ঢাকায় ডিভোর্স রেট সর্বোচ্চ
দেশে ডিভোর্সের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ঢাকায় তো এই সংখ্যা আরো বেড়েই চলছে। কিন্তু এই লকডাউনের মধ্যে এই হার যেন হঠাৎ করেই ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে গিয়েছে। ঢাকায় ২০২০ এর ডিভোর্স সংখ্যা হার মানিয়েছে অন্য সকল বছরগুলোকে।
ডিভোর্সের সবচেয়ে বড় কারণ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ‘বনিবনা না হওয়া’। ডিভোর্স নোটিশ প্রেরণকারীদের প্রায় ৭০ শতাংশই নারী। স্ত্রীর করা আবেদনে কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে উভয়ের মনোমালিন্য, স্বামীর প্রতি সন্দেহবাতিক মনোভাব, পরকীয়া, যৌতুক, দেশের বাইরে গিয়ে আর ফিরে না আসা, মাদকাসক্তি, ফেসবুকে আসক্তি, পুরুষত্বহীনতা, ব্যক্তিত্বের সংঘাত, নৈতিকতাসহ বিভিন্ন কারণ। আর স্বামীর ডিভোর্সের আবেদনের কারণ দেখা যায় স্বামীর অবাধ্য হওয়া, ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী না চলা, বদমেজাজ, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, সন্তান না হওয়াসহ বিভিন্ন কারণ।
তবে দেশ অনুযায়ী ডিভোর্সের কারণে ও ডিভোর্সের হারে ভিন্নতা বিদ্যমান। আমেরিকার মিসিসিপি প্রদেশে ডিভোর্স দেয়ার জন্য শুধু পার্টনার বোকা এরকম একটা কারণই যথেষ্ট। স্বামী বা স্ত্রীর চূড়ান্ত বোকামির নিদর্শন আদালতে প্রমাণ করতে পারলেই বিবাহবিচ্ছেদ মিলবে সহজেই। আবার ব্রিটেনে বিবাহবিচ্ছেদের সহজ কোন কারণ একদমই যথেষ্ট নয় ডিভোর্সের জন্য। ডিভোর্সের মতো বড় সিদ্ধান্ত নিতে হলে এবং পেতে গেলে আপনাকে আরও শক্তপোক্ত কারণ দর্শাতে হয় এখানে। দুটো দেশ ছাড়া প্রায় সব দেশেই ডিভোর্সের হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। একমাত্র ভ্যাটিকান ও ফিলিপাইনসে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক যাই হোক না কেন তাদের একসাথেই থাকতে হয়। কারণ এই দেশ দুটিতে ডিভোর্স দেয়া বেআইনি। পৃথিবীর সব দেশে যেখানে ডিভোর্স রেট অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে সেখানে এই দুই দেশ ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের হিসেব মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দুই সিটিতে তালাক চেয়ে ৪,২১৬ টি নোটিশ জমা পড়েছে। এর মধ্যে উত্তর সিটিতে ২২০০ টি এবং দক্ষিণে ২০১৬ টি। আবেদনকারীদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৩৫ শতাংশ আর নারীদের ৭০ শতাংশ। করোনা ভাইরাসের সময় এই ডিভোর্স সংখ্যা ও ডিভোর্সের জন্য আবেদন সংখ্যা উভয়ই অস্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়। জুন মাস থেকে তালাকের আবেদন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। এরপর থেকে এই হার ক্রমান্বয়ে সেই ধারা অনুযায়ী বিদ্যমান।
এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন সামাজিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক পট পরিবর্তন, ধর্মীয় অনুশাসন থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা এতো বেড়েছে। এছাড়া পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে যাওয়াকেও বিচ্ছেদের পেছনে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন তাঁরা। আর করোনার কারণে অধিকাংশ পরিবারকেই পার করতে হয়েছে কঠিন সময়। অর্থনৈতিক, সামাজিক ক্ষতির পাশাপাশি পারিবারিক ভাবে একধরনের চাপ বিদ্যমান ছিল সবার মধ্যে। মানুষের মানসিকতা পরিবর্তনের পাশাপাশি অসহিষ্ণুতাও বেড়ে গেছে। একারণে ডিভোর্স সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার করোনাকালে বিচ্ছেদের বিবাহ ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে আর্থিক সঙ্কটও বিশেষভাবে দায়ী। আবার লকডাউনের মধ্যে একসাথে অধিক সময় পার করায় পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আর ভালোবাসার ঘাটতি দেখা দিয়েছে অনেক পরিবারে। একেও বিবাহ বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখেছেন বিশেষজ্ঞরা। আবার নারীর স্বাধীনতা, নারীর স্বনির্ভরতা, নারীর নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রবণতার কারণেও নারীর দিক থেকে ডিভোর্সের সংখ্যাটা বৃদ্ধি পেয়েছে।
ডিভোর্সের কারণে সবচেয়ে যারা ক্ষতির সম্মুখীন হয় তারা হল ডিভোর্স প্রাপ্ত বাবা-মায়ের সন্তানেরা। ডিভোর্সের কারণে সন্তানদের মানসিকতায় একটি বিরাট নেতিবাচক পরিবর্তন আসে। তাই ডিভোর্সের আগে স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই একটু ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। করোনার এই নতুন পরিবর্তিত জীবনের সাথে যতটা সম্ভব মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে। সঙ্কটের মুহূর্তে একে অপরের বিপক্ষে না গিয়ে একে অপরের শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে হবে। তাহলেই এই ডিভোর্স রেট অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়ে উঠবে।