শিশুর বিকাশে পরিবার
শিশুরা যা দেখে তাই সহজে শিখে যায়। সেটা ভালো হোক বা মন্দ। আর তাদের কোমল মনে শেখা বিষয়টাই তাদের বিকাশে ভূমিকা রেখে থাকে। শিশুরা সঠিকভাবে বেড়ে উঠলে তবেই না তারা ভালো কিছু করতে পারবে। কিন্তু শিশুর বিকাশ কিভাবে সঠিক হবে?
শিশুর বিকাশে মুখ্য ভূমিকা পালন করে পরিবার ও পরিবেশ। শিশুদের স্মৃতিশক্তি অনেক তুখোড় হয় তাই তারা সহজে নানা জিনিস নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারে। এছাড়া তারা যা দেখে বা যে পরিবেশে বেড়ে ওঠে, সেভাবেই কাজ করে। এজন্যই শিশুর পরিচর্যায় সঠিক পরিবেশ ও পরিবার প্রয়োজন।
একজন মা তার সন্তানকে যেভাবে আগলে রাখে বা রাখবে সেভাবে অন্য কেউ রাখতে পারে না। অর্থাৎ জন্মের পর থেকে শিশু সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়ে থাকে তার মায়ের সঙ্গে । এ কারণে একজন শিশুর ওপর তার মায়ের আচরণ অনেক বেশি প্রভাব ফেলে। মা যেভাবে কথা বলে শিশুকেও একইভাবে কথা বলতে দেখা যায়। মাকে দিয়ে শুরু হলেও পরিবারের বাকি সদস্যরাও একইভাবে ভূমিকা রাখে। তাহলে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ কিভাবে বৃদ্ধি করবেন?
শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে একটু ভুল হলেই শিশুর বেড়ে উঠায় ক্ষতি হয়। তাহলে করণীয় কী?
শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে মুখ্য ভূমিকা পালন করে পরিবার ও পরিবেশ। তাই শিশুর আশেপাশের পরিবেশ হতে হয় স্নিগ্ধ। এছাড়া শিশুর সামাজিক স্বীকৃতি আসে পরিবার থেকে। অর্থাৎ শিশুর আচরণে পরিবারের সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে কাজ করে। শিশুকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পরিবারের নিয়ম, শৃঙ্খলা, আচার-ব্যবহার সবকিছুই নির্ভর করে। শিশুরা চোখের সামনে যেমনটা ঘটে দেখে তেমনটাই করার চেষ্টা করে। তাই পরিবার একটি শিশুর বেড়ে ওঠায় অনুপ্রেরণা জোগাতে পারে।
শিশুর জীবন বিকাশের সব ক্ষেত্রেই পরিবারের গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবার থেকেই শিশু সব ধরনের পারিবারিক সম্পর্ক সম্বন্ধে প্রথম অবগত হয়। শিশুর মধ্যে নিরাপত্তার অনুভূতি কেমন হবে অন্যের প্রতি সে কিরূপ মনোভাব পোষণ করবে এবং কিভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে, তা অনেকাংশেই শিশুর পারিবারিক কাঠামো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে।
একটা সময় পর শিশুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা প্রতিকূলতা পার করতে হয়। একেক শিশু একেক পরিবেশে বেড়ে ওঠে। তাদের প্রত্যেকের বিকাশেও থাকে ভিন্নতা। তাই এই সময়টাতেও পরিবারই ভূমিকা রাখে। পারিবারিক শিক্ষা ও একাডেমিক শিক্ষা দুটোর মধ্যেই শিশুর বিকাশ নির্ভর করে। আর একাডেমিক শিক্ষা দেরিতে শুরু হলেও এটি অনেক ছোট থেকেই মা-বাবা বা পরিবারের শিক্ষার সঙ্গে জড়িত।
