অশরীরী
অনেক দিনের জমে থাকা মেঘ সরে আকাশটা আজ স্বচ্ছে। তার বুকে এক ফালি চাঁদ তারাদের ঘিরে আলো ছড়াচ্ছে। আহ কী সুন্দর! মানুষের মনের অন্ধকারই কুৎসিত হয়। বাকি সবকিছু ঘিরে থাকা অন্ধকার কোনো-না-কোনো সময় দূর হয়। বাসন্তীর মনে দোলা দেয়া প্রেম আজও মানুষের মনে দাগ কেটে আছে। কত বছর আগের ঘটে যাওয়া স্মৃতি আজও যেন জ্বলজ্বল করছে। বিরাজ বাবু কেন ওকে শাস্তি দিল? জাত, মান এগুলোই কি সব! চা বাগানের ছায়া গাছগুলোকে জোৎস্নার আলোতেও ভুতের মতন দেখাচ্ছে। তাকালে শুধু কালো একটা কী মনে হচ্ছে। চা বাগানের সৌন্দর্য দিনের। রাতটাকে ভূতুড়ে করে দেখায়। কালো ঘুটঘুটে অন্ধকার রাজ্য, শুনশান নীরবতা। মাঝে ঝিঁঝি পোকার ডাক আরো ভয়াবহ পরিবেশের সৃষ্টি করে। বড় ছায়া গাছগুলোকে মনে হয় বিশাল বিদঘুটে কালো কালো দৈত্য। গহিন রাতের বুক চিরে ভেসে আসে এক ছোট্ট শিশুর আর্তনাদ। জন্মের পর যাকে হত্যা করেছিল বিরাজ বাবু। বাসন্তীকে ঐ বটগাছটায় বেঁধে রেখে তিলতিল করে কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। একটা মানুষও টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি। সর্দারের সামনে দাঁড়ানোর সাহস ওদের কারো ছিল না।
সবাই একসুরে বলেছিল-হামার সর্দার যা বুইলেছে তাই কুরতে হইবেক। তাহার উপর কথা কুইবে নাকো কেহ। সারা রাত নাচা গানা আর রঙ্গলীলা করাই তার নেশা। পল্লির কোনো বাচ্চা মেয়েও রেহাই পেত না বিরাজবাবুর নষ্ট আঁচড়থেকে। কিশোরী, যুবতী, পোয়াতি, বুড়ি কেউ না। সে করে সালিশি! মান্য করে তাকে পল্লির সকলে। কী পরিহাস! তরুণ যুবক নারায়ণ বাইরে থেকে এসে বাগানে চা তোলার কাজ করত। দিন শেষ হলে আবার চলেও যেত। একসঙ্গে বছরখানেক ধরে কাজ করছে বাসন্তীদের দলে। এভাবে ও গনিষ্ঠ হয় বাসন্তীর সঙ্গে। কত গল্প করে দুজন। কেমন সংসার হবে, কেমন করে ভবিষ্যতে ওরা থাকবে। পরিকল্পনা করে নিজের সাধ্য আর সামর্থ্যকে সঙ্গী করে। একদিন বাগানে কাজ করতে করতে দুজন ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ে। একজন আর- একজনকে স্পর্শ করে একান্তে। জানে না, বোঝে না তার পরিণতি। সেই মুহূর্তে বুঝতেও চায় না তাদের মন। স্বেচ্ছায় সঁপে দেয় একজন আর-একল্পনকে।
-হামার এখন কী হইবেক?
এ প্রশ্নের উত্তর জানে নারায়ণ। শুধু বলে, চিন্তা করিস না আমরা পালাইয়া যাইবেক এখান থাকি দূরত। সেখানে গিয়া সংসার পাতবেক। ওর ডর লাগছে বিরাজ বাবুকে। বাসন্তী যেন দিনকে দিন কুঁকড়ে যাচ্ছে নিজের মধ্যে। কিছু খাচ্ছে না, বমি হচ্ছে। শরীরটা ভেঙে আসে কাজ করতে ইচ্ছে করে না। শুধু ঘুম পায় তার। রাজ্যের ঘুম যেন ভর করেছে দুচোখের পাতায়। বাসন্তী একদিন কাজে না এলে, ওকে না দেখতে পেলে নারায়ণ অস্থির হয়ে পড়ে। বাসন্তীর মা টের পেয়ে মেয়েকে বনাজি ওষুধ খাওয়ায় যেন বাচ্চাটা পেটে না থাকে। কিন্তু কাজ হয় না। এভাবে আস্তে আস্তে সকলেই জেনে যায়। বাবুকে বিচার দিয়ে নারায়ণকে বের করে দেয়া হয়েছে বাগান থেকে। ও সহজে যেতে চায়নি। বাসন্তীকে সঙ্গে নিয়ে যাবে বলায় ওকে রক্তাক্ত করা হয়েছে মেরে। তারপর একদিন সর্দার পঞ্চায়েত ডাকল। একঘরে করার সিদ্ধান্ত হলো। মা-মেয়েকে একঘরে করে রাখা হলো। মিনতির মা লুকিয়ে লুকিয়ে মাঝেমধ্যে ওদের খাবার দিয়ে আসে। কাজ করতেও দিচ্ছে না বাগানে তাদেরকে। প্রায় উপোস তারা। এদিকে ৮ মাসের পোয়াতি বাসন্তী। পেটের ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরে মা-মেয়ে বিলাপ করে কাঁদছে একরাতে। মিনতির মা একটু ভাত আর আলুভর্তা, সঙ্গে কচি চা-পাতার ভর্তা নিয়ে ওদের ঘরের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু বিধি বাম! একেবারে বিরাজ বাবুর সামনে পড়ে গেল
-খাওন লিয়ে যাইছিস কেনে?
