‘দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব বঙ্গে!’
এই তো মাত্র কয়েক দশক আগেও আমরা ছিলাম পৃথিবীর অত্যন্ত গরিব দেশগুলোর একটি। চারদিকে শুধু অভাবের শামিয়ানা পাতা থাকত। কিন্তু আজ? শুনতে খুব ভালো লাগে যে, ধনী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধিতে বিশ্বে আমরা এখন তিন নম্বরে আছি। এই বিশ্বে শ দুয়েক দেশ আছে, তার মধ্যে আমরা কিনা তিন নম্বরে! এ তো চাট্টিখানি কথা নয়! বছর দুয়েক আগে এ খবর বেরিয়েছিল ব্রিটেনের দ্য ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায়। তারা খবরটা করেছিল নিউ ইয়র্কভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ওয়েলথ-এক্সের গবেষণা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে। প্রতিবেদনটি প্রকাশের কিছুদিন পর ‘ওয়েলথ এক্স’ এটাও জানিয়েছিল যে, গত এক দশকে বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ হারে ধনী ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
চারদিকে এখন ধনী মানুষ কিলবিল করে। ছোটবেলায়, দেশ স্বাধীনের আগে আমরা কেউই এদেশে এত বেশি শিল্পপতি বা বিশাল বিশাল বিত্তশালী পরিবারের কথা শুনিনি। সে সময় আমাদের পরিবারে একমাত্র শিল্পপতি ছিলেন আমার মেজো ফুপুর স্বামী ড. আলী করিম। তার ছিল ‘আল করিম পেইন্ট’ নামে একটি ইন্ডাস্ট্রি। তিনি দেশভাগের আগে কলকাতায় শাহনাজ পেইন্ট গ্রুপের চিফ কেমিস্ট ছিলেন। দেশভাগের পর তারাই ছিলেন আমাদের কাছে বিরাট ধনী। আর ছিল এ কে খান গ্রুপ। বাঙালি শিল্পপতি তেমন আর কারো নাম জানতাম না গত শতকের পঞ্চাশের দশকে। ট্রান্সকম গ্রুপের লতিফুর রহমানের পিতা মুজিবুর রহমানরাও অবশ্য বিত্তশালী ছিলেন। ষাটের দশকে পূর্ব বাংলায় শিল্প উদ্যোক্তাদের অবস্থা কেমন ছিল, এ ব্যাপারে রুশ গবেষক সের্গেই বারানভ পরিচালিত সমীক্ষা আমলে নেওয়া যেতে পারে। তার সেই গবেষণায় জানা যায়, মাঝারি বৃহত্ শিল্প খাতে বাঙালি মুসলিম মালিকানাধীন ব্যবসায়ী গ্রুপের সংখ্যা ষাটের দশকে ছিল মাত্র ২৬টি।
সম্ভবত এ কারণেই ১৯৭০ সালের নির্বাচনি ম্যানিফেস্টো প্রস্তুতের সময় আওয়ামী লীগের ভেতরে বাঙালি শিল্পপতির সমর্থক কোনো লবির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেক রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলাম পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করে। বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা পাকিস্তানের তুলনায় এক ভিন্ন ধরনের কল্যাণকর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পর পাকিস্তান আমলের ২২টি পরিবারের জায়গায় বাংলাদেশে ২২ হাজারের বেশি কোটিপতি পরিবারের সৃষ্টি হয়েছে।
তাহলে গরিব থেকে আমরা ক্রমশ ধনীর কাতারে চলে যাচ্ছি! সত্যিই তো, এ এক দারুণ আনন্দের খবর। কিন্তু প্রদীপের নিচেই নাকি সবচেয়ে বেশি অন্ধকার থাকে! ওয়েলথ-এক্সের যে খবরটা হতে পারত আলোকিত খবর, দুঃখজনকভাবে সেটা আসলে আমাদের এক বৃহত্ অন্ধকার জগেকই প্রকাশ করে দেয়। নিশ্চয়ই ধনী হওয়া কোনো খারাপ কথা নয়। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘দারিদ্র্য’ কবিতা থেকে আমরা বুঝতে পারি—গরিব হওয়ার মতো অভিশাপ আর দ্বিতীয়টি নেই। নজরুল প্রথমে অবশ্য দারিদ্র্যকে তুলনা করেছেন ‘খ্রিষ্টের সম্মানের’ সঙ্গে। বলেছেন, দারিদ্র্যের ফলে তিনি অর্জন করেছেন ‘অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস’। কিন্তু এর পরপরই তিনি ঐ কবিতায় বলেছেন, ‘পারি নাই বাছা মোর, হে প্রিয় আমার, দুই বিন্দু দুগ্ধ দিতে!’ দারিদ্র্য আসলে কত বড় অভিশাপ, কতখানি অসহ্য—নজরুল তখন তার নির্মম বর্ণনা দিতে শুরু করলেন। সেই বর্ণনা পড়ে যে-কারো চোখে পানি এসে যাবে।
