Skip to content

৯ই মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বৃহস্পতিবার | ২৬শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এমিলি মারফি: নারীর ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা’ ও ‘ব্যক্তি-অধিকার’ আদায়ের পথিকৃত

আধুনিক ইউরোপের জ্ঞান ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদানের দিকেই সমগ্র বিশ্ব তাকিয়ে থাকে। অথচ খোদ ইউরোপেই নারীরা কখনো নিজেদের অধিকার সম্পূর্ণভাবে পায়নি।

 

আইনের হর্তাকর্তা পুরুষ, তাই নারীদের পক্ষে কথা বলার মতো কেউ কি ছিল? হ্যাঁ, হতে পারে আইন নির্মাণের ক্ষেত্রে কোনো নারী থাকতে পারেনি। কিন্তু নিজেদের অধিকার নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে? এমনকি সর্বপ্রথম নিজেদের লেখাপড়ার অধিকারও ছিনিয়ে আনতে নারীকে নিজেদেরই আইনের সাহায্য নিতে হয়েছে।

 

কিন্তু সেই যুদ্ধে যদি নারী আইনজীবী না থাকে, তাহলে কতটা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে অধিকার আদায়ের লড়াই? বিশেষত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আইনের একটি অদ্ভুত নিয়ম ছিল, 'নারীদের ব্যক্তি হিসেবে গণনা করা হবে না।'

 

এর মানে খুব সরল। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ তো দূরের কথা, তাদের ব্যক্তি-অস্তিত্বেরই কোনো স্বীকৃতি ছিল না। ফলে সিনেটে নারী প্রতিনিধি পাওয়ার কোনো আশা ছিল না। কিন্তু সিনেটে না বসতে পারলে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সাফল্য কত দূর আশা করা যায়? ঠিক সে-সময়ই আমরা এমিলি মারফিকে দেখতে পাই।

এমিলি মারফি কানাডা এমনকি গোটা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম নারী পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট। ব্যক্তিগত জীবনে প্রচণ্ড সাহসী এই নারী ভালোর জন্যে যেকোনো কিছুতেই ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহী ছিলেন। সমগ্র বিশ্বে তিনি তার 'নারীর ব্যক্তিগত পরিচয় প্রতিষ্ঠা'র কেসের জন্যেই জনপ্রিয়। কিন্তু এই কেসটি তাঁর বাকি জীবনের ঘটনাবহুল কাজের সূচনা বলেই ধরে নেওয়া যায়।

 

১৮৬৮ সালের ১৪ মার্চ কুকস্টাউনে জন্ম নেয়া এমিলি মারফির পরিচয় আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে প্রথম নারী ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার সাথে সাথেই। এর আগেও তিনি লেখালেখি, সাংবাদিকতায়ও নিজের হাত পাকিয়ে নিয়েছিলেন। তাই মহৎ এক ভবিষ্যতের সূচনার ভীত তিনি নিজেই গড়ে নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে নারী ও শিশুদের পক্ষে বহু কার্যক্রমে তিনি জড়িত ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে কানাডিয়ান নারী প্রেস ক্লাব, ন্যাশনাল কাউন্সিল অব উইমেন, ফেডেরেটেড উইমেন্স ইন্সটিটিউটসহ আরো ২০টি নারী ও শিশু বিষয়ক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি।

একবার এমিলি স্বামীর সাথে কান্ট্রি সাইডে ঘুরতে বেরোলেন। সেখানে গৃহহীন ও কপর্দকশূন্য এক নারীর সাথে দেখা। জানা গেলো, তার স্বামী তাদের খামার বিক্রি করে দিয়েছে। তারপর টাকাপয়সা নিয়ে পালিয়ে গেছে। এমিলি অবাক হয়ে গেলেন, যখন আবিষ্কার করলেন আঠারো বছর ফার্মে কাজ করার পরও এই নারীর জন্য আইনিভাবে কোনো কিছু করা সম্ভব না।

এমিলিকে এই ঘটনা ব্যাপক নাড়া দেয়। পরবর্তী কয়েক বছর এমিলি এই বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। এরই মধ্যে এমএলেএদের বিষয়টির গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করেন তিনি। ১৯১৭ সালে আলবার্তা লেজিস্লেচারে সর্বপ্রথম ডাওয়ার আইন পাস হয়। এই আইন অনুযায়ী একজন স্ত্রী তার স্বামীর সম্পত্তির তিন ভাগের এক ভাগের মালিকানা পাবে। যদিও এই আইন অন্যান্য প্রদেশে কার্যকর করতে বহু বছর পার হয়ে গিয়েছিল।
 

সে-সময় নারীদের সমস্যা মিটানো হতো লোকাল কাউন্সিল অব উইমেনের মাধ্যমে। কিন্তু ডাওয়ার অ্যাক্টের সময় এমিলির ভূমিকা থেকেই একজন নারী ম্যাজিস্ট্রেটে প্রয়োজনীয়তা সবাই তুলে ধরতে শুরু করে। অ্যাটর্নি জেনারেল এই বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথেই বিবেচনা করেন এবং এমিলিকে ১৯১৬ সালে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এমিলি তো অবাক! তিনি এই আকস্মিক ব্যাপারে অবাক হয়ে লেখেন, 'আমার জন্য চমৎকার এক অভিজ্ঞতা। যেন গাইড ছাড়াই একা একা দৌড়ে চলেছি প্রবল উত্তেজনা নিয়ে।'
 

