স্কুল-কলেজে ২ দিন ছুটি: কার লাভ, কার ক্ষতি?
স্কুল-কলেজে সাপ্তাহিক ছুটি ২ দিন নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। গত ২২ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাপ্তরিক ওয়েবসাইটে এই ছুটি সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিশ্বব্যাপী করোনা কারণে দুই বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। শিক্ষার্থীরা পাঠবিমুখ হয়ে পড়েছিল। এর বাইরে দেশে বাল্যবিয়ের হিড়িকও পড়েছিল। সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতে এবার দেশের বিদ্যুৎ-জ্বালানি সাশ্রয়ের লক্ষ্যে স্কুল-কলেজে সাপ্তাহিক ছুটি ২ দিন নির্ধারণ করা হলো। এই ২ দিন ছুটি কতটা শিক্ষাবান্ধব হলো, তা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি দুদিনের বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক নওরিন আফরোজ। তিনি বলেন, ‘বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে দুই দিন বন্ধ রেখেই শিক্ষাব্যবস্থা বহাল তবিয়তে আছে। আমাদের চেয়ে ভালোই আছে। আমার চোখে নেতিবাচক দিক ধরা পড়ছে না।’
বাংলাদেশের ইংলিশ মিডিয়ামে দুই দিন ছুটি আগে থেকেই আছে উল্লেখ করে নওরিন আফরোজ বলেন, ‘তাতে তো তাদের লেখাপড়া বাধাগ্রস্ত হয়নি। আর তাছাড়া, শিক্ষার্থীরা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডলোতে আরও বেশি নিজেদের দক্ষ করে তোলার সময় পাবে, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাবে, এটা তাদের নিজেদের বিকাশে আরও বেশি সহায়ক হওয়ার কথা। মেশিনের মতো না দৌড়ে মানবিক মানুষ হয়ে উঠতে পারবে।’
প্রায় একই অভিমত জানালেন রহনপুর আহম্মদী বেগম সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী শিক্ষক মোসা. শামীমা সুলতানা ছন্দাও। তিনি বলেন, ‘করোনা আমাদের আবেগ, অনুভূতি, বেগ সব কিছুই কেড়ে নিতে বসেছিল। সে সময়টা আমরা কিছুটা হলেও অতিক্রম করে উঠতে পেরেছি। স্কুল, কলেজ আগের মতোই স্বাভাবিক নিয়মে চলছে। কিন্তু বিশ্ব এক মহামারি কাটিয়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গেই উন্নত দেশগুলো নিজেদের মধ্যে কোল্ড ওয়ার শুরু করেছে। আর সেই কোল্ড ওয়ারের ঢেউ অনুন্নত, উন্নয়নশীল দেশসহ পুরো বিশ্বের ওপর পড়েছে।’
বাংলাদেশও এই প্রভাবের বাইরে নয় মন্তব্য করে শামীম সুলতানা আরও বলেন, ‘বাইরে নয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও।অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে-করোনাকালীন সময় আমাদের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। এ সময় তাদের মোবাইলফোনের প্রতি আসক্তি বেড়ে যায়। বাল্যবিবাহর কারণে অনেক ছাত্রীর পড়াশোনা শেষ হয়ে যায়। যার প্রভাব এখনো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। পড়াশোনা থেকে এই যে বড় গ্যাপ এটা কাটিয়ে ওঠার একটাই উপাই, তাদের ঠিকমতো কাউন্সেলিং করা, হোমওয়ার্ক দেওয়া। আবার এটাও সত্য হঠাৎ করে এত চাপ তারা নিতে পারবে না। আর যারা কাউন্সেলিং করবেন, তাদেরও রিফ্রেশমেন্টের প্রয়োজন।’
সাপ্তাহিক ছুটি দুদিনের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে এই শিক্ষক বলেন, ‘এই দিক দিয়ে ২ দিন ছুটি যৌক্তিক বিষয়। আবার শিক্ষকদের, ছাত্রছাত্রীদের রিফ্রেশমেন্ট বাদ দিলেও বৈশ্বিক পরিস্থিতিকে আমরা এড়িয়ে চলতে পারি না। যেখানে ডিম, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে গেছে, সেখানে মধ্যবিত্তের খেয়ে পরে বেঁচে থাকাটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য হলেও ২ দিন ছুটির যৌক্তিকতা রয়েছে। অন্যদিকে, শিক্ষকও একজন সরকারি কর্মচারী। সরকারি কর্মচারী হিসেবে যদি একজন অধিদপ্তরের লোক, একজন মন্ত্রণালয়ের লোক ২ দিন ছুটি পায়, তাহলে একজন শিক্ষক কেন ২ দিন ছুটি পেতে পারে না! তাই সার্বিকভাবে চিন্তা করে, একজন শিক্ষক হিসেবে আমি মনে করি ২ দিন ছুটির আবশ্যক।’
