Skip to content

১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মা দিবস ও বর্তমান তরুণ সমাজ

যেখানেতে দেখি যাহা, মা-এর মতন আহা
একটু কথায় এত সুধা মেশা নাই
-কাজী নজরুল ইসলাম।

‘মা’ শব্দটি অনেক মধুর। মা, যিনি ১০ মাস গর্ভে ধারণ করে সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখান। মা, যিনি নিজের সব সুখ বিসর্জন দিয়ে শুধু সন্তানের সুখ খোঁজেন। মা, যিনি সবসময় সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন। মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কের চেয়ে মধুর সম্পর্ক আর নেই। মাতৃত্ব নারীর চিরন্তন রূপ। সন্তানকে ঘিরেই মায়েরা রচনা করে স্নেহ-মমতা-ভালোবাসার এক নতুন পৃথিবী। শিশুর জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা মায়ের হাত ধরেই। সদ্যজাত শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো থেকে শুরু করে বড় করে তোলার দায়িত্ব পরম যত্নে পালন করেন প্রতিটি মা। সব দেশেই চিরকালই মায়ের ভূমিকা এক।

আদি যুগে যখন সন্তান জঙ্গলে শিকার করতে গেছে, তখন উদ্বিগ্ন মা সন্তানের পথ চেয়ে বসে থেকেছেন। সন্তান যখন লড়াই করতে গিয়েছে, তখন মায়ের বুক শঙ্কায় কেঁপেছে। আধুনিক যুগে যখন সন্তান পড়াশোনা করতে দূরদেশে যাচ্ছে, তখন মমতাময়ী মা তার ফেরার আশায় দিন গুনছেন। সংসারে একটু সচ্ছলতা আনার আশায় যখন সন্তান ভিনদেশে যায়, তখন সন্তানের সঙ্গে কথা বলতে মা মোবাইলের এপাশে থেকে অপেক্ষা করেন। সন্তানের অমঙ্গলের আশঙ্কায় সবসময় ভয়ে থাকেন মা। পৃথিবীর সব মায়েদের সম্মানে পালন করা হয় ‘বিশ্ব মা দিবস’। মে মাসের দ্বিতীয় রোববার পালন করা হয় মা দিবস।

মা দিবসের ইতিবৃত্ত
মা দিবসের ইতিহাস হয়তো অনেকের অজানা। মায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে বিশ্বে মা দিবস পালনের প্রথম উদ্যোগ নেয় ব্রিটেনের মানুষ। তখন প্রতি বছর মে মাসের চতুর্থ রোববারকে ‘মাদারিং সানডে’ হিসেবে পালন করার রেওয়াজ চালু হয়। এর অনুসরণে ১৭ শতকে ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকায় আসা লোকেরা ‘মা দিবস’ উদযাপন প্রথম চালু করে আমেরিকাতে। অবশ্য তা টেকেনি। ১৮৭২ সালে জুলিয়া ওয়ার্ড হাও নামের এক নারী সমাজকর্মী নিরস্ত্রীকরণের প্রতি সমর্থন দিতে মহিলাদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি ১৮৭২ সালের ২ জুনকে শান্তির জন্য মা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন। তিনি যুদ্ধের বিরুদ্ধে মা’দের প্রতিবাদী হয়ে উঠতে অনুপ্রাণিত করেন। তিনি দিবসটিকে সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করানোর জন্য চেষ্টা করেন। তবে সফল হতে পারেননি। তার চেষ্টা ছিল বোস্টন শহরকেন্দ্রিক। ১৮৮০ ও ’৯০-এর দশকেও মা দিবস প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলে। তবে স্থানীয় পর্যায়ের বাইরে তার আন্দোলন বিস্তৃত হতে পারেনি। এই দিনের কর্মসূচিতে দুটি সুন্দর বিষয় ছিল। ১. মায়ের সঙ্গে সময় কাটানো, ২. মাকে কিছু উপহার কিনে দেওয়া।

পরবর্তী সময়ে মা দিবস উদযাপনের কৃতিত্ব যার প্রাপ্য তিনি হলেন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার অ্যানা জারভিস। অ্যানা একজন শান্তিবাদী সমাজকর্মী। তিনি নারী অধিকার নিয়ে কাজ করতেন। তিনি ‘মাদারস ডে ওয়ার্ক ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ছোট ছোট ওয়ার্ক ক্লাব বানিয়ে সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের এগিয়ে নিতে চেষ্টা করতেন। নারীদের স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করতেন। ১৯০৫ সালে তিনি এই দিনে সরকারি ছুটি ঘোষণা করানোর জন্য চেষ্টা শুরু করেন। ১৯০৮ সালে তিনি ভার্জিনিয়া ও পেনসিলভানিয়ার কয়েকটি গির্জা প্রধানদের কাছে আবেদন জানিয়ে সেসব গির্জায় মা দিবস উদযাপন করাতে সক্ষম হন। তার আন্দোলনের ফলে যুক্তরাজ্যের কয়েকটি রাজ্য ১৯১০ সালে মা দিবস উদযাপন শুরু করে যেগুলোর মধ্যে ছিল তার নিজের রাজ্য পশ্চিম ভার্জিনিয়া। পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন এ ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেন। তিনি ১৯১৪ সালে প্রতি বছরের মে মাসের দ্বিতীয় রোববার ‘মা দিবস’ ঘোষণা করে এদিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। তখন থেকেই সারা বিশ্বে মা দিবস পালিত হয়ে আসছে। আরও পরে ১৯৬২ সালে মা দিবস আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। বর্তমানে বিশ্বের ৫০টি দেশে প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার বিশ্ব মা দিবস পালিত হচ্ছে।

