Skip to content

৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শনিবার | ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘রান্নায় লবণ কম হওয়া দোষের নয়!’ 

সকালে ঘুম থেকে উঠে বেশ তাড়াহুড়ো করে খাবার টেবিলে বসেন কবির মিয়া, ঐদিকে অফিসে দেরী হয়ে যাচ্ছে। তবে খাবার শেষে উঠতে উঠতে তিনি কয়েকটি শব্দে একটি বিষয় মনে করিয়ে দেন, 'আজ রান্নায় লবণ কম হয়েছে'।  আর এ কথা শুনে গৃহিণী নাজমার চোখমুখে মুহূর্তেই এক অপরাধবোধ কাজ করা শুরু করে। 

 

শুধু রান্নায় লবণ কম হওয়া নয়। কখনো রান্নায় লবণ বেশি হওয়া, কখনো ঝাল কম-বেশি হওয়া। প্রতিবেলায় খুব সূক্ষ্মভাবে এসব ভুল ধরার কাজ করেন কবির মিয়া।  আর প্রত্যেকবারই এক অদ্ভুত অপরাধবোধে ভুগেন নাজমা বেগম। এসব ঘটনা কেবল কবির মিয়ার ঘরেই নয় আমাদের সমাজের প্রায় প্রত্যেকটি ঘরের নিয়মিত দৃশ্য। 

 

সময় অনেকটা এগিয়েছে। এখন নারীদের পড়াশোনা কিংবা কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ আগের তুলনায় অনেকটাই বেশি। কিন্তু তাই বলে চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী ঘরের কাজ থেকে নারীদের ছুটি মেলেনি। বরং দশভুজার মত ঘরে-বাইরে সমানতালে সামলাতে হচ্ছে। যারা পাক্কা গৃহিণী, তাদের কাজও নেহাত কম নয়। কাকভোর থেকে রাত পর্যন্ত তারা লেগে থাকে সংসারের কাজে।  

 

অফিস ছুটি থাকার যে দিনটিতে পুরুষরা আরাম-আয়েশ করে নিশ্চিন্তে দিব্যি ঘুমে দিন পার করে, ঠিক সেই দিনটিতে নারীরা রান্নাঘরে ভালো খাবার-দাবার তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন। দিনটিতে কর্মজীবী নারীদের ছুটি হয়েও যেন ছুটি মিলেনা। আবার গৃহিণীদের কাজের চাপ বরাবরের তুলনায় বেড়ে যায় কয়েকগুণ। তবুও দিনশেষে খাবার প্লেট এগিয়ে দিয়ে আতঙ্কে থাকেন তারা। মনের মধ্যে ঘুরপাক খায় হাজারো প্রশ্ন, 'আজ লবণ ঠিক হয়েছে তো, ঝাল ঠিকঠাক আছে তো,  রান্নার রঙই বা কেমন হল ' 

 

যেন অদৃশ্য এক প্রতিযোগিতা চলছে। সামনে বিচারক বসে আছে, লবণ কম হলেই প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়ার আশঙ্কা। আতঙ্ক শেষে কেউ কেউ লবণ, মরিচ ঠিকঠাক দেয়ার পরীক্ষায় পাশ করে গেলেও কারো চুপচাপ শুনতে হয় 'লবণ কম হয়েছে, ঝাল বেশি হয়েছে ' এমনসব উক্তি৷ আর মুহূর্তেই সেই নাজমা বেগমের মত প্রতিটি নারীই এক অপরাধবোধে ভুগতে থাকে। 

 

আসলে এ দায় কারোর একার নয়। এ দায় পুরো সমাজব্যবস্থার। যেখানে প্রায় প্রতিটি ঘরেই জন্মের পর থেকে একজন ছেলে শিশুকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট বানানোর পরিকল্পনা চলে আর একজন কন্যা শিশুকে জন্মের পর মাস্টারশেফ বানানোর পরিকল্পনা চলে। যদিও প্রগতিশীল কিছু পরিবার তাদের কন্যাসন্তানকেও ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানানোর স্বপ্ন দেখে তবুও তার সাথে জুড়ে দেয় একটি বাক্য, 'যত যাই করো, মেয়ে হয়েছে আগে রান্না তো শিখতেই হবে!' 

 

এরপর থেকে প্রতিটি মেয়ে শিখতে শুরু করে তিনি মেয়ে আর যাই হোক তার রান্নায় হতে হবে পাক্কা ওস্তাদ। আর যাই হোক রান্নায় ভুল করা যাবে না। তার জন্য এ ভুল 'মহা অন্যায়' বললেও ভুল হবে না। আর এ বিষয়টি তাদের মাথায় ভালোভাবে সেট করার জন্য চোখের সামনে উদাহরণ হিসেবে থাকে কবির মিয়ার মত রান্নায় ভুল ধরা তাদের ঘরের কোন সদস্যরা এবং নাজমা বেগমের মতো চুপ করে অপরাধবোধে ভোগা  নারীরা। 

 

আর এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলছে নারীদের মাস্টারশেফ বানানোর অদৃশ্য এক প্রতিযোগিতা। আর এর শেকড় এতটাই গভীরে বিস্তৃত যে প্রায় অনেক বিষয়ে নারী আজ প্রতিবাদ করতে শিখলেও রান্নায় লবণ কম হওয়াকে নারী এখনো অন্যায় বলেই মনে করেন। তাই এ বিষয়ে আওয়াজ তোলার আগে নারীকে জানতে এবং মানতে হবে, 'রান্নায় লবণ কম হওয়া দোষের নয়! '

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