Skip to content

২রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বৃহস্পতিবার | ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নারীর আত্মবিশ্বাসই তার জন্য ঘৃণা নিয়ে আসে!

সম্প্রতি একটা খবরের কাগজের ফেসবুক পেজে একটি খবর শেয়ার করা হয়। সেখানে লেখা হয়েছে একজন বহুল পরিচিত চিত্রনায়িকা আহত হয়েছেন। এবং তিনি হাসপাতালে ভর্তি৷ এই খবরে প্রায় শতাধিক হাসির প্রতিক্রিয়া। রয়েছে অনেক আপত্তিকর মন্তব্যও। 

 

উল্লেখ্য, এই চিত্রনায়িকা এখন গর্ভবতী।  তিনি হাসপাতালে ভর্তি আছেন,  আহত হয়েছেন বিষয়টি বেশ আশংকামূলক। যেহেতু, তিনি গর্ভবতী তাঁর আহত হওয়াতে তাঁর অনাগত সন্তানের ক্ষতির সম্ভাবনা প্রবল। 

 

কিন্তু এই সব ক্ষতির আশংকা বা তার ভয়াবহ প্রভাব, একজন নারীর ব্যক্তি-জীবনে কতটা পড়তে পারে, সে বিষয়ে কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। মানুষ হৃদয়হীন কোনো প্রাণীর মতো এ-রকম একটা সেনসিটিভ বিষয় নিয়েও হাসি-তামাশা করছে! 

 

হাসি-তামাশা করার কারণ হচ্ছে, এই চিত্রনায়িকা বেশ সমালোচিত একজন। একই সাথে উনি প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী এবং পরোয়া-বিহীন জীবনযাপন করেন। কিন্তু এই সমাজে একজন নারীর অপ্রীতিভাজন মানুষ কিভাবে পরিণত হয়? কোন ভিত্তিতে?

 

উত্তর তেমন কঠিন কিছু না। এটা একটা ওপেন সিক্রেট। সবাই বলবে নারীরা স্বাধীন হবে,  আত্মনির্ভরশীল হবে এবং কে কি বলল, তাতে নারীর কোনো কিছু আসা-যাওয়া যাবে না। কিন্তু আদতে এই আত্মনির্ভরশীল এবং সাহসী নারীদেরই এই সমাজ ঘৃণা করে। 

 

হুমায়ুন আজাদ একবার বলেছিলেন, 'মানুষ সিংহের প্রশংসা করে, কিন্তু আসলে গাধাকেই পছন্দ করে' আমরাও এই রকম। আমরা নারী-স্বাধীনতা নিয়ে চিৎকার করে কণ্ঠস্বর ছিঁড়ে ফেললেও আমরা বিশ্বাস করি, নারী-স্বাধীনতা নারীর পোশাক এবং ভৃত্যসুলভ আচরণেই নিহিত।

 

নারীকে আমরা যতই বলি, 'চিৎকার করো দেখি মেয়ে, কতদূর তোমার গলার আওয়াজ শোনা যায়, আমাদের শুধু মোমবাতি হাতে নীরব থাকা দায়।' তবু, আমরা সেই চিৎকার শোনার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত নই। আমরা এখনো আগে ভিক্টিম ব্লেমিং করি, তারপর যদি একটু-আধটু নীতিবোধ প্রশ্নবিদ্ধ করে, তখন আমরা বিচার চাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করিমাত্র। কিন্তু এই মানসিকতা আমাদেরকে কতখানি যে পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সামনে আরো যাবে, সেটা নিয়ে আমরা কখনো ভেবে দেখি না। 

 

এই মানসিকতা আসলে আমাদের তৈরি করতে সাহায্য করেছে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা।  সাহায্য শব্দটা যুতসই না অবশ্য। শব্দটা হবে চাপিয়ে দেওয়া। 

 

পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো এবং পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা আমাদেরকে রোজ বাধ্য করে, এই সমাজে টিকে থাকতে হলে আমাদেরকে মানসিকভাবে পুরুষতান্ত্রিক হতে হবে। তা না হলে এই সমাজে টিকে থাকা আমাদের জন্য দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।  

 

মানুষ যখন একপর্যায়ে বুঝে যায় যে, এই কাঠামোতে জীবনযাপন করতে হলে তাকে এই কাঠামোর মতোই চিন্তা-ভাবনা করতে হবে, তখন সে এই অন্যায় মানসিকতাই ধারণ করে চলে। এবং দিন দিন সে এটাকেই সঠিক ধারা বলে বিবেচনা করে। 

 

কিন্তু ই ধারণা পোষণ করা যে একটা সমাজের জন্য কত ক্ষতিকর, সেটা কেউ ভেবেই দেখে না।  ভেবে দেখতে চায় না। কারণ, এই একবিংশ শতাব্দী হলো হতাশ হওয়ার শতাব্দী,  ক্লান্ত হওয়ার শতাব্দী।  যে সময়টায় আত্মহত্যা এবং শারীরিক যৌন হয়রানি থেকে শুরু করে মৌখিক যৌন হয়রানি একটি অতি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে গেছে। 

 

আবার অনেক ক্ষেত্রে মানুষ অনেক উন্নত স্বাধীন চিন্তাধারাও বহন করছে। কিন্তু সেগুলোও সুবিধাজনক অবস্থায়। আবার অনেকে চক্ষুলজ্জার  জন্য নিজেকে ধরেবেঁধে, দাঁতে দাঁত চেপে হয়তো নিজেকে আধুনিক যুগে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাতেও কি সার্বিক কাঠামোর কোনো বিন্দু পরিমাণ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে? আমরা এখনো কোনো নারীকে তার নিজের অধিকার নিয়ে কথা বলতে দেখলে, পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত জীবনযাপন করতে দেখলে, তাকে ঘৃণা করা শুরু করি। 'নারীবাদ' শব্দটিকে হাসির ছলে করে হলেও পারলে গালির অভিধানে অন্তর্ভুক্ত করি। 

 

দেবী পূজা করি ঠিকই। নারী দিবসেও নারীকে নিয়ে কতশত আয়োজন করি। অথচ, নারীর আত্মনির্ভরশীলতাকে অস্বীকার করি। কিন্তু আদতে মনে ধারণ করি সেই বাক্য, 'মানুষ সিংহের প্রশংসা করে, কিন্তু আসলে গাধাকেই পছন্দ করে।'
 

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