একজন বাইরে বেরিয়ে অপর একজন শিশুর সঙ্গে কিভাবে কথা বলবে? কিভাবে তাদের সঙ্গে মিশবে এই শিক্ষাটা অনেক ছোট থেকেই দেওয়া হয়। যা শিশু যখন অ্যাকাডেমিক জীবনে প্রবেশ করে তখন ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। যদি শিশুর বেড়ে ওঠায় মিশুক ভাবটি চলে আসে তাহলে দেখা যায় শিশুরা সহজে সবার সঙ্গে মিশতে পারে। শিশুর মধ্যে কোনো ভীতি কাজ করে না। শিশু শিক্ষক সহপাঠী সবার সঙ্গেই সহজে মিশতে পারে। কিন্তু শিশু যদি কোনো গম্ভীর পরিবেশে বেড়ে ওঠে, তখন শিশুর মধ্যে কাজ করে আতঙ্ক। শিশু সহজে কারও সঙ্গে মিশতেও পারে না আবার নিজের মনের ভাব প্রকাশও করতে পারে না। এছাড়া, শিশুর শিক্ষা জীবনের হাতেখড়ি হয় একজন মায়ের হাত ধরেই। মা’ই প্রথম তার সন্তানকে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী করে তোলেন।
ছোটবেলার স্মৃতি মনে করলেই সবার একটা জিনিসই মনে পড়ে। মা সন্তানকে কোলে বসিয়ে পড়াচ্ছেন। শিশুর মাত্র শারীরিক ও মানসিক বিকাশ শুরু কিন্তু মা শিশুকে অক্ষর জ্ঞান দেওয়া শুরু করেন। এ কারণেই বলা হয় শিশুর হাতেখড়ি মায়ের হাতেই হয়। শিশুদের সঙ্গে কথা বলার সময়ই যদি শিক্ষামূলক কথা বলা যায়, তাহলে সেই জিনিসটিই শিশু সহজে শিখে ফেলে।
আজকাল মানুষ গ্যাজেট নির্ভর হওয়ায় শিশুদের বিকাশে একটা বিশাল অংশ হিসেবে রয়েছে গ্যাজেট। আজকাল শিশুরা মোবাইল, টেলিভিশন ছাড়া বুঝেই না। খাওয়ানোর জন্যও মায়েদের নিতে হয় মোবাইল বা টেলিভিশনের সাহায্য। অর্থাৎ শিশুরা গ্যাজেট নির্ভর হয়ে পড়ছে। তাই পরিবারের সবার উচিত শিশুদের সঙ্গে যত বেশি সম্ভব সময় কাটানো। পরিবারের মানুষ যখন শিশুদের পর্যাপ্ত সময় দেবে বা শিশুদের সঙ্গে থাকবে কথা বলবে তখন শিশুরা গ্যাজেটের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনবে।
আর যদি তাদের হাতে গ্যাজেট দেওয়াও হয় তাহলেও খেয়াল রাখতে হবে তাতে যেন শিশুদের বিকাশ বিকৃত কিছু না হয়। শিক্ষামূলক নানা প্রোগ্রামই আজকাল তৈরি হচ্ছে শিশুদের জন্য সেগুলোর দিকে শিশুদের আকর্ষিত করতে হবে। এছাড়া পারিবারিক মূল্যবোধ নিয়েও নানা প্রোগ্রাম হয়ে থাকে সেগুলো থেকে শিশুরা পরিবার সম্পর্কে জানতে পারবে এবং শিশুদের বিকাশে তা বেশ কাজেও আসবে।
নেপোলিয়ন বলেছিলেন, ‘আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি উপহার দেবো।’ অর্থাৎ পরিবারই শিশুর প্রথম বিদ্যালয়। একজন শিশুর ভেতরে মূল্যবোধ, আখলাক, চেতনা ও বিশ্বাস জন্ম নেয় পরিবার থেকেই। পিতামাতা যে আদর্শ লালন করেন তাদের সন্তানরাও তাই ধারণ করতে চেষ্টা করে।
তাই একজন শিশুর বিকাশে পরিবার ও পরিবেশ দুটোই বেশ জরুরি। পরিবারই শিশুকে মূল্যবোধের শিক্ষা দেয়। পরিবারই শিশুকে সবার সঙ্গে মিশতে আগ্রহী করে করে। এজন্যই পরিবারের উচিত শিশুর প্রতি যত্নশীল হওয়া, শিশুকে আদর ভালোবাসা, স্নেহমমতা দেওয়া। সদুপদেশ প্রদান করা। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষা দেওয়া। শিশুর চরিত্র গঠনে শিক্ষা দেওয়া। সৎ কাজের উপদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা। শিশুকাল থেকেই তার ভেতরে সামাজিক দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করা। শিশুর সঙ্গে কখনো উচ্চস্বরে বা রাগত স্বরে কথা না বলা। শিশুকে যথেষ্ট সময় দেওয়া, তার সমস্যা ও কৌতূহলের যথাযথ উত্তর দেওয়া।
অনন্যা/এসএএস