মানুষ তার দুর্ভোগ দেখে, উন্নয়ন দেখে না
আক্ষরিক অর্থেই বাংলাদেশে বৈপ্লবিক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা কি সেই মানুষ তৈরি করতে পেরেছি, যারা এই উন্নয়ন বোঝে? – গণতন্ত্র মানে দরিদ্রের রাজত্ব? গরিবেরা গণতন্ত্র চায়। চায় এই বিশ্বাসে যে, গণতন্ত্র তাদের স্বাধীনতা দেবে, সাম্যও দেবে, আর দেবে ক্ষমতা। ভোট খুব মূল্যবান তাদের কাছে। – করাপশন সব দেশেই কমবেশি আছে। বলা হয়ে থাকে, ‘করাপশন ইজ দ্য লুবরিকেন্ট অব গভর্মেন্ট’। কিন্তু লুবরিকেন্ট যখন বেশি হয়ে যায় তখন কিন্তু সিস্টেম স্লিপ কেটে যায়। – যেখানে অন্ধকারের রাজত্ব, সেখানে মানুষ স্বাধীন থাকতে পারে না। জ্ঞানের পূর্ণ আলোকই মানুষের কুসংস্কার দূর করতে পারে। এজন্য সুশিক্ষা ছাড়া গণতন্ত্রের সুফল পাওয়া সম্ভব।
অল্প বয়সে বেশি বই পড়ার সময় পাইনি। এখন সময় অনেক, পড়ার আগ্রহও তার চেয়ে বেশি। তাই নিজের পছন্দের বিষয় নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বই সংগ্রহ করি। রাত জেগে পড়ি এবং পছন্দসই লাইনগুলো আমার ডায়ারিতে টুকে রাখি। গত সপ্তায় আমি সার্চ কমিটির মিটিংয়ে অংশ নিয়ে সবার কথা শুনছিলাম আর কত বিচিত্র ধরনের ভাবনা মাথায় খেলে চলছিল। ভাবছিলাম, গণতন্ত্রের কত রকমফের। কত ফাঁকফোকর! নির্বাচন হলেই কিংবা ভোট দিতে পারলেই কি গণতন্ত্র রক্ষা পেয়ে যায়? কয়েক দিন আগে প্রধানমন্ত্রী গণভবনে বলেছেন, আগামী নির্বাচনে জনগণ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘একটা দেশকে আমরা বদলে দিয়েছি। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। জনগণের ওপর আমাদের আস্থা আছে।’
আক্ষরিক অর্থেই বাংলাদেশে বৈপ্লবিক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা কি সেই মানুষ তৈরি করতে পেরেছি, যারা এই উন্নয়ন বোঝে? এটা বোঝার মতো অবস্হা কি আছে? আমরা অবকাঠামোর উন্নয়ন করেছি, কিন্তু মানুষের উন্নয়ন কতটা করতে পেরেছি? ভোট তো মানুষই দেবে, অবকাঠামো দেবে না। কিন্তু যে দেশের সিংহভাগ মানুষ উন্নয়নের মর্ম উপলব্ধি করতে পারে না, যাদের কাছে এখনো দুবেলা ভালোমতো খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাটাই সংগ্রামের। কয়েক দিন আগে টিভিতে দেখলাম, একজন গরিব লোক বলছে—‘তেল কিনলাম, লবণ কিনলাম, কিন্তু চাল কিনার টাকা নাই।’ আজকাল টোকাই ছেলেমেয়েরা প্রকাশ্য দিবালোকে হাতের মুঠোয় পলিথিনের পোঁটলা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর সেই পোঁটলাটি কিছুক্ষণ পরপর নাক ও মুখে চেপে ধরে জোরে জোরে শ্বাস টানে। পোঁটলার ভেতরে হলুদ রঙের জিনিসটি নাম ডান্ডি। ডান্ডি এক ধরনের গ্লু-গাম বা আঠা। রাস্তার টোকাই, ভবঘুরে, কুলি-মজুর শ্রেণির মধ্যে এটা খুব তাড়াতাড়ি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, তার কারণ, এই আঠার শ্বাস নিলে নেশা হয়, খিদে কম লাগে। সুতরাং মানুষ তার দুর্ভোগ দেখে, পদ্মা সেতু দেখে না। তারা উন্নয়নকে মনে করে—‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, আমরা ভেবে করব কী?’
