টেলিগ্রামচক্রের ফাঁদে তরুণীরা: অপরাধীদের কঠোর শাস্তি চাই
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, ততই বাড়ছে নারী নির্যাতনের নতুন নতুন কৌশল। একশ্রেণীর অসাধুচক্র ইন্টারনেট ব্যবহার করে নারী-নির্যাতনের নিত্য-নতুন কৌশল রপ্ত করছে। আর এর সাহায্যে নারীদের ফাঁদে ফেলছে। সম্প্রতি ইন্টারনেটভিত্তিক অ্যাপস টেলিগ্রাম ব্যবহার করে হাজারও তরুণীকে ব্ল্যাকমেইলিং করা হয়েছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে জানা গেছে, তাদের ফেসবুক, ইন্সট্রাগ্রাম আইডি হ্যাক করে ‘পমপম’ নামের একটি টেলিগ্রাম গ্রুপ তাদের গোপন ছবি ও ভিডিও হাতিয়ে নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করছে। টাকা-পয়সা দাবি করছে। দিতে না পারলে ভিডিও কলে এসে আপত্তিকর কর্মকাণ্ড করতে বাধ্য করছে। কোনো প্রস্তাবেই সাড়া না দিলে ভিকটিমদের নাম-পরিচয় ও ব্যক্তিগত তথ্যসহ লাখ লাখ সাবস্ক্রাইবারের টেলিগ্রাম গ্রুপগুলোতে ভাইরাল করে দিচ্ছে।
এই অভিযোগের ভিত্তিতে সিআইডির সাইবার পুলিশের একটি দল কাজ শুরু করে। এতে উঠে আসে ভীতিকর সব তথ্য। গ্রুপটিতে আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ভিকটিমের কাছ থেকে যে কেবল টাকা আয় করেছে তা নয়, চক্রটি ওইসব ভিডিও দেশে-বিদেশে বিক্রি করেও কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ওই চক্রের সদস্যরা অল্পবয়সী মেয়েদের আপত্তিকর কন্টেন্ট সংগ্রহ ও সরবরাহ করতো। তাদের এসব কর্মকাণ্ড তরুণীদের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
এছাড়া, আন্তর্জাতিক টেলিগ্রামচক্রকে ছবি-ভিডিও সরবরাহ করতো ভুক্তভোগী অনেক তরুণীর সাবেক প্রেমিকরা। প্রেম ভেঙে যাওয়ার পর প্রতিশোধের নেশায় তাদের কাছে থাকা ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ভিডিও তুলে দেয় মার্ক-সাকারবার্গ গ্রুপে। মার্ক তার অ্যাডমিনদের দিয়ে সেগুলোতে মিউজিক বসিয়ে, ফেসবুক আইডি থেকে ছবি নিয়ে ৩০-৪০ সেকেন্ডের প্রমো বানিয়ে আপলোড করতো। প্রমো দেখে যারা ফুল-ভার্সন দেখতে চায় তাদের ১ থেকে ২ হাজার টাকার প্রিমিয়াম সার্ভিস কিনতে হতো।
সিআইডি জানায়—মার্ক-সাকারবাগ ওরফে আবু সায়েমকে শনাক্ত করা সহজ ছিল না। প্রযুক্তির সহায়তায় তার নাম-পরিচয় নিশ্চিত হয় সিআইডি।
এরইমধ্যে আরাফাত নামের এক ভুক্তভোগী এবং তার প্রেমিকার কিছু ছবি পমপম গ্রুপে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে ডিএমপির তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মার্ক-সাকারবার্গ ও তার দলের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা হয়। পরে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় চট্টগ্রামের লালখান বাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে মার্ক ওরফে সায়েমকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তার ঘনিষ্ট দুই বন্ধু শাহরিয়ার আফসান অভ্রকে চট্টগ্রামের হাউজিং এলাকা এবং বোগদাদী শাকিলকে উখিয়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মার্ক