নারীরা কেন ‘পুলিশ’ নয়, ‘নারীপুলিশ’ কেন?
১৯৭৪ সালে মাত্র ১৪ জন নারী সদস্য নিয়োগের মধ্য দিয়ে পথ চলা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ নারী পুলিশ বাহিনীর। সময়ের পরিবর্তনে ২০২২ সালে সেই সংখ্যাটা এসে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ২৩৯ জনে। সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের দক্ষতাও বহুগুণে বেড়েছে। বর্তমানে তারা ছোট অস্ত্র থেকে ভারী অস্ত্র অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করছেন গুরুত্বপূর্ণ অভিযানগুলোতে ।
প্রথম নারী পুলিশের যাত্রা শুরু হয় মাত্র ৭ জন সাব-ইন্সপেক্টর, ৭ জন কনস্টেবলের যোগদানের মধ্য দিয়ে। শুরুতে তাদের জন্যে কোনো নির্ধারিত পোশাকও ছিল না। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৬ সালে সরকার তাদের জন্য ইউনিফর্মের ব্যবস্থা করে। এরপর দীর্ঘ একটা সময় পর ১৯৮৬ সালে প্রথম কোনো নারীকে বিসিএস ক্যাডারের মাধ্যমে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হয়।
কিন্তু প্রশ্ন এখানে থেকেই যায় যে, যোগদানের ৪৮ বছর পরেও সব প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করেও তারা কি আসলেই পুরুষদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারছে? সত্যিকার অর্থেই কি তারা একজন ‘পুরুষ পুলিশের; মতোই সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করতে পারছে। তারা কি আদৌও সঠিক মূল্যায়ন পাচ্ছে, যতটা তাদের প্রাপ্য?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তরে যেমন ইতিবাচক জবাব মেলে আবার ঠিক নেতিবাচক জবাবও মেলে। কেউ বলেছেন ধীরে ধীরে হচ্ছে পরিবর্তন। সামনে রয়েছে আশার আলো। আবার অনেকে বলছেন, যা কিছু সমস্যার সমাধান না হলে কখনোই হবে না সমাঝোতা। আবার অন্যদিকে কেউ কেউ হতাশায় বুঁদ মনে করছেন, পরিবর্তন কিছুই হচ্ছে না আর কখনো হবেও না।
প্রশাসনের এই চ্যালেঞ্জিং পেশায় মেধা আর যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে মোট জনবলের ৮.০২ শতাংশ নারী রয়েছেন। তবে অংশগ্রহণ বাড়লেও নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা এখন পর্যন্ত ঢের পিছিয়ে রয়েছেন। সামাজিক প্রেক্ষাপটে পুলিশ সদস্যদের ধরা হয়ে থাকে ‘ক্ষমতাধর’, কারণ তারা রয়েছেন আইন প্রয়োগের দ্বায়িত্বে। কিন্তু পেশাগত পরিচয়ের পাশাপাশি নারী শব্দটি থাকায় বৈষম্যের স্বীকারও হচ্ছেন নারী পুলিশেরা।
বিপুল জনসংখ্যায় ভরপুর রাজধানীতে যানজট নিয়ন্ত্রণে রাখা অসম্ভব কঠিন কাজ হয়ে গিয়েছে। তবে এই কাজেও পুরুষ পুলিশদের পাশে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন নারী পুলিশেরাও। ২০১৭ সালে সর্বপ্রথম ৩২ জন নারী পুলিশকে ট্রাফিক পুলিশ হিসাবে নিয়োজিত করা হয়।
এই বিষয়ে কথা হয় মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অধীনে থাকা ট্রাফিক সার্জেন্ট নাজিয়া আক্তারের সঙ্গে। বর্তমানে তিনি ঢাকার পরীবাগ এলাকায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি তার পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ‘গাড়ির চালক বা বাইকের চালকেরা যখন সিগন্যাল ভঙ্গ করেন, তখন আমরা গাড়ির কাগজপত্র দেখতে চাই। তখন প্রথমেই আমাদের যে কথার মুখোমুখি হতে হয়, সেটা হচ্ছে আপনি আগে সার্জেন্টকে ডাকুন। তাদের সহজে বোঝানো যায় না যে ,আমিই সার্জেন্ট। এছাড়া আবার অনেকে সিগন্যাল ভেঙেই চলে যায়। এটা ভেবে যে আমি নারী পুলিশ চাইলেও তাদের ধরতে পারবো না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার মনে হয়, ঢাকার রাস্তায় কাজ করার জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার হচ্ছে মানসিক শান্তি।’
এর বাইরে তিনি আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়েও কথা বলেছেন। সেটি হচ্ছে যে, কাজের সময় আমরা যে সমস্যাটির সবচেয়ে বেশি সম্মুখীন হই, সেটি হচ্ছে ওয়াশরুম নিয়ে। পাবলিক টয়লেট মোটামুটি সব এলাকাতেই থাকে। কিন্তু মেয়েদের যাওয়ার উপযুক্ত সবসময় হয়ে ওঠে না আসলে। আর দেখা যায় পিরিয়ডের সময়টা অনেক বেশি কষ্টকর হয়ে পড়ে। এরচেয়ে সবচেয়ে ভালো হয় যদি পুলিশ বক্সের পাশে একটি ওয়াশরুমে ব্যবস্থা করা হয়।