বর্তমানে মাদকের ভয়াবহ লাভজনক ব্যবসা সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। গতকাল একটি প্রতিবেদনে দেখলাম—কক্সবাজারে সাড়ে তিন বছরে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে ২৯৯ জন মাদক কারবারি। আত্মসমর্পণ করেছে ১২৩ জন। পাঁচ বছরে ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে ৭ কোটি ৮৫ লাখ। কিন্তু এত ‘বন্দুকযুদ্ধে’র পরও মাদক ব্যবসায় কমেনি। তার মানে মাদক কারবারিদের শেকড় আরো অনেক গভীরে। নেপথ্যে কত শতশত কারবারি আছে—তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মাদকের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী জিরো টলারেন্স ঘোষণা করলেও টলারেন্স চলে গিয়ে কেবল জিরো থেকে যায়। একজন মাদক কুইনের খবর পড়েছিলাম যে, সে নাকি আগে গাঁজা বিক্রি করত, তারপর আরো নানা ধরনের মাদকের কারবার করত। এখন তার চারতলা বাড়ি। সে হয়ে উঠেছে ইয়াবা কুইন।
কেমন করে সম্ভব একটি নিয়মতান্ত্রিক দেশে? চারতলা বাড়ি তো তাকে আলাদিনের দৈত্য রাতারাতি তৈরি করে দেয়নি। একজন অতি সাধারণ অভাবী নারী চারতলা বাড়ি তুলে ফেলল, আশপাশের লোক দেখল, পুলিশ দেখল—কিন্তু কেউ কিছু বলল না? কারো মনে প্রশ্ন এলো না, চারতলা বাড়ি বানানোর মতো এত টাকা সে কোথা থেকে পেল? একজন মানুষ একটি নিয়মতান্ত্রিক দেশে কিছু করতে চাইলে তার জন্য কিছু কাগজপত্রের প্রয়োজন হয়। ইয়াবা কুইন কি কাগজ ছাড়াই চারতলা বাড়ি বানিয়ে ফেলল? নাকি কাগজগুলো যাদের দেওয়ার কথা, যাদের যাচাই করার কথা, তারা ঘুষের বিনিময়ে সেসব কাজ দিয়ে দিয়েছে? সিস্টেম কাজ না করলেই কেবল এটা সম্ভব হয়।
এজন্য অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, এমন সুশিক্ষার অভাবের দেশে গণতন্ত্র কী করে সঠিকভাবে ফাংশন করবে? এখানে তো ইউপি সদস্য থেকে চেয়ারম্যান এমনকি এমপি পর্যন্ত কেনাবেচা হয়। সুতরাং গণতন্ত্র কোথায়? অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন গণতন্ত্রের অভিমুখে নামে একটি বই। এই বইয়ের ‘অ্যারিস্টটল কি ভ্রান্ত’ প্রবন্ধের অংশে বলা হয়েছে, অ্যারিস্টটল কি তবে ভুল বললেন? তিনি বলেছেন, গণতন্ত্র হচ্ছে গরিবতন্ত্র। কথাটা কি ভুল, নাকি ঠিক? অ্যারিস্টটলের গুরু প্লেটো বলেছেন, গণতন্ত্র হচ্ছে মূর্খদের রাজত্ব। অধিকাংশ লোকই মূর্খ, গণতন্ত্রের অছিলায় এই মূর্খরাই রাজত্ব কায়েম করে। গুরু প্লেটোর এই কথার সঙ্গে শিষ্য অ্যারিস্টটলের বক্তব্যের তফাত আছে, আবার নেইও। নেই এই জন্য বলা হচ্ছে যে, যেখানে দারিদ্র্য, সেখানেই তো অজ্ঞতা। লোকে শখ করে মূর্খ হয় না, বাধ্য হয়েই হয়, দারিদ্র্যই তাদের বাধ্য করে। গরিব বলেই মূর্খ হয়, মূর্খ বলে গরিব নয়।
