তারার দেশের খোঁজে ক্যারোলিন হার্সেল
আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা গুনে দেখার আনন্দটুকু বাক্সবন্দি শহরে হারিয়ে যাচ্ছে। তবু মানুষ আকাশের দিকে তাকায়, কিছু খোঁজে। আর বাকি থাকে কিছু, যারা কিনা আকাশ ভেদ করে সবকিছু বোঝার স্বপ্ন দেখে। আকাশের সীমানার বাইরে কী আছে, তা আজ আমরা জানি। অথচ তিন শত বছর আগে আকাশকে স্বর্ণভূমি ভাবাই ছিল যেন সবচেয়ে কাছাকাছি উত্তর। তখনো জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা হতো। তবে জ্যোতির্বিদ্যাকে প্রাতিষ্ঠানিক এবং গাণিতিক পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত করার পেছনে দুই ভাই-বোনের অবদান অস্বীকার করার নয়।
এই দুই ভাই-বোনের মধ্যে বোনটির নাম ক্যারোলিন লুক্রেশিয়া হার্সেল। জার্মান এই জ্যোতির্বিদ তার ভাইকে বেশ কয়েকটি ধূমকেতু আবিষ্কারে ও গবেষণায় সহযোগিতা করেছেন। জ্যোতির্বিদ্যাকে আমূল বদলে দেওয়ার পেছনে তার অবদান অনস্বীকার্য। এমনকি হার্সেল-রিগোলেট নামে একটি ধূমকেতু আবিষ্কার করেন এই দুজন। এই ধূমকেতুটি নির্ধারিত সময় পরপর পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে যায়। মাত্র এক মিটার ২ ফুট লম্বা এই নারী মহাবিশ্বের অসীমতার তুলনায় ক্ষুদ্র হলেও নিজ কাজের মাধ্যমে আকাশ ছাপিয়ে পৌঁছে গেছেন আরও দূরে।
১৭৫০ সালের ১৬ মার্চ, ক্যারোলিন জার্মানির হ্যানওভারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আইজ্যাক হার্সেল সৈন্যবহরের ব্যান্ডমাস্টারের দায়িত্ব পাওয়ায় দূরে চলে যেতে হতো। অন্যদিকে মাকে ৮ সন্তানকে মানুষ করতে হয়েছে একা। এর মধ্যে ক্যারোলিন সবার ছোট। মাত্র দশ বছর বয়সেই ক্যারোলিন সাংঘাতিক জ্বরে আক্রান্ত হন। তাতে তার স্বাভাবিক বৃদ্ধি চিরতরে থেমে যায়। এজন্যেই ক্যারোলিন কোনোদিন ৪ ফুট তিনের বেশি লম্বা হতে পারেননি।
বাড়ির সবাই এতে ভীষণ চিন্তিত ছিলেন। বাড়ির সবারই মনে হয়েছিল ক্যারোলিনের জন্যে বিয়ের সম্বন্ধ আনা একেবারেই অসম্ভব। চিন্তিত মা আর উপায়ান্তর না দেখে ক্যারোলিনকে ঘরের মেইড বানানোর পরিকল্পনা করেন। অন্যদিকে তার বাবার ইচ্ছে মেয়ে লেখাপড়া করবে। মায়ের তাতে সায় নেই। মায়ের সঙ্গে ঝগড়া এড়িয়েই মেয়ের জন্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করলেন বাবা।
মূলত মা উপস্থিত না থাকলে মেয়েকে নিজেই পড়াতেন হেনরি। এমনকি ক্যারোলিনের বড় ভাইয়ের লেখাপড়ার সঙ্গে মেয়েকে জুড়ে দিতেন। কারও ওপর নির্ভরশীল যেন হতে না হয়, সেজন্যেই ক্যারোলিন জামা বানানোর কাজ শিখে নিলেন।
বাবার মৃত্যুর পর ভাই ক্যারোলিনকে প্রস্তাব জানালো সে ইংল্যান্ডে তার সঙ্গে যাবে কিনা। ক্যারোলিন ১৭৭২ সালে হ্যানওভার ত্যাগ করে ভাইয়ের সঙ্গে ইংল্যান্ড চলে আসেন। এখানে ভাইয়ের ঘর-দুয়ার ঠিকঠাক রাখার দায়িত্ব তার। এখানে উইলিয়াম নিজেকে একজন সংগীতঙ্গ ও সংগীত শিক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে তোলেন। এমনকি অক্টাগন চ্যাপেলের কোয়ারমাস্টার হিসেবে দায়িত্বপালন করেন।
এ সময় উইলিয়াম বিভিন্ন কনসার্ট আয়োজন ও সংগীত ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। উইলিয়ামের কাছেই ক্যারোলিন গানের প্রশিক্ষণ নিতেন। পরবর্তী সময়ে অন্টারিও কনসার্টের প্রধান গায়িকার ভূমিকা পালন করেন তিনি। গানের জগতে তার সুনাম অতি দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে। তার খ্যাতি এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে বার্মিংহাম ফ্যাস্টিভ্যালে তাকে গান গাওয়ার প্রস্তাব জানানো হয়। কিন্তু লাজুক ম্যারি উইলিয়াম বাদে আর কোনো কন্ডাকটরের সঙ্গে কাজ করবেনই না। এমনিতেও তার চাপা স্বভাবের জন্যে খুব বেশি বন্ধুও ছিল না তার।
