধ করে গেছেন একাই।
শুধু দেশ স্বাধীন করেই ক্ষান্ত হননি তিনি। ৩১ বছর আগে মুক্তিযোদ্ধার গর্বিত জননী ও সংগঠক এই মহীয়সী নারীর নেতৃত্বেই গত শতকের নব্বইয়ের দশকে গড়ে উঠেছিলো মানবতা-বিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ব্যানারে করা সেই আন্দোলনের ফসল হিসাবেই দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার চলছে।
জাহানারা ইমাম ১৯২৯ সালের ৩ মে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালীন সময়ের রক্ষণশীল বাঙালি মুসলমান পরিবারে তার জন্ম। তার বাবা সৈয়দ আবদুল আলী ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আর মা সৈয়দা হামিদা বেগম ছিলেন গৃহিনী। ১৯৪৪ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে আইএ পাস করে ১৯৪৫ সালে ভর্তি হন কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে বিএ পাস করেন ১৯৪৭ সালে। ১৯৬০ সালে বিএড ডিগ্রি অর্জন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৬৪ সালে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে ১৯৬৫ সালে বাংলায় এমএ পাস করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
তার কর্মজীবন শুরু হয় ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে। সেখানে তিনি ১৯৪৮ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। এরপর তিনি ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে শিক্ষকতা করেন। জাহানারা ইমাম একাত্তরের দুঃসহ দিনগুলোর প্রাত্যহিক ঘটনা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজের স্মৃতি ঘিরে লিখেছিলেন ‘একাত্তরের দিনগুলি’—যা ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয়। এছাড়া তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো: অন্য জীবন, বীরশ্রেষ্ঠ, জীবন মৃত্যু, চিরায়ত সাহিত্য, বুকের ভিতরে আগুন, নাটকের অবসান, দুই মেরু, নিঃসঙ্গ পাইন, নয় এ মধুর খেলা, ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস, প্রবাসের দিনলিপি প্রভৃতি।
তিনি বিভিন্ন সময়ে অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন। যেমন: বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পুরস্কার, কমর মুশতরী সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার ইত্যাদি। জাহানারা ইমাম ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে মৃত্যুবরণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের প্রিয় সন্তান শফি ইমাম রুমী ও স্বামী শরিফ ইমামকে হারান তিনি। তার ছেলে রুমী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে গিয়ে শহীদ হওয়ায় তাকে শহীদ জননী বলা হয়। তবে প্রায় সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েও দমে যান নি। তৎকালীন সময়ে নারীদের জন্য সমাজে যত বাঁধা ছিলো সব একা ঠেলে দাঁড়িয়েছিলেন স্বাধীনতার জন্য। নিজের ছেলেকে হারিয়েও মা হয়েছিলেন বহু মুক্তিযোদ্ধাদের৷ স্বাধীনতা লাভের পর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির মাধ্যমে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন কাজ আরও বাকি। বাঙালির ইতিহাসে, বাঙালির স্মৃতিতে আজীবন উজ্জ্বল হয়ে থাকুক শহীদ জননী।
অনন্যা/জেএজে