Skip to content

৩রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হেরমান হেসের প্রেমের কবিতা

হেরমান হেসের 
প্রেমের কবিতা 
অনুবাদ : গাজী সাইফুল ইসলাম

হেরমান হেস (ঐবৎসধহ ঐবংংব) নোবেল পুরস্কার-১৯৪৬ বিজয়ী জার্মান-সুইস কবি, ঔপন্যাসিক ও পেইনটার। জন্মগ্রহণ করেন ২ জুলাই ১৮৭৭ জার্মানির ব্লাক ফরেস্টের কাছে স্টোটগার্টের ক্লভ নামক স্থানে, একটি প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান মিশনারি পরিবারে। হেসের পড়াশোনা শুরু হয় স্টোটগার্টের একটি প্রোটেস্ট্যান্ট মনস্টারিতে, পিতামহ তাঁকে সেখানে ভর্তি করে দিয়েছিল। কিন্তু খ্রিস্টীয় শিক্ষা তাঁর ভালো না লাগায় কয়েকমাস পরেই তিনি সেখান থেকে পালান। হেসের মায়ের জন্ম ১৮৪২ খ্রিস্টাবে ভারতে। তাঁর মায়ের জন্মের চারবছর পর তাঁর নানা-নানি মিশনারি হিসেবে ভারতে পাড়ি জমান। তাঁর নানা হেরমান গুন্ডার্ট ভারতে অবস্থানকালে মালয়ালম ভাষার ব্যাকরণ, মালয়ালম-ইংরেজি ভাষার অভিধান ও মালয়ালম ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করেন। বাইবেল অনুবাদে তার মা মারি গুন্ডার্ট তাঁর নানাকে প্রচুর সাহায্য করেছিলেন। 
হেরমান হেস জানতেন প্রকৃতই তিনি কী হতে চান। ‘‘একজন কবি অথবা কিছুই না।’’ তার লেখক হবার গল্পটিই আরেকটি বিশাল গল্প। বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পড়াশোনার চেষ্টা চালিয়ে তিনি এতটাই হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলেন যে, ১৫ বছর বয়সে একবার আত্মাহত্যার চেষ্টা চালান। ইংরেজি, জার্মান, ফ্রেন্স, ইতালিয়ান, মালয়ালম, বাংলা ইত্যাদি ভাষায় তিনি ছিলেন ফ্লোয়েন্ট। ভারতীয় আরও কিছু ভাষা যেমন কানন্দা, তেলেগু, তামিল ভাষাতেও তিনি দক্ষ ছিলেন। ১৯০৪ সালে প্রকাশিত ক্যামেনজেন্ড উপন্যাসের মাধ্যমে প্রথম বড়ো রকমের সাফল্যের মুখ দেখেন হেরমান হেস। আর এতে হঠাৎ করেই লেখার আয় দিয়েই তার বেঁচে থাকার একটা উপায় হয়। এরপর ফটোগ্রাফার মারিয়া বার্নোলিকে বিয়ে করে তার সঙ্গে দক্ষিণ জার্মানির ল্যাক কন্সট্যান্সে চলে যান। কিন্তু নিরাপদ ও আরামের জীবন যেমনটি তিনি চাইতেন সেখানে পাননি। দাম্পত্য জীবনও তেমন সুখের ছিল না। ল্যাক কন্সট্যান্স থেকে আবার পালান আর বের হন পড়েন পৃথিবীর পথে। শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণ করেন। তার এই এশিয়া ভ্রমণ পরবর্তীকালে তাঁর লেখায় ব্যাপকভাবে স্থান পায়। এর সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ তাঁর সিদ্ধার্থ উপন্যাসটি। 
সুইজারল্যান্ডের নাগরিকত্ব পাওয়ার পর ১৯৬১ সালের পুরো শীতকালটা তিনি অসুস্থ ছিলেন। এসময় তিনি ‘না ধরা পড়া’ লিউকোমিয়ায় ভোগেন। ৮৫ বছর বয়সে সুইসের মন্ট্যানোলা তাঁকে সে এলকার সম্মানিত নাগরিক নির্বাচিত করে। ৮ আগস্ট সন্ধ্যায় হেস ‘মোজার্ত সোনাতা’ শুনেন। এবং তাঁর স্ত্রী তাঁকে জোরে জোরে বই পড়ে শুনান। নিয়ম করে প্রতি সন্ধ্যায় তিনি তাঁকে বই পড়ে শোনাতেন। পরদিন সকালেই তিনি ঘুমের মধ্যে এ মারা যান। ১১ আগস্ট বিকেলে মন্ট্যানোলা ও লোগানোর মাঝখানে এস. অ্যাবোন্ডিও সিমেটারিতে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর শেষ কবিতা, যা ১৯৬১ সালের কোনো এক এপ্রিলের রাতে তিনি লিখেছিলেন। কবিতটির শেষ ক’টি লাইন হলো : 

কী তুমি ভালোবাসো আর কীসের জন্য তোমার লড়াই,
জানো কি কীসে তোমার অশেষ আনন্দ অথবা বেদনা? 
জি শার্প অথবা অ্যা ফ্ল্যাট, ই ফ্ল্যাট অথবা ডি শার্প
কী পার্থক্য এসব সুরধ্বনিতে কান কি জেনেছে কখনো?
হেস মারা যান ৯ আগস্ট ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে হার্ট অ্যাটাকে, ৮৫ বছর বয়সে, সুইজার‌্যান্ডে মন্ট্যাগনলায় নিজের বাসভবনে।