একইভাবে অভাবের আকাশে কবি সুকান্ত ‘পূর্ণিমার চাঁদ’কে কল্পনা করেছিলেন ঝলসানো রুটি হিসেবে। এরও ২০০ বছর আগে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর অন্নপূর্ণার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন—‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’। অর্থাত্, অভাব-দারিদ্র্য আমাদের এই জনপদের নিত্যদিনের ছায়া হয়ে লেপটে ছিল শতকের পর শতক। সুতরাং আমরা যে দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে ক্রমশ উন্নতির সোপান বেয়ে ওপরে উঠছি, সেটা দেশ স্বাধীন না হলে কল্পনাও করা যেত না।
কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ কী করে ধনী হচ্ছেন? প্রদীপের নিচের অন্ধকারটা কতখানি গাঢ়? এটা ঠিক যে, কিছু মানুষ ধনী হয়েছেন অত্যন্ত পরিশ্রম করে, সত্ভাবে। কিন্তু এর বিপরীতে বিপুলসংখ্যক মানুষ ধনী হচ্ছেন দুর্নীতি, অনিয়ম, মাদকদ্রব্য, চোরাচালান ইত্যাদি অসাধু উপায়ে। এমন নয় যে, ধনীর সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, সেই হারে গরিবও কমছে। অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠী অবশ্য আস্তে আস্তে কমছে বটে। তবে সার্বিকভাবে ধনীরা দিনে দিনে আরো ধনী হচ্ছেন এবং গরিবেরা আরো গরিব হচ্ছেন। এককালে আদর্শ বাঙালি বলতে যে কথাটি প্রচলিত ছিল—সিম্পল লিভিং হাই থিংকিং—সেই সহজ-সরল আদর্শিক জীবনযাপন আজ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। অর্থের দম্ভ আজ অতি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ যেন আক্ষরিক অর্থেই ‘চোরের মায়ের বড় গলা’!
এক্ষেত্রে গত কয়েক দিনের কিছু খবরের দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। গত ১ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে অর্থ পাচার নিয়ে একটি বড় খবর ছাপা হয়। খবরটিতে বলা হয়েছে, নাসির গ্রুপের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার মামলার তদন্ত চার বছর ধরে ফেলে রাখা হয়েছে। তাই বর্তমানে হাইকোর্ট চার বছর আগের মামলা ৪০ দিনের মধ্যে তদন্ত করতে অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে নির্দেশ দিয়েছে। বিষয়টা হচ্ছে, উচ্চ আদালত আদেশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ), যারা গত চার বছরেও তদন্ত সম্পন্ন করতে পারেনি।
প্রশ্ন হলো, সেই একই তদন্ত অর্থসচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ৪০ দিনে কীভাবে সম্পন্ন করবেন? খবরে বলা হয়েছে, ৫৬ কোটি টাকা তারা আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছে। মামলাটি দুদক করেছিল ২০১৫ সালে ১০ জনের বিরুদ্ধে, যাদের যোগসাজশে বেআইনি কাজটি করা হয়। আর অপরাধ সংঘটিত হয় ২০০৯-২০১৫ সালের মধ্যে, যেটি এজাহারে উল্লেখ আছে। প্রকৃতপক্ষে, এ ধরনের বেআইনি কর্মকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার ও সুরাহা না হওয়ার কারণেই বিভিন্ন গোষ্ঠী অর্থ পাচারের অঙ্কটাকে শুধু বাড়িয়েই চলেছে। বর্তমান সময়ে পি কে হালদারদের মতো নানা স্তরের দুর্নীতিবাজদের কোটি কোটি টাকা পাচারের ঘটনা তারই সাক্ষ্য দেয়।
অভাবে নাকি স্বভাব নষ্ট হয়। কিন্তু সেটা তো অভাবি লোকদের হয়। বিত্তশালীদের তো অর্থের অভাব নেই, তাদের কেন স্বভাব নষ্ট হলো? দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করার মনস্তত্ত্ব আসলে কী? কোন ধরনের অনিরাপত্তায় ভোগেন তারা? বেশি টাকার বেশি কর না দেওয়ার অজুহাত? যদিও সরকার বিভিন্ন সময়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েই থাকে। তার পরও দেখা যাচ্ছে, বিদেশে অর্থ পাচারের ঘটনা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। গার্মেন্টসের ওভার বা আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের ঘটনা তো পুরোনো খেলা!