কিন্তু কথাটা কি ঠিক যে, গণতন্ত্র মানে দরিদ্রের রাজত্ব? গরিবেরা গণতন্ত্র চায়। চায় এই বিশ্বাসে যে, গণতন্ত্র তাদের স্বাধীনতা দেবে, সাম্যও দেবে, আর দেবে ক্ষমতা। ভোট খুব মূল্যবান তাদের কাছে। ভোট তাদের মর্যাদা দেয়, গুরুত্ব দেয়, ক্ষমতাবান করে তোলে। আত্মবিশ্বাসও দিয়ে থাকে। এই বোধ সৃষ্টি হয় যে, রাষ্ট্রশাসনে তাদেরও মতামত আছে এবং সেই মতের দাম রয়েছে। এই বোধটা কম মূল্যবান নয়। কিন্তু ধনীরাও আজকাল তো গণতন্ত্র চায়। এমনকি অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যদি ক্ষমতায় আসে কোনো সরকার, তখনো অচিরেই দেখা যায় যে, সে ভারি গণতন্ত্রমনা হয়ে পড়ে। বলে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না করে ছাড়ব না কিছুতেই।
কিন্তু জ্ঞানীরা বলেন, মিথ্যা বলেননি অ্যারিস্টটল। ধনীর গণতন্ত্র ও গরিবের গণতন্ত্রে বিস্তর ব্যবধান, তা ছাড়া ধনবানেরা যেভাবে গণতন্ত্র চায়, দরিদ্ররা সেভাবে চায় না। ধনীদের জন্য গণতন্ত্র হচ্ছে শাসনের সুযোগ, গরিবদের জন্য তা বাঁচার আশা। ব্যবধান আকাশ-পাতালের।
আমরা ধনীদের গণতন্ত্র বোঝার চেষ্টা করি। আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের রচয়িতা টমাস জেফারসনের অন ডেমোক্রেসি বইটি (১৯৩৯ সালে প্রকাশিত) থেকে এই ব্যাপারে অসাধারণ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। ১৭৮৯ সালে জেফারসন লিখেছিলেন, কতগুলি অধিকার আছে, যা সরকারের কাছে সমর্পণ করা নিষ্প্রয়োজন, অথচ ঠিক সেগুলোরই ওপর হস্তক্ষেপ করতে সব দেশে সব ধরনের সরকারকে সর্বদা ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। এই অধিকারগুলি হচ্ছে চিন্তার অধিকার, ভাবপ্রকাশের অধিকার, অবাধ বাণিজ্যের অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার।
মার্কিন গণতন্ত্রের প্রতি জেফারসনের অত্যধিক অনুরাগ ছিল। যখন তিনি ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তখন ফরাসিরা তাদের সম্রাটের শিরশ্ছেদ করছে, জেফারসন যখন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস-প্রেসিডেন্ট, তখন নেপোলিয়ন যুদ্ধের পর যুদ্ধ জয় করে ইউরোপের একচ্ছত্র নায়ক হওয়ার পথ প্রস্ত্তত করছেন। জেফারসন যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তখন নেপোলিয়নের স্হলবাহিনী দেশের পর দেশ পদদলিত করছে এবং ইংরেজদের নৌবাহিনী সমুদ্রে ধ্বংসের কাজ চালাচ্ছে। দীর্ঘ ২০ বছরেরও বেশি সরকারি পদে থাকাকালীন জেফারসন দেখেছেন—পৃথিবীতে কোথাও শান্তি নেই। এজন্য তিনি চেয়েছেন গণতন্ত্র কায়েম হোক সারা বিশ্বে। কিন্তু তার ভাবনার মতো গণতন্ত্র যে অন্য জনপদে গিয়ে অদ্ভুতরূপ গ্রহণ করতে পারে—সমস্ত নিয়ম মেনেই—সেটা বোধহয় জেফারসন কল্পনাও করতে পারেননি। রাষ্ট্রপ্রধানের পদের মেয়াদ কী হওয়া উচিত—এই প্রশ্নে জেফারসন বলেন, ‘রাষ্ট্রপ্রধানের পদ সাত বছরের মতো দীর্ঘ সময় অপরিবর্তনীয় থাকা উচিত নয়, এটা আমি বুঝেছি। কোনো ব্যক্তি এই পদে অধিষ্ঠিত থেকে মন্দ কাজ করতে থাকলে তাকে মধ্যপথে সরিয়ে দেওয়ার শান্তিপূর্ণ উপায় থাকা প্রয়োজন।