 

তোমাকে ছাড়া

রাতে আমার বালিশ আমার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে 
শূন্য কবরস্থানের পাথুরে ফলকের মতো;
কখনো ভাবিনি এতটা কষ্টকর হবে
একা থাকা,
আর তোমার চুলে মাথা না রেখে ঘুমানো।

একটি নীরব ঘরে একা শুই আমি,
নেভানো বাতি অন্ধকার গাঢ়তর করে, 
আলতো করে সামনের দিকে হাত বাড়াই
তোমার হাতের স্পর্শ পাবার আশায়,
তুমি এগিয়ে আসো
কোমল হাত বুলিয়ে দাও আমার উষ্ণ গালে
চুমু খাও। নিজেকে নিঃশেষিত আর দুর্বল লাগে।
এরপরই হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়
তখনও চারপাশে আমার ঠান্ডা রাত দীর্ঘতর হতে থাকে। 
জানালায় তারাগুলো উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে
কোথায়ও তোমার সোনালি চুল
কোথায়ও তোমার মিষ্টি মুখ

এখন আমি প্রতিটি আনন্দের উদ্যাপনে
বেদনা পান করি
এবং বিষ পান করি মদিরার প্রতিটি চুমুকে;
কখনো ভাবিনি এতটা কষ্টকর হবে
একা হওয়া,  
তোমাকে ছাড়া একা থাকা…

ইংরেজি অনুবাদ : জেমস রাইট

আমি জানি, তুমি হাঁটো

আমিও প্রায়শই হাঁটি কিন্তু দেরিতে, একাকী রাস্তায়
আনত রেখে চোখ, দ্রুত, খুব ভয়ে ভয়ে,
হঠাৎ, নিঃশব্দে, কখন এসে তুমি হাজির হও। 
এবং এরপর আমি দেখি তোমার সব দুঃখ
আমার নিজের চোখে,
আর এখনও তুমি সুখ চাও আমার কাছে 
অথচ কতদিন আগে সেটি মরে গেছে।
আমার কাছ থেকে
জানি, প্রতিরাতেই তুমি আমাকে অতিক্রম করে যাও
লাজুক পদক্ষেপে, নোংরা পোশাক পরনে
টাকার জন্য হাঁটছ 
বোঝাই যাচ্ছে কতটা দৈন্যপীড়িত হয়ে পড়েছ
পা দুটোতে পুঁযে ঠাসা, ঈশ্বর জানেন কী রোগ বাঁধিয়েছ
তোমার চুলে খেলা করছে কামুক বাতাস
তুমি হাঁটো, আর হাঁটো এবং এখন কোনো ঘর নেই তোমার

অনুবাদ : জেমস রাইট।

দৃশ্যপট

প্রতিটি ফুল যেমন ঝরে যায়, যৌবনও 
তেমনই অন্তর্হিত হয় প্রতিটি মানুষের,
সুতরাং জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই হতে পারে
মূল্যবান, অশেষ পুণ্যের। 
প্রতিটি মুহূর্তে তাই এ উপলব্ধি থাকতে হবে যে,
দিবাভাগে ফোটাফুল রাত হবার আগেই যায় ঝরে।

যেহেতু বিদায় ডাক আসতে পারে জীবনের যে-কোনো বয়সেই
তাই প্রস্তুত থাকতে হবে, হৃদয়ের সঙ্গে বিচ্ছেদ মেনে নিতে
তাই প্রস্তুত থাকতে হবে নতুন উৎসাহ ও উদ্যোগে,
সাহসিকতার সঙ্গে প্রস্তুত থাকতে হবে একদম অনুশোচনা ছাড়া।
খুঁজতে হবে নতুন আলো যা দিতে পারেনি পুরোনো বাঁধন ।
মনে রাখতে হবে, প্রতিটি নতুন সূচনা থাকে জাদুশক্তিতে ভরা
তারা আমাদের পাহারা দেয় আর জীবনকে সহজ করে।

নির্মোহভাবে চলুন দূরে কোথাও চলে যাই
বাড়রি জন্য কোনো আবেগের টান না রেখেই।
মহাজাগতিক আত্মা রুখে দাঁড়াবে না চলার পথে
বরং উত্তরোত্তর ঠেলে দেবে উঁচুতর স্থানে।
যদি আমরা একটি বাড়ি চাই নিজের জন্য
পরিচিত স্বভাব শ্রমবিমুখতা ঠেলে দেবে আমাদের।
আমাদের অবশ্যই দূরে যেতে হবে ও ছুটি নিতে হবে 
নাহলে দাসত্বের লৌহকঠিন শিকল বাঁধবে চিরতরে।
এমনকি মৃত্যুর সময়টিও আমাদের পাঠাতে পারে
দ্রুততার সঙ্গে বিশুদ্ধ-সজীব নতুন কোনো অঙ্গনে, 
এবং জীবন আমাদের ডেকে নিতে পারে নতুন কোনো দৌড়ে
সুতরাং তাই হোক, শেষ করার আগেই হৃদয়কে জানাও বিদায় ।

(‘দ্য গ্লাস বিড গেম’ উপন্যাস থেকে)
ইংরেজি অনুবাদ : রিচার্ড অ্যান্ড ক্লারা উইন্সটন।

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