মা দিবস ও আমাদের বর্তমান তরুণ সমাজ
মা দিবস উপলক্ষে প্রতি বছর আয়োজন করা হয় নানা উৎসবের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যায় ভুরি ভুরি পোস্ট। কেউ মায়ের সঙ্গে ছবি তুলে শেয়ার করছেন তো কেউ বিশাল আবেগি রচনা লিখছেন। কিন্তু বছরের অন্যান্য দিনগুলো কাটে ফেসবুকে ভিডিও দেখে কিংবা সিনেমা দেখে। বিকেল কাটে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাতে। মায়ের সঙ্গে কথা বলার মতো সময়ও যেন এই প্রজন্মের নেই। ‘মা সন্তানের সবচেয়ে ভালো বন্ধু’ এই কথাটি এখন ট্রেন্ড। শুধু মা দিবসেই এসব কথার বন্যা বয়ে যায়। অথচ, মা কোনো কাজে সাহায্য করতে বললে সন্তানের সময় থাকে না। এই প্রজন্ম শুধু শো-অফ করতে জানে। অথচ জানে না মায়ের সঙ্গে কীভাবে গল্প করে একটু সময় কাটানো যায়। কীভাবে মায়ের সঙ্গে হাতে হাতে একটু কাজ করা যায়। অনেকে তো মায়ের সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলতেও দ্বিধাবোধ করে না। বন্ধুর জন্মদিনে হাজার টাকা খরচ করে পার্টি করা যায়, কিন্তু মায়ের জন্মদিনে মাকে জড়িয়ে ধরে শুভেচ্ছা জানাতে পারে না তারা। একদিন মা দিবস পালন করেই ক্ষান্ত তারা। অথচ বছরের ৩৬৫ দিনই মা নিজের কথা না ভেবে তার সন্তানদের কথা ভাবে। তাই প্রতিটি সন্তানের উচিত, প্রতিটি দিনই মা দিবস পালন করা, মা কে ভালো রাখা, মা কে শুভেচ্ছা জানানো, মা কে উপহার দেওয়া। সর্বোপরি, মা কে খুশি রাখা।

মায়ের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব
অনেক সন্তানই সাফল্যের শিখরে পৌঁছে আর পিছনে ফিরে তাকান না। অর্থের দম্ভে ভুলে যায় জন্মদাত্রী মা কেও। ঘরের এক কোনায়ও জায়গা হয়না মায়ের। রেখে আসেন বৃদ্ধাশ্রমে। সন্তান ভুলেই যায় যে, এই মা-ই তাকে জন্ম দিয়েছেন, মায়া-মমতা দিয়ে বড় করেছেন। তার সাফল্যের জন্য মা নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। এই সব সন্তানদের মূল্যবোধ ও মানবিকতা শূন্য। অথচ বৃদ্ধ বয়সে বাবা মায়ের একমাত্র অবলম্বন থাকে সন্তান। শেষ বয়সে সন্তানদের নিয়ে একটু সুখে-শান্তিতে বাঁচতে চান তারা। প্রতিটি সন্তানের উচিত মায়ের প্রতি তার যথাযথ দায়িত্ব পালন করা। শেষ বয়সে বাবা-মায়ের অবলম্বন হওয়া। তাদের শারীরিক যত্ন নেওয়া, মানসিক প্রশান্তির দিকে খেয়াল রাখা। এই কথা মাথায় রাখা যে, তারাও একদিন বাবা-মা হবে। তাহলে আর বৃদ্ধাশ্রমের প্রয়োজন হবে না। সন্তানের সঙ্গে থাকতে না পারার আক্ষেপে দিন কাটাবে না কোনো বাবা-মা। কোনো বাবা-মায়ের দিন কাটবে না দুঃখে- কষ্টে।

কবি সাহিত্যিকদের রচনায় মা
কবি সাহিত্যিকরা মা কে নিয়ে অনেক লিখেছেন। কলমের আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন মায়ের মিষ্টি-মধুর চিরচেনা রূপ। প্রখ্যাত কবি কাজী কাদের নেওয়াজ মা সম্পর্কে তাঁর ‘মা’ কবিতায় বলেছেন : “মা কথাটি ছোট্ট অতি কিন্তু জেনো ভাই/ ইহার চেয়ে নাম যে মধুর ত্রিভুবনে নাই।” কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কালিদাস, শামসুর রহমানসহ অনেকেই লিখেছেন মা কে নিয়ে কবিতা। শওকত ওসমান তার ‘জননী’ উপন্যাসে ফুটিয়ে তুলেছেন মা-সন্তানের সম্পর্ক। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জননী’ উপন্যাসে দেখা মেলে মায়ের চিরায়ত রূপের।