ওরফে সায়েমের মোবাইল ফোন তল্লাশি করে মার্ক-সাকারবার্গ আইডিটি লগইন অবস্থায় পাওয়া যায়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় পমপম গ্রুপের সব চ্যানেল ও অ্যাডমিনের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়। অ্যাডমিনদের কাজ ছিল মার্কের হয়ে নতুন নতুন কনটেন্ট জোগাড় করা। নতুন কনটেন্ট পেতে তারা ফেক আইডি বানিয়ে ফেসবুক বা ইন্সট্রাগ্রাম আইডি হ্যাক করতো।
আন্তর্জাতিক টেলিগ্রাম চক্রের মূল হোতাসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের ক্রিমিনাল ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)। এই চক্রের সদস্যদের কাজ হলো অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরী কিংবা তরুণীদের ভিডিও ফাঁস ও তা নেট দুনিয়ায় বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া। এই চক্রটি দীর্ঘদিন হাজার হাজার তরুণীকে ফাঁদে ফেলেছে। চিন্তায় ফেলেছে তাদের অভিভাবকদেরও।
অসাধু এই চক্রের ফাঁদে পড়ে তরুণী ও তার পরিবারকে নানা ধরনের সমস্যার মধ্যে দিয়ে সময় পার করতে হয়েছে৷ আশার কথা হলো, শেষমেশ এই গ্রুপের সন্ধান পেয়ে তাদের ধরতে সক্ষম হয়েছে সিআইডি। যদিও কাজটি তাদের জন্য সহজ ছিল না। তবু তাদের এই সফলতার জন্য সাধুবাদ জানাতেই হয়। অসংখ্য তরুণী-নারীকে চিন্তামুক্ত করে তাদের স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি কৃতজ্ঞ পুরো নারী সমাজ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইন্টারনেট দুনিয়ায় আন্তর্জাতিক এই চক্রের রয়েছে বিভিন্ন গোপন গ্রুপ ও পেজ। এদের ফলোয়ার সংখ্যা সোয়া ৪ লাখ। মাসে ১ থেকে দুই হাজার টাকা সাবস্ক্রিপশন ফি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, পর্তুগাল, কানাডা, আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের মতো দেশের অসংখ্য ক্রেতা গ্রুপটির সদস্য হয়েছে। এই চক্রটি ইন্টারনেট দুনিয়ায় ছেড়ে দিয়েছে ২০ হাজার আপত্তিকর ভিডিও ও ৩০ হাজার ছবি।
চক্রের মূল হোতা সায়েমের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হলো মশিউর, ক্যাকটাস ওরফে কেতন চাকমা, এল ডোরাডো ওরফে শাহেদ, তূর্য ওরফে মারুফ এবং মিঞা ভাই ওরফে নাজমুল সম্রাট। এ ঘটনায় ৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি।
সিআইডির তৎপরতায় ভুক্তভোগী তরুণীরা সমাধান পেলেও সবার সচেতন থাকা জরুরি। একটি চক্রের পতন ঘটলে আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে আরও একটি চক্র। এভাবে ক্রমান্বয়ে নারীদের ফাঁদে ফেলে সর্বস্ব লুটপাট করছে বিকৃত রুচির এসব মানুষ। নারীরা তাদের সরলতার জন্য বিপদে পড়ে বারবার। ফলে নারীদের আরও সতর্ক হতে হবে। মনে রাখতে হবে, অসাধু চক্রের কৌশল বারবার পরিবর্তন হয়৷ তারা তাদের অপশক্তি কাজে লাগিয়ে নারীদের টার্গেট করে। নারীদের তাই উচিত খুব সতর্ক থাকা। একমাত্র সচেতনতা ও আইনের কঠোর-দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এসব সমস্যা কমিয়ে আনতে সক্ষম। নারী সমাজেরও সচেতনতার বিকল্প নেই।