অভিজ্ঞতার ফলে এই ব্যবস্হা আমি ঠিক বলে মনে করি যে, প্রেসিডেন্টের পদ আট বছরের জন্য হলেও, প্রথম চার বছর শেষ হওয়ার পর তাকে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা নির্বাচকমণ্ডলীর থাকবে। এই নীতি অনুসরণ করে আমি দ্বিতীয় বারের শেষে আর প্রেসিডেন্টের পদ গ্রহণ না করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছি। দীর্ঘ সময় প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত থাকার বিপদ এই যে, মনের সজীবতা নষ্ট হওয়ার পরও জনসাধারণের প্রশ্রয় ও অনুরাগ সেই ব্যক্তিকে তার আসনে বহাল রেখে দেবে। বারবার নির্বাচিত হওয়ার ইচ্ছা তখন অভ্যাসে পরিণত হবে; এর পর সারা জীবনের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার রীতি প্রবর্তিত হবে। আট বছর প্রেসিডেন্ট থাকার পর ওয়াশিংটন স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করে একটি দৃষ্টান্ত স্হাপন করেছেন। আমি এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করব!’ (সূত্র :টমাস জেফারসন অন ডেমোক্রেসি—বাই সাউল কে পাদোভার)
সুতরাং গণতন্ত্র হলো দায়িত্ব ও কর্তব্য। এটা নাগরিকের আছে। আর রাষ্ট্রযন্ত্রের কাজ হলো জনগণের এই দায়িত্ব ও কর্তব্য মনিটরিং করবে। এজন্য রাষ্ট্রের নানান মেশিনারিজ আছে। নানান রকম রুলস ও রেগুলেশন আছে। এবং সেগুলো দেখার ও প্রয়োগের জন্য লোকও আছে রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের তো সবই আছে, তাহলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা ঐ গরিবের গণতন্ত্রে। সেখানে মূর্খতার অরাজকতা দেখা যায়। আর তখন আর রাষ্ট্রের মেশিনারিজগুলো ঠিকমতো কাজ করে না। দুর্নীতি বা করাপশন বাড়তে থাকে। আমাদের দেশেও এই দশা বলে মনে করেন অনেকে।
এটা ঠিক যে, করাপশন সব দেশেই কমবেশি আছে। বলা হয়ে থাকে, ‘করাপশন ইজ দ্য লুবরিকেন্ট অব গভর্মেন্ট’। কিন্তু লুবরিকেন্ট যখন বেশি হয়ে যায় তখন কিন্তু সিস্টেম স্লিপ কেটে যায়, মেশিনের মোশন নষ্ট হয়ে যায় বেশি লুবরিকেন্টে। আর এখানেই আসে পরিমিতিবোধের। আপনি ঘুমিয়ে থাকলে দেখবেন, ঘরে যদি মশা আছে, তার মধ্যে দু-একটা মশা আপনার ঘুমের সুযোগ নিয়ে রক্ত খেতেই থাকে। মশা তার ডিম ফোটানোর জন্য সামান্য রক্তের মানুষের কাছে জন্য ছুটে আসে। কিন্তু মশা যখন সুযোগ পেয়ে লোভে পড়ে পেট ঢোল করে রক্ত খায়, তখন তার শরীর ভারি হয়ে যায়। ঠিকমতো উড়তে পারে না। তাকে তখন ধরে মেরে ফেলা অনেক সহজ হয়ে যায়। সুতরাং সবকিছুতেই পরিমিতিবোধ থাকাটা জরুরি।