বাংলাদেশের অনেক নারীই বর্তমানে পুলিশের কাজ করে যাচ্ছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। মাঠ পর্যায়ে কর্মরত এই নারীরা পুলিশের কঠিন কর্তব্যের মধ্যে দিয়েও সাফল্যের মুখ দেখছেন। কিন্তু তার মধ্যেও তাদের পড়তে হচ্ছে নানা রকম বিড়ম্বনায়। তাও শুধু লৈঙ্গিক কারণে জন্যে । এছাড়া, তাদের নানারকম জটিলতার মুখেও পড়তে হয়।
এই বিষয়ে গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) অধীনে থাকা সাব ইন্সপেক্টর বীনা নিজনুন বলেন, ‘দেখা যায় কর্মক্ষেত্রে একজন পুরুষ অনেক আগের থেকেই যেকোনো কাজের জন্য মূল্যায়ন পান। কিন্তু আমাদের মূল্যায়ন করা হয় পরে। যখন আমাদের কোনো কাজ দেওয়া হয়, তখন অনেক চিন্তাভাবনা করে এরপর দেওয়া হয়। প্রথমেই তাদের মাথায় কাজ করে ঠিকভাবে কাজ করতে পারবে নাকি! কাজ করে দেখানোর পরেই তারা একমাত্র নিশ্চিত হয়। এটাই আমাদের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে।’
তবে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ নারী পুলিশ সবকিছুর পাশাপাশি যোগদান করছেন জাতিসংঘ মিশনেও। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে নিজেদের প্রমাণ করতেও পিছপা হচ্ছেন না। মিশন এরিয়ায় নিজেদের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ২০০০ সালে প্রথম নারীরা মিশনে যোগদান শুরু করেছেন। তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৬২১ নারী সদস্য জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশন সম্পন্ন করেছেন। তারা কাজ করছেন দারফুর, মালি, ডিআর কঙ্গো, দক্ষিণ সুদান ও জাতিসংঘ সদর দপ্তরসহ জাতিসংঘের তিনটি শান্তিরক্ষা অপারেশনে।
এই দলে রয়েছেন সাব ইন্সপেক্টর বীনা নিজনুনও। কর্মক্ষেত্রের বিভিন্ন জটিলতার কথা বলার পরও তিনি খুব গর্বের সঙ্গেই বলেন, ‘সব সমস্যা মোকাবিলা করে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে যোগদান করা আমাদের জন্যে অনেক গর্বের বিষয়। এছাড়াও মিশনের ফলে আমরা আর্থিকভাবেও সাবলম্বী হচ্ছি।’
বাইরের সব প্রতিকূল সমস্যা মোকাবিলার পরও দেখা যায়, পরিবারের মধ্যেও তাদের বহু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। সমস্ত রাতজুড়ে জনগণের সুরক্ষার কথা ভেবে তাদের থাকতে হয় রাস্তায়। নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে অনেক সময় পরিবারও থাকতে চায় না তাদের পাশে। পরিবারের সব সুখ-দুঃখ থেকে তাদের থাকতে হয় অনেক দূরে। যেখানে ইদ, পূজা কিংবা অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবের দিনগুলোতে সবাই একসঙ্গে পরিবারের সঙ্গে বসে আনন্দ করছে, সেখানেই অনেক পুলিশ সদস্য রাস্তায় অবস্থান করেন। যাতে সবাই আনন্দে ধর্মীয় উৎসব পালন করতে পারে। কোথাও যেন নিরাপত্তার বিঘ্ন না ঘটে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, তাদের পরিবারের অনেক বড় বিপদের সময়ও পরিবারের পাশে না থেকে। তাদের প্রথম এসে দাঁড়াতে হয় অন্য মানুষের বিপদের পাশে। এই সব কারণে পরিবার তাদের সর্বদা সাপোর্ট করেন না ।
তবে ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) অধীনে থাকা ওসি সোনিয়া রহমান বলেন, ‘আমি এইদিকে অনেক ভাগ্যবান। আমার পরিবার সবসময় আমার ঢাল হয়েছিল, আছে এবং সামনেও থাকবে। আর আমি মনে করি, সব মেয়ের ফ্যামিলির উচিত, তাদের মেয়েরা যে কাজে আছে, সে কাজে তাদের পাশে সবসময় থাকা। আর বর্তমানে সময়ে এসে অনেক অভিভাবক ইচ্ছা করে নিজেদের কন্যা সন্তানকে পুলিশে যোগদানের জন্য উৎসাহিত করছেন। আমি নিজেও এখানে এসেছি আমার বাবার ইচ্ছাতে।’
দশবছর আগেও যেখানে চিন্তাভাবনার ঊর্ধ্বে ছিল, নারীরা এভাবে কাজ করতে পারবে কি না, আজ তারা নিজেদের মেধা, সাহসিকতা এবং দক্ষতার মধ্য দিয়ে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। কর্মক্ষেত্র হোক কিংবা পরিবার, সব জায়গায় চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে নিজেদের সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ভবিষতের রোল মডেল হিসেবে।