লন্ডনের মাঠে সামাদের এক হালি গোল
সাধারণত জাদুকর বলতে যারা বিভিন্নভাবে মানুষের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ভেলকি দেখিয়ে মুগ্ধ করেন তাদেরই বোঝায়। ক্রীড়া-ক্ষেত্রে খুব বেশি মানুষকে জাদুকর বলে ডাকা হয় না। বর্তমান যুগের ক্রীড়াবিদদের মাঝে লিওনেল মেসিকে ক্ষুদে জাদুকর বলেন অনেকে। এছাড়া রোনালদিনহো, স্ট্যানলি ম্যাথিউসকে এর আগে দেয়া হয়েছে এই উপাধি। অথচ খোদ আমাদের দেশে এমন একজন ফুটবলার ছিলেন, যাকে ডাকাই হতো জাদুকর নামে।
সেই জাদুকরের নাম সৈয়দ আবদুস সামাদ। তাঁর ফুটবলশৈলীতে সবাই এতটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল যে তাঁর মূল নামের অংশই হয়ে যায় ‘জাদুকর’ শব্দটি। এমনকি তাঁর কবরের স্থাপিত নামফলকেও লেখা রয়েছে ‘জাদুকর সামাদ’। কিন্তু এমন একজন ফুটবলার সম্পর্কে যেখানে সবার জানার কথা, সেখানে তিনি হারিয়ে গেছেন বিস্মৃতির অতল গহ্বরে। তাঁকে নিয়ে একটা গল্প প্রচলিত আছে।
ঘটনাটি ১৯৩৩ সালের। সর্ব ভারতীয় ফুটবল দল লন্ডনে গেছে লন্ডনের ফুটবল দলের বিরুদ্ধে ফুটবল খেলার জন্য। লন্ডনীরা প্রথমে ভারতীয় দলের সঙ্গে খেলতে চায় নি, নাক সিঁটকিয়েছে, পাত্তা দেয়নি। পড়ে যখন শুনলো সামাদ নামের একজন ভারতীয় খেলোয়াড় নাকি চ্যালেঞ্জ দিয়েছে যে, সে গুণে গুণে এক হালি গোল করবে লন্ডনীদের বিরুদ্ধে, তখন সেই খেলোয়াড়টিকে নাকানি চুবানি খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে তারা খেলতে রাজী হয়। খেলা শুরু হয়েছে, মাঠ লোকে লোকারণ্য। সামাদ নামের সেই নেটিভ ইন্ডিয়ানটি কিরকম নাস্তানাবুদ হয় তা দেখার জন্য দলে দলে সাহেব মেমরা মাঠে হাজির হয়েছে।
কিন্তু সামাদ সাহেবের খেলায় তেমন মনোযোগ নেই, তিনি এক পোয়া বাদাম কিনে কুট কুট করে তা চিবুচ্ছেন। সাহেবদের দল ভারতীয় দলকে কোণঠাসা করে ফেলেছে, কিন্তু তবুও সামাদ সাহেবের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তখন দলের সবাই সামাদ সাহেবকে অনেক কাকুতি মিনতি করতে লাগলো, অবশেষে সামাদ সাহেব বল ধরলেন। একে একে সবাইকে কাটিয়ে গোলে শট নিলেন, কিন্তু গোল হলো না, বল পোষ্টে লেগে ফিরে এলো।
সামাদ তখন রেফারীকে বললেন, ক্রস বারের হাইট ঠিক নেই, মেপে দেখুন। রেফারী ফিতে দিয়ে মেপে দেখেন তাজ্জব ব্যাপার! সত্যি ক্রস বারের হাইট চার ইঞ্চি কম। রেফারী সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে গোল ডিক্লেয়ার করলেন। এরপর গুণে গুণে আরও তিনটি গোল করলেন। সাহেবরা গুণের কদর করতে জানে, সামাদ সাহেবকে তারা ফুটবল যাদুকর উপাধি প্রদান করলো। ফুটবল জাদুকর সামাদ। যিনি কিনা পেলে, ম্যারাডোনা, ষ্টেফানো, গারিঞ্জা, বেকেনবাওয়ার, পুস্কাসের বহু বছর আগেই ফুটবলকে দান করেছিলেন শৈল্পিকতা, আর নৈপুণ্যতা। মূলত তাঁর একক নৈপুণ্যে সর্বভারতীয় ফুটবল টিম তৎকালীন গ্রেট ব্রিটেনের মত শক্তিশালী টিমকে ৪-১ গোলে আর ইউরোপীয় টিমকে ২-১ গোলে পরাজিত করে। হতবাক হয়ে যায় পুরো ইউরোপের ফুটবল যোদ্ধারা।
তাঁর বর্ণাঢ্য ফুটবল ক্যারিয়ারের সূচনা হয় কিন্তু রংপুরের তাজ ক্লাবের হয়ে। সেখান থেকে তিনি যোগ দেন কলকাতার এরিয়েন্স ক্লাবে। পরবর্তীতে তিনি ইষ্ট বেঙ্গল রেলওয়ে ক্লাব, কোলকাতা মোহনবাগান, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের হয়েও খেলেছেন। ক্যারিয়ারের শেষের দিকে তিনি কোলকাতা মোহমেডানের হয়ে কিছুদিন খেলেছেন।
আমাদের দেশের মানুষেরা পেলে চেনে, ম্যারাডোনা চেনে, হালের মেসি , রোনালদো, নেইমারকে চেনে, কিন্তু দেশের গর্ব সামাদ জাদুকরকে চেনে না। ভাল মত জানে না। অবশ্য দোষ দিয়েও লাভ নেই। বাংলাদেশ ফুটবল নিয়ে কোন আগ্রহ নেই। এদেশের ফুটবল ফেডারেশনও জানানোর ব্যবস্থা করে না, পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি করে না, তখন সবাই জানবে কিভাবে?
বিহারের পুর্ণিয়ায় জন্ম গ্রহণকারী এই কৃতি মানুষটি সাতচল্লিশে ভারত বিভক্তির পর কলকাতা থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে এসেছিলেন। তখন বোধ হয় বয়স-জনিত কারণে আর খেলতেন না, সরকার তাঁকে রেল বিভাগে একটি চাকুরী প্রদান করেছিলো। তিনি থাকতেন দিনাজপুরের পার্বতীপুরে, সেখানেই মৃত্যু হয়েছিল এই কিংবদন্তি ফুটবলারের।