সুতরাং গণতান্ত্রিক সমাজের অন্যতম মূল প্রয়োজন হলো—সুশিক্ষা। স্বৈরতন্ত্র চিরকাল অজ্ঞতা থেকে পুষ্টিলাভ করে। যেখানে অন্ধকারের রাজত্ব, সেখানে মানুষ স্বাধীন থাকতে পারে না। জ্ঞানের পূর্ণ আলোকই মানুষের কুসংস্কার দূর করতে পারে। এজন্য সুশিক্ষা ছাড়া গণতন্ত্রের সুফল পাওয়া সম্ভব নয়।
আরেকটা কথা হলো, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশসমূহের জন্য রাজনৈতিক অধিকারের চেয়ে অর্থনৈতিক অধিকার অধিক গুরুত্বপূর্ণ। অমর্ত্য সেন দেখিয়েছেন—যে দেশে গণতন্ত্র নেই, সে দেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা বেড়ে যায়। অমর্ত্য সেন যথার্থই বলেছেন যে, তিন ধরনের গণতন্ত্র মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, গণতন্ত্র মানুষের রাজনৈতিক এবং সামাজিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য প্রত্যক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয়ত, গণতন্ত্র মানুষের অর্থনৈতিক প্রয়োজনকে এগিয়ে নিয়ে যায়। তৃতীয়ত, গণতন্ত্র মানুষের প্রয়োজন নির্ধারণে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্হার উন্মুক্ত বিতর্কের মাধ্যমে মানুষ তাদের ভাবের লেনদেন করে এই প্রক্রিয়ায় মানুষের চাহিদা অনেক স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আমাদের যেমন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মতো ভালো লিডার দরকার, তেমনি দরকার তার চারপাশের কিছু ভালো মানুষের। প্রধানমন্ত্রীর তো চেষ্টা ও আন্তরিকতার কমতি নেই। কিন্তু যোগ্য লোকেরা যদি সঠিক জায়গায় না থাকে, তাহলে যা হওয়ার তা-ই হয়। কিছু লোক আছে, যারা কাফনের কাপড় দান করার দায়িত্ব পেলে সেই কাপড় চুরি করেও তারা পাঞ্জাবি বানাবে।
আর, গণতান্ত্রিক ব্যবস্হায় শক্তিশালী বিরোধী দলও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বৈরাচারের বিপক্ষে সব সময়ই বহুদলীয় গণতন্ত্রের পক্ষে বক্তব্য রেখেছেন। তার আত্মজীবনীতে তাই তিনি লিখেছেন, বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না। বাংলাদেশে বর্তমানে নামমাত্র ভূমিকায় বিরোধী দল বর্তমানে। ফলে রাজনীতি ক্ষেত্র ক্রমশই সংকুচিত এবং ক্রমশই এর চরিত্র সংঘাতময় হয়ে উঠেছে। আর আমরা জানি, সংঘাতের রাজনীতিতে বিরোধী বক্তব্যের কোনো স্হান নেই। উদার গণতন্ত্র বাংলাদেশে অনুপস্হিত। এখানে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত। নির্বাহী, বিচার এবং সাংসদদের ক্ষমতার সুস্পষ্ট বিভাজন দেখা যায় না। জাতীয় লক্ষ্য অর্জনের জন্য সুস্থ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা একান্ত আবশ্যক। সেই সঙ্গে চাই সুশিক্ষা।
লেখক: তাসমিমা হোসেন, সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক ও পাক্ষিক অনন্যা