করোনার অভূতপূর্ব সংকটকালে মানবিকতার অবক্ষয়ের দিকটিও আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করেছি। আমার জীবদ্দশায় এমন অমানবিক পরিস্থিতি আগে কখনো দেখিনি। হঠাত্ করেই বিভিন্ন ব্যবসায়ে তুষারধসের মতো ধস নেমেছে। চাকরি হারিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ, অভাব-অনটনে হাজার হাজার পরিবার শহর ছেড়ে গ্রামমুখী হয়েছে। কোভিডের অত্যাচারে সমগ্র পৃথিবী যখন লন্ডভন্ড, তখনো আমরা দেখেছি দেশের একশ্রেণির মানুষ কত বিচিত্র ধরনের দুর্নীতির খেলায় মেতে রয়েছে। শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে শত শত কেজি সোনা পাচার থেকে শুরু করে ইয়াবার কনসাইনমেন্ট, বিদেশি মুদ্রা ইত্যাদি অপকর্ম প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। এর মধ্যে সংসদ সদস্য, সমাজসেবক, বড় রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের ব্যক্তিরাও কত অপকর্মই না ঘটিয়েছেন।
আমাদের অপার সম্ভাবনার দেশটিকে আরো উন্নত ও কল্যাণকর রাষ্ট্রে পরিণত করা কি খুব কঠিন কাজ? দুর্নীতি ও অর্থ পাচার করে যারা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার দীর্ঘ পথ আরো দীর্ঘায়িত করছেন, তারা কি দেশের শত্রু নন? দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন একটি জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের বিকাশ। কিন্তু একটি সদ্যস্বাধীন রাষ্ট্রের অবিকশিত কর-রাজস্ব সিস্টেমের মাধ্যমে জনকল্যাণের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল সে সময় অর্জন করা সম্ভব ছিল না। এজন্য সে সময় নন-মার্কেট পন্থায় স্বেচ্ছাশ্রমভিত্তিক নদী-পুকুর-খাল খনন, রাস্তাঘাট মেরামত ও নির্মাণ প্রভৃতি স্থানীয় উদ্যোগের দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি। অর্থাৎ এই দেশ তিল তিল করে উন্নয়নের সোপানে পা রেখেছে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু সেই ১৯৫২ সালের দিনলিপিতে লিখেছেন—‘আমরা স্বাধীন হয়েছি ১৯৪৭ সালে আর চীন স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৯ সালে। যে মনোভাব পাকিস্তানের জনগণের ছিল, স্বাধীনতা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আজ যেন তা ঝিমিয়ে গেছে। সরকার তা ব্যবহার না করে তাকে চেপে মারার চেষ্টা করছে। আর চীনের সরকার জনগণকে ব্যবহার করছে তাদের দেশের উন্নয়নমূলক কাজে। তাদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য হলো, তাদের জনগণ জানতে পারল এই দেশ এবং এই দেশের সম্পদ তাদের। আর আমাদের জনগণ বুঝতে আরম্ভ করল জাতীয় সম্পদ বিশেষ গোষ্ঠীর, আর তারা যেন কেউই নন।’
এই যে দেশের জাতীয় ধনসম্পদ-ক্ষমতা একটি বিশেষ গোষ্ঠীর কাছে চলে যাচ্ছে, যাকে আমরা ইতিপূর্বে ‘কনসেনট্রেশন অ্যান্ড ইকোনমিক পাওয়ার’ বলে শনাক্ত করেছি, সেটি আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কোনো তত্ত্বের সাহায্য ছাড়াই সেদিন অনুধাবন করা সম্ভব হয়েছিল। কলকাতায় পড়াশোনাকালে এবং ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী আবুল হাশিম প্রমুখ নেতার সঙ্গে রাজনৈতিক নৈকট্যের কারণে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল ঘরানার সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ফলে সেই তুলনামূলক তরুণ বয়সেই কতিপয় এলিট গোষ্ঠীর কাছে অর্থনৈতিক বিত্ত ও ক্ষমতা কুক্ষিগত হওয়ার বিষয়টি তিনি সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। পরবর্তীকালে এই ভাবনাই সম্ভবত তার মধ্যে সাম্য ও কল্যাণকর রাষ্ট্রচিন্তার সলতে পাকাতে সাহায্য করেছিল।
দুর্নীতি রোধে নৈতিক উন্নতির প্রয়োজনীয়তার কথা অনেকেই বলে থাকেন। কিন্তু নৈতিক উন্নতির জন্য কি কার্যকর কিছু করা হচ্ছে? ধর্মের এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কথা ছিল, কিন্তু সেটিও দৃশ্যত কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে কি? রোমান দার্শনিক লুসিয়াস আনাইস সেনেকার একটি উদ্ধৃতির অংশবিশেষ এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হতে পারে। সেনেকা বলেছেন, ধর্ম সাধারণ মানুষের কাছে সত্য আর শাসকশ্রেণির কাছে হাতিয়ার। দুঃখজনকভাবে আজ উচ্চশ্রেণির লোকেরা দিনে দিনে হয়ে উঠছেন অমানবিক আর সাধারণ মানুষ পিষ্ট হচ্ছেন বহুমুখী চাপে। এভাবে আমরা আসলে কোথায় চলেছি?
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক ও পাক্ষিক অনন্যা