এবার মারফির পরিচয় হয়ে গেল 'জাজ মারফি।' কিন্তু কোর্টে প্রবেশের আগের দিন থেকেই তাঁর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন ছোড়াছুড়ি শুরু হয়। আর্ডলি জ্যাকসন নামের একজন উকিল এই নিয়োগকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। ব্রিটিশ নর্থ আমেরিকা অ্যাক্ট-১৮৬৭ অনুযায়ী নারীদের একজন ব্যক্তি নিজেকে গণ্য করা হয় না। কিন্তু সেই সময় জাজ বিষয়টি ঠান্ডা মাথায় ওভাররুল করে দেন। অবশেষে ১৯১৭ সালে আলবার্টা সুপ্রিম কোর্ট এই সমস্যার মীমাংসা করে। নারীরা পায় 'ব্যক্তি'র মর্যাদা। কিন্তু ফেডারেল এবং প্রাদেশিক পরিষদের কার্যক্রম তো এত সহজে সম্পন্ন করা সম্ভব না।
 

এমিলি ভেবে দেখলেন, এখন এ-নিয়ে কাজ করতে হবে। তিনি প্রধানমন্ত্রী স্যার রবার্ট বোর্ডেনের কাছে সিনেটের সদস্যপদ চেয়ে পত্র পাঠান। তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আইন অনুসরণে এই আবেদন বাতিল করে দেন। কারণ, ব্রিটিশ কমন ল রুলিং-১৮৭৬ অনুযায়ী, 'নারীরা শাস্তি এবং অন্যান্য অপরাধের শাস্তি পাবে, কিন্তু তারা নিজস্ব অধিকার এবং সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের আবেদন করতে পারবে না।'

এবার এমিলি ক্যাম্পেইন শুরু করেন। অন্তত ৫ লাখ কানাডিয়ান মারফির সিনেট সদস্যপদের পক্ষে সাক্ষর করেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী বোর্ডেন এবং ম্যাকেঞ্জি কিং-ও তাঁকে সিনেটের সদস্যপদ দিতে রাজি ছিলেন। কিন্তু ১৮৭৬-এর আইন তাঁদের হাত বেঁধে রেখেছে। এই আইন পরিবর্তন না করলে কোনোভাবেই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব না।

এমিলি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এই আইন বদলাবেন। এমিলির ভাই ছিলেন একজন আইনজীবী। ভাইয়ের সাহায্যেই তিনি সুপ্রিম কোর্টে লড়াই শুরু করেন। নারীরা সিনেটর কেন হতে পারবে না এবং এর সাংবিধানিক বৈধতা প্রশ্ন করতে গেলেও সমস্যা আছে। অন্তত পাঁচজন নাগরিকের কাছ থেকে এই আপত্তি আসতে হবে। কিন্তু এমিলির জন্যে এটি কোনো সমস্যাই ছিল না। হেনরিয়েটা মুইর এডওয়ার্ড, নিল ম্যাকক্লাং, লুই ম্যাককিনি, আইরিন পার্লবাই এবং এমিলি-এই পাঁচজন প্রশ্নবিদ্ধ করলেন এই আইনকে।
 

বিচার বিভাগ অবশ্য তাঁদের প্রশ্নকে পাত্তা না দিয়ে প্রধানমন্ত্রী কিং-কে জানালেন, সুপ্রিম কোর্টে বরং আপিল করতে হবে ওই আইনে 'ব্যক্তি'র মধ্যে নারী আছে কিনা। ১৯২৮ সালের ১৪ মার্চ এ-নিয়ে বিচার বসে। এমিলির জন্মদিনে অবশ্য হাসিমুখে ফেরা হয়নি। দিনব্যাপী তর্ক শেষে কানাডার সুপ্রিম কোর্ট নারীদের বিরুদ্ধে রায় দেয়।

কিন্তু এই বিখ্যাত ৫ ব্যক্তি হার মানেননি। তাঁরা প্রধানমন্ত্রী ম্যাকেঞ্জি কিং-এর অনুমোদন নিয়ে লন্ডনের প্রাইভি কাউন্সিলের জুডিশিয়াল কমিটির কাছে আপিল করেন। এই প্রতিষ্ঠানটিই তখন কানাডার জন্য সত্যিকারের সুপ্রিম কোর্ট। আরো কয়েক মাস প্রতীক্ষার পর এমিলি তাঁর আকাঙ্ক্ষিত উত্তর পেয়ে গেলেন। ১৯২৯ সালের ১৮ অক্টোবর, প্রাইভি কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নিল যে, নারীরাও ব্যক্তি এবং তাঁরা সিনেটের সদস্যপদ পেতে পারে।

এত সংগ্রামের পরেও এমিলি প্রথম নারী সিনেট সদস্য হননি। কাইরিন উইলসনকে এই অনুমোদনের পাঁচ মাস পর সিনেট সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তী নারীদের জন্য তিনি গড়ে দিয়েছেন এক গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ।

 

এমিলির মূল উদ্দেশ্য অবশ্য সিনেট সদস্য হওয়া ছিল না। বরং নারীদের ও শিশুদের জন্য তিনি সব সময় কাজ করে গিয়েছেন। ১৯৩১ সালে তাঁর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী আর বি ব্যানেট বলেন, 'কানাডার আর কেউই তাঁর নিজের দেশের জনগণের সেবায় নিজেকে এতটা নিয়োজিত করেননি, যতটা এই মহীয়সী করেছেন। তাঁর চেয়ে যোগ্য আর কোনো নারীই এই সিনেটে থাকতে পারেন না।'

 

এমিলি মাত্র ৬৫ বছর বয়সে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর মুসোলিয়াম ড্রয়ারে সব অর্জনের নথি সংরক্ষণ করতেন। সেখানে ঘাঁটলেই বোঝা যাবে এই 'ব্যক্তি'-অধিকার আইনটি নিয়ে কাজ তাঁর জীবনের অন্যান্য কাজের সূচনামাত্র। কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে নারীর গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে এমিলি মারফি নামটি অবশ্যই একদম প্রথমে উঠে আসবে।

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