বিশ্বের সব দেশে সব মা-ই এক, কিন্তু আমাদের বাংলাদেশের মায়েরা যেন তারপরও আলাদা। মনে হয়, আমাদের মায়েরা সন্তানের জন্য বুকের সবটুকু স্নেহ ভালোবাসা যেমন নিঃশেষে উজাড় করে দেন, আর কোনো দেশের মায়েরা বুঝি এত মমতা ও স্নেহ ঢেলে দেন না। বাঙালি মায়েরা শাড়ির আঁচলে সন্তানকে ঢেকে রাখেন। এ দেশের আটপৌরে মায়েরা এক সময় সন্তানের জন্য পিঠা বানিয়ে শিকেয় ঝুলিয়ে রাখতেন। রাতে কুপি বাতি জ্বালিয়ে ভাত নিয়ে ছেলের ফেরার আশায় বসে থাকতেন। উৎকর্ণ হয়ে থাকতেন ওই বুঝি ছেলের পায়ের আওয়াজ শোনা যায়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ূয়া ছেলে গভীর রাতে দূর এলাকা থেকে ফিরেছে। মা নিজের ঘুম, সুখ বিসর্জন দিয়ে মাটির চুলায় ছেলেকে দু’মুঠো ভাত রেঁধে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। প্রচন্ড গরমে ছেলে ঘেমে নেয়ে উঠেছে। মমতাময়ী মা তালের পাখা নিয়ে বাতাস করে চলেছেন যাতে সে একটু আরামে ঘুমাতে পারে। ছেলে দূরের শহরে চাকরি করে। মা তার কথা ভাবেন। সেই কবে ছেলেটা গেছে। গ্রীষ্ম যায়, বর্ষা আসে। তারপর একদিন কুমড়োর ফুলে ফুলে নুয়ে পড়ে লতা। মা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবেন, তুই কবে আসবি খোকা! বাঙালি মায়ের এ চিরন্তন ছবি বিশ্বের আর কোথাও মেলে না। এখন অবশ্য সময় পাল্টে গেছে। প্রযুক্তি আমাদের জীবনে অনেক পরিবর্তন এনেছে। এখন সন্তানের জন্য মায়েদের কষ্ট-দুঃখ-দুশ্চিন্তা অনেক কমে গেছে। দূরে থাকা ছেলের কুশল জানার জন্য এখন আর মাকে চিঠির অপেক্ষায় থাকতে হয় না। মোবাইল ফোন কথা বলা সহজ করে দিয়েছে। একটু চেষ্টা করলে স্কাইপে সন্তান-মায়ের দেখা-কথা দুই-ই হতে পারে। কিন্তু সন্তানের জন্য মায়ের উদ্বেগ-দুশ্চিন্তা আগেও যেমন ছিল আজো তেমনি আছে।

মা দিবসে মাকে খুশি করাই কিন্তু সন্তানের প্রথম ও প্রধান কাজ। সাধ্যমতো মায়ের জন্য পছন্দের কিছু জিনিস উপহার দেয়া, তার কাছে বসে থাকা, তার কাছে সময় কাটানো, কথা বলা, কিছু রান্না করে খাওয়ানো, কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি নানা কিছু করা যায়। মা তাদের জন্য কী করেছেন, কীভাবে মুখে তুলে খাইয়েছেন, অসুস্থতায় না ঘুমিয়ে না খেয়ে সন্তানের সেবা করেছেন, কচি হাত ধরে পা পা করে হাঁটতে শিখিয়েছেন, স্কুলে নিয়ে গিয়েছেন, রোদ-বৃষ্টি সহ্য করে ছুটি না হওয়া পর্যন্ত ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছেন এগুলো কোনো সন্তানেরই ভোলার কথা নয়। অর্থ দিয়ে তার প্রতিদান দেয়া যায় না, যায় শুধু মাকে ভালোবেসে। তিনি তার যৌবনে সন্তানকে যা দিয়েছেন, বার্ধক্যে সন্তানের কাছ থেকে সেটাই তার প্রাপ্য। এটা ঠিক যে, কোনো মা’ই তার সন্তানের কাছ থেকে এ রকম বিনিময় পাওয়ার জন্য দর-কষাকষি করেন না, কিন্তু প্রতিটি সন্তানেরই উচিত মাকে সে রকম দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে না দেয়া। সব সন্তানেরই এটা মনে রাখা উচিত যে তার জীবনের প্রথম উচ্চারিত শব্দ ছিল ‘মা’। পৃথিবীর সব মা কে মা দিবসের শুভেচ্ছা।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