-হামার সহ্য হইছে না বাবু ওদের কানদা। -সহ্য করতে না পারলে তোহাক হামি একঘরে কইরে রাখবেক। এই বলে মিনতির মাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়।বাসন্তীর শান্তি হবে খুব শিগগিরই। সিদ্ধান্ত হলো তাকে ঢা বাগানের পাশে বটগাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হবে। প্রচুর বড় বড় লাল পিঁপড়েদের বাসা সেখানে। ওদিকে বাসন্তীর নয় মাস চলছে। যখন তখন প্রসবব্যথা উঠতে পারে। ওর মাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু মেয়ের চিৎকার শুনে যেন না যায় কাছে তার জন্য শাসিয়ে দেয়া হয়েছে। শনিবার সকালে ওকে ওখানে বেঁধে রাখা হয়। খানিকক্ষণ পর থেকে শুরু হলো। বাসন্তীর আর্তনাদ। ভারী হয়ে আসে আকাশবাতাস। কোনো খাবারও দেয়া হচ্ছে না। তেষ্টায় মরে যাচ্ছে সে। -তোহাগের পায়ে পড়ছি। হামাক একটু জল দিবেক তোহারা। চিৎকার করে বাসন্তী। -জল! পাপের শাস্তি বইলে কথা। আবার জল চাইছিস? রাত এখন গভীর। বাসন্তীকে চোখে চোখে রাখা হচ্ছে যাতে কেউ ওকে সাহায্য করতে না পারে। এদিকে রাত দুইটায় তার প্রসবব্যথা ওঠে। ব্যথায় আর পিঁপড়েদের কামড়ে ছটফট করছে। কেউ কাছে যাচ্ছে না একবারও। পাষান যে তারও তখন মন গলবে। কিন্তু ওর মন গলছে না। ওর মা পায়ে ধরছে সর্দারের। সে ভয় দেখাচ্ছে -তুই বেশি বকছিস। তোহাকেও বেইধে রাখা হইবেক বেশি বাড়লে। ভোর পাঁচটার দিকে বাচ্চার কান্না শোনা গেল। একটি প্রাণীকেও যেতে দেয়া হলো না ওর কাছে। খানিক পরে বাচ্চার অনবরত চিৎকার শোনা গেল। সবাই বুঝল যে বাচ্চাটাকেও পিঁপড়ে কামড়াচ্ছে। তবুও সর্দারের মন গলল না। বাসন্তী বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ওকে ধরার চেষ্টা করছে কিন্তু ওর হাত বাঁধা।
কী করে পারবে?
একসময় বাচ্চার চিৎকার থেমে নিথর হয়ে গেছে। বাসন্তী সারা রাত হাউমাউ করে কাঁদছে, একসময় শুধু গোঙানির আওয়াজ শোনা গেল ওর। পরদিন ওর মা দৌড়ে মেয়ের কাছে গেল। কী বীভৎস দেখতে লাগছে বাচ্চাটা। শরীরের মাংসগুলো চারপাশে খোবলা খোবলা হয়ে রক্তে ভেসে রয়েছে। চোখ থেকেও রক্ত ঝরছে। মেয়ের বাঁধন খুলে দিতেই বাসন্তী লুটিয়ে পড়ল মাটিতে কোনো শব্দ করতে পারছে না মুখে। একসময় তার শরীরও ঠান্ডা হয়ে নিস্তেজ হয়ে গেল। মা, বাচ্চার জীবনের যবনিকা ঘটল। আজও রাতে বাচ্চার কান্নার শব্দ ভেসে আসে বাতাসে। ভয়ে কেউ ঐ গাছটার তলে যায় না। বাচ্চাটার অশরীরী আত্মা এখনো মনে করিয়ে দেয় মানুষ নামের অমানুষ দানবের নির্মমতার কথা। সত্যি কি বাচ্চাটা কাঁদে। নাকি প্রকৃতির প্রতিশোধ এটি। তাহলে সবাই শোনে কীভাবে সেই কান্নার আওয়াজ!