মহাকাব্যের নারীগণ: উত্তরা, উপেক্ষিত এক নারীর কথা
উত্তরা—মহাভারতের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। কিন্তু প্রায় পাঠকের চোখের আড়ালে থেকে যাওয়া নারী। তিনি মৎসরাজ বিরাটের কন্যা। অর্জুন-সুভদ্রার পুত্র অভিমন্যুর স্ত্রী। তার ভাই রাজকুমার উত্তর। মামা কীচক। পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদীর অজ্ঞাতবাসকালে তারা মৎসরাজ বিরাটের কাছে ছদ্মবেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
বিরাটগৃহে অবস্থানকালে বৃহন্নলা নামে ক্লীববেশী অর্জুন উত্তরাকে নৃত্য-গীতাদি-কলাবিদ্যা শিক্ষা দিতেন। কৌরবকর্তৃক বিরাটরাজ্য আক্রমণ ও উত্তরকে রক্ষার্থে ক্লীববেশী অর্জুন অস্ত্রধারণ করেন। বিজয়ী হয়ে ফেরেন। যুদ্ধেশেষে অর্জুনের প্রতি রাজা বিরাট সন্তুষ্ট হন।
তেরো বৎসরপূর্ণ হওয়ার পর পাণ্ডবগণ আত্মপ্রকাশ করলে বিরাট তার কন্যা উত্তরার সঙ্গে অর্জুনের বিবাহ প্রস্তাব দেয়। তখন অর্জুন জানায় উত্তরা তাকে আচার্যের ন্যায় শ্রদ্ধা করে তাই উত্তরাকে পুত্রবধূরূপে গ্রহণ করবেন। তার পুত্র অভিমন্যুই মৎসরাজের জামাতা হওয়ার উপযুক্ত। এরপর উপপ্লব্য নগরীতে অভিমন্যু ও উত্তরার বিবাহ সম্পন্ন হয়। অভিমন্যু ও উত্তরার ভালোবাসা একটি অসম্পূর্ণ ভালোবাসা। উত্তর ও অভিমন্যুর বিবাহের পর মহাভারতে উত্তরার উপস্থিতি লক্ষ করা যায় না। বরং দ্রৌপদী-পঞ্চপাণ্ডবদের বিজয়গাথা রচিত হওয়ার জন্য যে নারী নিজ ভালোবাসা ত্যাগ করলো ইতিহাস তাকে ততটুকুই মনে রেখেছে। কিন্তু অভিমন্যুর বীরত্বে নেপথ্যে আছে উত্তরা। যে বুকে পাথর চেপে পতিকে মহাভারতের যুদ্ধে অংশগ্রহণে বাধা দেয়নি বরং পতির বীরগতিপ্রাপ্ত হওয়াটাকে নিয়তি মেনে জীবনধারণ করেছে।
কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন উত্তরা চরিত্রটা আর বাড়তে দেননি বা মনোযোগ দেননি কারণ তিনি মহাভারতের যুদ্ধ ছোট ছোট ত্যাগকে সাবলীলরূপে গ্রহণ করেছেন। উত্তরা নবযৌবনা, সুদর্শনা তাকে বিধবা করে মহাভারতের যুদ্ধকে ধর্মযুদ্ধ রূপ দিয়েছেন, কিন্তু যে নারীরা তাদের স্বামী-সন্তান হারিয়েছে তাদের জন্য ন্যূনতম করুণবাণীটুকুও উচ্চারণ করেননি। উত্তরাকে অভিমন্যুর সঙ্গে বিবাহ দিয়ে পাঠকের আড়ালেই রেখেছেন এ চরিত্রটিকে। কিন্তু জীবনের চরম ভাগ্যবিড়ম্বিত চরিত্রগুলোর মধ্যে সেও একজন। যুদ্ধে পিতা, ভ্রাতা, স্বামী সবাইকে হারায়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ চলাকালে শিবিরে কিছুক্ষণের জন্য সাক্ষাৎ মেলে উত্তরার। কিন্তু সেখানে স্বামীর মৃত্যু তাকে এতটা বিমর্ষ করে ফেলে যে সে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে। অভিমন্যুর সন্তান তার গর্ভে। সেই সন্তানই হস্তিনাপুরের বংশধর। কারণ তার আগে পাণ্ডবদের সব পুত্রকে হত্যা করে অশ্বত্থামা।
