হুমায়ূন ও তার উপন্যাসের নারীরা
একঘেঁয়ে নারীবাদ নয়, কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার উপন্যাসে নারী চরিত্রের প্রাধান্য দিয়েছেন স্বতন্ত্রভাবে। তার বেশির ভাগ উপন্যাসেই রয়েছে একাধিক নারী চরিত্র। হোক মুখ্য অথবা গৌণ। ‘বহুব্রীহি’ উপন্যাসের ‘মিলি’ কিংবা ‘আজ রবিবার’-এর ‘মীরা’ চরিত্রকে বিশৃঙ্খলাময় একটি পরিবারে শান্তি ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব দিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। এই দুই চরিত্র সম্পূর্ণরূপে দুই মেরুর নারীকে প্রতিনিধিত্ব করে।
হুমায়ূন আহমেদের প্রায় প্রতিটি উপন্যাসে নারী চরিত্রকে শান্তি-শৃঙ্খলার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সেই কারণেই পুরুষের অস্থির ও বিশৃঙ্খল সময়ে নারীর প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছেন নন্দিত এই কথাসাহিত্যিক। হুমায়ূনের উপন্যাসে নারী চরিত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে ‘হুমায়ূনের নারীরা’ প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ‘কোথাও কেউ নেই’-এর মুনা, ‘এইসব দিনরাত্রি’র নীতু, ‘শঙ্খনীল কারাগার’-এর রাবেয়া- এমনকি ধারাবাহিক ‘আজ রবিবার’-এর মীরাও হচ্ছে এমন চরিত্র, যারা মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে যে মধ্যবিত্ত সমাজের উত্থান ঘটেছে, তার অতি পরিচিত অঙ্গ। গত পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশে এই সব চরিত্র ছিলেন পরিবারের আপাত আড়ালে থাকা শেকড়, যাদের ওপর নির্ভর করে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো গড়ে উঠেছে (১২ মে ২০২০, মাহমুদ আব্দুল্লাহ, চিন্তাসূত্র)।
হুমায়ূনের গল্প-উপন্যাসে নারী কখনও ভাবী, কখনও বোন, কখনও প্রেমিকা আবার কখনও স্ত্রী, আবার কখনও বহিরাগত কারও প্রতিনিধিত্ব করেছে (হাবীবাহ্ নাসরীন, ১০ নভেম্বর ২০২০, যুগান্তর)। প্রতিটা উপন্যাসেই এসব নারী ‘ঠাণ্ডা’ স্বভাবের হয়ে থাকে। বিপরীতে পুরুষ হয়ে থাকেন খ্যাপাটে, পাগলাটে ধরনের। নারীর দায়িত্ব শুধু একটাই- খ্যাপাটে পুরুষকে ভালো করে তোলা।
এরই প্রমাণ পাওয়া যায় ‘কোথাও কেউ নেই’ উপন্যাসে। এতে ‘বাকের ভাই’ চরিত্রকে ভালো করে তোলার পেছনে ‘মুনার’ ভূমিকা ছিল। জনপ্রিয় সাময়িকী অনন্যায় ‘হুমায়ূন আহমেদের মুনা: বাঙালি নারীর অন্তর্নিহিত জীবন’ প্রবন্ধে এই ‘মুনা’ চরিত্রের খানিকটা বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। ‘কোথাও কেউ নেই’ উপন্যাসটিতে ‘বাকের ভাই’ চরিত্রের সঙ্গে মানানসই করে ‘মুনা’ চরিত্রকে উপস্থাপন করা হয়েছে। উপন্যাসটিতে ‘বাকের ভাইয়ের’ মৃত্যু যেমন পাঠককে ভাবিয়ে তোলে, তেমনই ‘মুনাও’ কম গুরুত্বপূর্ণ না। বলা যেতে পারে, তারা দুজনেই দুজনের পরিপূরক। ‘উপন্যাসের চরিত্র থেকে বাকের ভাই এবং মুনা বাস্তব জগতে নেমে আসে। মানুষ হৃদায়ঘনিষ্ঠ, আবেগআপ্লুত হয়ে পড়ে এই উপন্যাসের কাহিনিতে’ (১৩ নভেম্বর ২০২২, জান্নাতুল যূথী, অনন্যা)।
‘আজ রবিবার’-এ ‘কঙ্কা’ ও ‘তিতলি’ দুই বোনের একজন পুরুষকে পছন্দের বিষয়টি উঠিয়ে এনেছেন হুমায়ূন আহমেদ। ‘আনিস’ নামে একটি ছেলে যে কিনা সবসময় বইয়ের ভেতর মুখ গুঁজে সারাদিন পড়াশুনা করতে থাকে। পড়াশুনায় এতটাই মগ্ন থাকে যে আশেপাশের কোনো কিছু তার খেয়ালে থাকে না। এমনকি সামাজিক বা পারিবারিক কোনো ঘটনায়ও তার উপস্থিতি নেই। ‘কঙ্কা’ ও ‘তিতলি’ দুই বোনই যে তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, সেটাও ধরতে পারছে না। ‘তিতলি’ একদিন ‘মীরাকে’ জিজ্ঞাসা করেই বসলো, ‘আনিস ভাই এত বোকা কেন?’ উত্তরে মীরা বলেছিল, ‘ঠিক বোকা না। আনিস ওর মেধাকে সম্পূর্ণ একদিকে ফোকাস করে রেখেছে। শুধু পড়াশুনার মধ্যে ফোকাস করে রেখেছে। তাই আশেপাশে কি হচ্ছে সে সম্পর্কে ও কিছু জানে না। এরা ভাগ্যবান।’ তখন ‘কঙ্কা’ বললো, ‘আনিস ভাইকে ঠিক করা যায় না?’ মীরা বললো, ‘করা যাবে। কিন্তু সেটা কি ঠিক হবে?’
‘মীরার’ আপত্তি উপেক্ষা করেই ‘বড় চাচা আসগরের’ কাছে ‘আনিসকে’ ভালো করতে নিয়ে যায় ‘কঙ্কা’ ও ‘তিতলি’। কিন্তু ‘মীরা’ কেন ‘আনিসকে’ ‘ঠিক’ করার বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিলো সেটা ঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছিলো ‘কঙ্কা’ ও ‘তিতলি’।
হুমায়ূনের উপন্যাসে নারীর স্বতন্ত্র রূপ দেখানো হয়েছে। তাতে নারীবাদের একঘেঁয়েমিও নেই, আবার একেবারেই টিপিক্যালও না। বহিরাগত কেউ হয়েও যে নারী পরিবারের সব সদস্যের আপন জনে পরিণত হয়ে ওঠে, উপন্যাসে সেটা চিত্রিত করেছে হুমায়ূন আহমেদ।
তথ্যসূত্র:
১. ‘বহুব্রীহি’;
২. ‘আজ রবিবার’;
৩. ‘এইসব দিনরাত্রী’;
৪. ‘কোথাও কেউ নেই’;
৫. মাহমুদ আব্দুল্লাহ, চিন্তাসূত্র;
৬. হাবীবাহ্ নাসরীন, যুগান্তর;
৭. জান্নাতুল যূথী, অনন্যা;
৮. ডেইলি স্টার;
৯. বিডিনিউজ২৪;
১০. সামহোয়্যার ইন ব্লগ