কদিন পরই উইলিয়ামের মাঝে জ্যোতির্বিদ্যার ভূত চেপে বসে। সারারাত আকাশ পর্যবেক্ষণ করে পরের দিন নাস্তায় বোনকে তার বিশদ বিবরণ দেওয়াটা যেন অভ্যাসে পরিণত হচ্ছিল। বোনেরও জ্যোতির্বিদ্যায় আগ্রহ বেড়ে গেলো। আগ্রহের পাল্লা এতটাই ভারী হয়েছিল যে গানের রেওয়াজেও ছেদ পড়তে শুরু করছিল।
উইলিয়াম হাই পার্ফম্যান্স টেলিস্কোপ ব্যবহারের জন্যে ইতোমধ্যেই সুনাম কেড়ে নিচ্ছিলেন। ক্যারোলিন ভাইকে নানা কাজে সাহায্য করতেন। এই কাজের জন্যে ক্যারোলিনকে নানা এস্ট্রোনমিক্যাল ক্যাটালগ ও বইয়ের লেখা নকল করতে হতো। এভাবেই ভাইয়ের পর্যবেক্ষণ এর তথ্য গুছিয়ে রাখার কাজ করতে শিখছিলেন। খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন এমন কাজের জন্যে দক্ষতা, গতি ও নিখুঁত হতে হবে।
১৭৮২ সালেই তৃতীয় জর্জের অধীনে উইলিয়াম জ্যোতির্বিদ্যার কাজ পান। এই কাজে তার যেমন লাভ আছে, ক্ষতিও কম না। এমনিতে যথেষ্ট সময় পেতেন নিজের জন্যে। তবে তার আয় কমে গিয়েছিল। এছাড়া রাজা ডাকলেই তাকে বিনোদন দেওয়ার জন্যে যেতে হতো। এ সময়েই উইলিয়াম টেলিস্কোপ বানানোর কাজে দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি সেই সময়ের সবচেয়ে বড় টেলিস্কোপ নির্মাণ করে তাক লাগিয়ে দেন।
ক্যারোলিন ভাইয়ের পাশে অক্লান্তভাবে এই রেকর্ডগুলো নথিবদ্ধ করতেন। কাজে তিনি এতটাই মগ্ন ছিলেন যে, একবার একটি লোহার হুকে আটকে যান। তাকে মুক্ত করার জন্যে টেনে ধরার সময় পীঠ থেকে মাংস খাবলে উঠে আসে।
১৭৮২ সালে ভাইয়ের পরামর্শেই ক্যারোলিন নিজে পর্যবেক্ষণ শুরু করেন। ১৭৮৩ থেকে ১৭৮৭ সালের মধ্যেই ক্যারোলিন M110 গ্যালাক্সি আবিষ্কার করেন। অ্যান্ড্রোমিডার প্রতিবেশী এই গ্যালাক্সি আবিষ্কার এক বড় চমক।
১৭৮৬ থেকে ১৭৯৭ সাল পর্যন্ত ক্যারোলিন অন্তত আটটি ধূমকেতু আবিষ্কার করেন। উইলিয়ামের সহকারী হিসেবে এমন সাফল্য পাওয়ায় তাকে বছরে পঞ্চাশ পাউন্ড (এখানের সময়ে সাড়ে পাঁচ হাজার পাউন্ড) সমমূল্যের বেতন দেওয়া হয়।
তখন জ্যোতির্বিদরা জন ফ্ল্যামস্টিডের ক্যাটালগের ওপর বেশি নির্ভর করতেন। তবে দুই খণ্ডের এই ক্যাটালগে বেশ কিছু ভুল ছিল। কিন্তু এই ক্যাটালগ ঠিক করতে গেলে নিজের কাজে সমস্যা হবে। তাই বোনকেই এই কাজ করার নির্দেশ দেন। ক্যারোলিনের পরিশ্রমের ফসল ১৭৯৮ সালে রয়্যাল সোসাইটি থেকে প্রকাশ করা হয় ১৭৯৮ সালে। এখানে ফ্ল্যামস্টিডের ক্যাটালগ বাদেও নতুন ৫৬০টি তারার রেকর্ড নথিবদ্ধ করা হয়। ১৮২২ সালে ভাই মৃত্যুবরণ করতেই ক্যারোলিন আবার হ্যানওভারে ফিরে আসেন।
তবে জ্যোতির্বিদ্যাকে তিনি ত্যাগ করেননি। হ্যানওভারেই ভাইপো জন হার্সেলকে সহকারী করে তিনি ভাইয়ের আবিষ্কারগুলোকে প্রমাণের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ১৮২৮ সালে রয়্যাল এস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বর্ণপদক দেন। ১৯৯৬ সালের আগে ভেরা রুবিন বাদে আর কোনো নারী এই পদক পাবেন না। নারীর ইতিহাসে ক্যারোলিন তাই অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন।
নেবুলা আবিষ্কারে তার আগ্রহ বাড়তে শুরু করেছিল। ১৮২৮ সালেই এস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি তাকে স্বর্ণপদক দেন। এমনকি ম্যারি সমারভিলের সঙ্গে তিনি রয়্যাল এস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির সম্মানসূচক সদস্য হিসেবে মনোনয়ন পান। তারাই প্রথম নারী সদস্য। ৯৬ বছর বয়সে পুরুশিয়ার রাজাও তাকে স্বর্ণপদক দেন।
চাঁদের একটি খাঁজের নাম তার নামেই করা হয়েছিল। ব্যক্তিগত জীবনে তাকে অনেকেই খাটো করে দেখার সুযোগ পায়নি আর। খর্বাকৃতির এই নারী নিজস্ব সাফল্য দিয়ে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন এই মহাবিশ্বকে।
অনন্যা/ এআই