উত্তরার গর্ভে অশ্বত্থামা ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষে অশ্বত্থামা পাণ্ডব নিধনের উদ্দেশ্যে ব্রহ্মশির অস্ত্র প্রয়োগ করে। কৃষ্ণের নির্দেশে অর্জুনও প্রতিষেধক হিসেবে একই অস্ত্র নিক্ষেপ করে। উভয় অস্ত্রের কারণে পৃথিবী ধ্বংসের উপক্রম হয়। সে কারণে দেবর্ষী নারদ ও মহর্ষী কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন এই দুই অস্ত্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে উভয়ের অস্ত্র সংবরণ করতে বলেন। অর্জুন ব্রহ্মচার্য পালনের কারণে তার অস্ত্র প্রতিহার করে। কিন্তু অশ্বত্থামা সর্বদা সৎপথে না থাকায় তার অস্ত্র পরিহার করতে সক্ষম হয় না। ফলে ওই অস্ত্র উত্তরার গর্ভে পরীক্ষিৎকে হত্যা করে। পরে কৃষ্ণ যোগবলে পরীক্ষিৎকে জীবিত করে।
উত্তরার এ উপস্থিতি মহাভারতের কাহিনিকে প্রসারিত করার জন্য কিন্তু চরিত্রটি দরদ এবং যত্ন দিয়ে বাড়তে দেননি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। যখন যে চরিত্রের যতটুকু প্রয়োজন, সেভাবেই তাকে কাহিনিতে সংযোজন করেছেন। কিন্তু উত্তরার পতি বিয়োগ এবং সন্তানকে জন্মদেওয়ার মাঝে তার দৈনন্দিন জীবনযাপনের চিত্র তুলে ধরেননি। যদিও মহাভারতের যুদ্ধে জয়লাভ করা এবং হস্তিনাপুর রাজ্যের একমাত্র বংশধর উত্তরার গর্ভজাত। লেখক তাই উত্তরার চরিত্র নির্মাণে যুদ্ধের প্রতি পূর্ণ মনেযোগ দিতে গিয়ে নারী হৃদয়কে তুচ্ছ করেছেন। কিন্তু যেই নারীকে তিনি বাড়তে দেননি তার বংশধরকেই বাঁচিয়ে রেখেছেন কাহিনিতে!
মহাভারতের যুদ্ধ শেষে মহাপ্রস্থাকালে পাণ্ডবরা পরীক্ষিৎকে রাজ্যভার দিয়ে যান। এ সময় পরীক্ষিৎকে রাজ্যভার দিয়ে সুভদ্রাকে ধর্মরক্ষা ও সবার দায়িত্ব পালনের ভার দিয়ে যান কিন্তু উত্তরার কী হলো, সেটা কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন দেখাননি! যদিও পুত্রের রাজ্যাভিষেককে কেন্দ্র করে তারই রাজমাতা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন কিছু কিছু চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে এতটা তাড়াহুড়ো করেছেন যে তাদের কাহিনি সম্পূর্ণ করতে কতটা জরুরি তা ভুলে গেছেন। কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের মূল উদ্দেশ্য ছিল মহাভারতের যুদ্ধ। তাই তিনি চরিত্র নির্মাণে মনোযোগ না দিয়ে বরং কাহিনিকে যতদ্রুত সম্ভব যুদ্ধের দৃশ্যে আনতে চেষ্টা করেছেন। তাই উত্তরা ও অভিমন্যুর প্রেম যেমন থেকে গেছে পাঠক চক্ষুর অন্তরালে ঠিক তেমনি মায়ের মমতাকেও গুরুত্ব না দিয়ে পরীক্ষিৎকে রাজ্যভার দিয়েছেন। সেখানে উত্তরার কোনো উপস্থিতি লক্ষণীয় নয়।