দেশ বা রাষ্ট্র বিভিন্ন সময়ে নানামুখী সমস্যা সম্মুখীন হতে পারে বলে মনে করেন লেকচার পাবলিকেশন্স-এর লেখক ও সম্পাদক নূর ইয়াসমিন নীলিমা। তিনি বলেন, ‘এজন্য পরিবর্তন আসতে পারে জীবন ও জীবিকায়। বর্তমানে বাংলাদেশ যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, তা হলো বিদ্যুৎসংকট। এটি একটি সাময়িক সমস্যা। তবে এ সংকট মোকাবিলার জন্য সরকার কর্মঘণ্টা কমিয়েছে, বাড়িয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাপ্তাহিক ছুটি। অনেকে মনে করেন করোনার কারণে শিক্ষার্থীরা পূর্বেই শিক্ষার ঘাটটির মধ্যে পড়েছে। সুতরাং ছুটি বাড়লে শিক্ষা বিকাশের পথে তা অন্তরায় হবে। আমি এটা মনে করি না।’
নীলিমা বলেন, ‘যেকোনো দুর্যোগকালীন সময়ে মানুষকে সবকিছুর প্রতি সহনশীল হতে হয়। আমাদের অর্থনীতি করোনা ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে একটি সঙ্গীন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবে তা মোকাবিলা করার জন্য সবাইকে ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করতে হবে। সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। এখন যদি স্কুল-কলেজ সপ্তাহে দুই দিন ছুটি বিষয়ে কথা বলি, তবে এই বিষয়টিকে আমরা ইতিবাচকভাবে দেখতে পারি। কারণ এই অবসরে একজন সন্তান তার বাবা-মায়ের কাছে থেকে সময় পেতে পারে। সে তার মনন বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘অতিরিক্ত সময় পরিবারের সঙ্গে থাকার কারণে যান্ত্রিক না হয়ে তাদের মূল্যবোধ ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হতে পারে। তবে এজন্য পরিবারকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও যত্নশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।’
সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিনকে শিক্ষার জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করেন নারায়ণগঞ্জ আইন কলেজের ফাইনাল ইয়ারের শিক্ষার্থী খাদিজা তুল জান্নাত। তিনি বলেন, ‘স্কুল-কলেজ সপ্তাহে ২ দিন ছুটির বিষয়টা আমি খুব একটা ইতিবাচক অর্থে দেখছি না। কারণ আমি নিজে একজন শিক্ষার্থী। একইসঙ্গে অভিভাবকও বটে। বাবার মৃত্যুর পর আমার এবং আমার বোনের সব ভার আমাকেই বহন করতে হয়। একইসঙ্গে পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় চাপ তো কিছু আছেই। আমাদের দুই বোনেরই পড়াশোনার ভার অনেকটাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। তাই হঠাৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দুই দিন বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়তে হবে।’
কারণ হিসেবে জান্নাত বলেন, ‘বোনকে যতটা টিউশন দেওয়া দরকার, অর্থনৈতিক ও পারিবারিক জটিলতার কারণে দিতে পারছি না। আবার আমারও এ অবস্থায় পড়াশোনায় ব্যাঘাত হচ্ছে। করোনাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রায় ২ বছর বন্ধই ছিল। ফলে আমরা এমনিতেই অনেকটা পিছিয়ে পড়েছি। তারওপর আবারও নতুন করে এই ধাক্কা আমি এবং আমার মতো শিক্ষার্থীরা কতটা সামলে উঠতে পারবেন, তা প্রশ্নবিদ্ধ।’ তিনি বলেন, ‘বিদ্যুতের সাশ্রয়, লোডশেডিং সমস্যা দূরীকরণে হয়তো এই সিদ্ধান্ত কিছুটা সুফল বয়ে আনতে পারে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের জন্য এই সিদ্ধান্ত মনে হয় না খুব একটা ইতিবাচক হবে।’
এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘করোনার কারণে যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল, তখন আমরা ফোনের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলাম। আবারও আমাদের সেই অভ্যেস চাঙ্গা হয়ে উঠবে। অলসতা কাজ করবে। পড়াশোনার ক্ষতি পুষিয়ে নওয়া সত্যি সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না।’