বাধার কঠিন পাহাড়ের সিঁড়ি হতে চাই
জগতের সকল কিছুর সঙ্গে বাণিজ্যের বিষয়টি জড়িয়ে আছে। বাজার-সংস্কৃতির কারণেই এই বিশ্ব পরস্পরের কাছে এসেছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্যের উদ্দেশ্যেই প্রবেশ করেছিল ভারতবর্ষে। ভাস্কো-দা-গামা, কলম্বাস, আমেরিগো জাহাজ ভাসিয়েছেন বাণিজ্যের প্রসারেই। শেষ অর্থে একটি জনপদের জীবনযাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে সেখানকার বাণিজ্যের ব্যাপ্তি বা পরিসর। আমাদের বাংলা নববর্ষের সঙ্গেও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে ব্যবসা-বাণিজ্য।
পাঠক নিশ্চয়ই জানেন, প্রথমদিকে বাংলা নতুন বছর শুরু হতো অগ্রহায়ণ মাস থেকে। পরবর্তীকালে বাদশাহ আকবর খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য এবং বাংলা মুলুুকে ফসল কাটার মরশুমের কথা মাথায় রেখে বৈশাখী মাস থেকে চালু করেন ফসলি সন। একই ধারাবাহিকতায় পয়লা বৈশাখ থেকে শুরু হয় নতুন বছরের হিসাব রাখার পর্ব। জমিদারি আমলে নববর্ষের ব্যবহারিক প্রয়োগ তুঙ্গে উঠেছিল বাংলাদেশে। পয়লা বৈশাখের আগের দিন অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষে চৈত্রসংক্রান্তির নানাঅনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পুরনো বছরকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানাবার প্রয়াস ফুটে ওঠে। এর ভেতরে আমরা দেখতে পাই বাঙালির উদ্ভাবনী শক্তি ও স্বকীয়তার ছাপ। মাত্র কয়েক দশক আগেও চৈত্রসংক্রান্তিতে আমাদের মফস্বল শহরে মেলা বসত, শোলার তৈরি সবুজ টিয়েপাখির উজ্জ্বল পালক থেকে উঁকি দিত সহস্র খুশির আভা। ছিল আরো কত খেলনা। সামান্য উপকরণে তৈরি সেসব খেলনা। কিন্তু বাচ্চাদের মন কাড়তে কারো চেয়ে কম নয় গ্রামীণ কারিগরদের তৈরি এসব বিচিত্র খেলনার সম্ভার।
নববর্ষের চিরাচরিত উৎসবের মধ্যে রয়েছে হালখাতা, চাষাবাদ, বীজ বপন, বৈশাখীমেলা, মধুমাসের মেলা ও আঞ্চলিক উৎসব। তবে নববর্ষের মূল আকর্ষণ ছিল ‘হালখাতা’। হালখাতা শব্দবন্ধটির সঙ্গে মুসলিম শাসনের অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে। ‘হাল’ আর ‘খাতা’-দুটিই আরবি ফারসি সঞ্জাত। এর অর্থ-নতুন খাতা। হালখাতা আজো পয়লা বৈশাখে খোলা হয়। সুতো দিয়ে বাঁধা লাল খেরো হৃষ্টপুষ্ট খাতা এর প্রধান উপকরণ। এতে ব্যবসায়ীরা তাঁদের লেনদেন, বাকি-বকেয়া-সবকিছুর হিসাব-নিকাশ লিখে রাখেন। বিষয়টি স্পষ্ট করা উচিত যে, হালখাতার সঙ্গে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কোনো সম্বন্ধ নেই। মুসলিম ব্যবসায়ীরা তাঁর হালখাতার ওপর ‘এলাহি ভরসা’ আর হিন্দু ব্যবসায়ীরা ‘গণেশায় নমঃ’ লিখে রাখেন নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী। হালখাতা এখনো টিকে আছে টিমটিম করে। যুগের সংস্কারে হালখাতার জায়গায় এসেছে ডিজিটাল হিসাব-নিকাশের ব্যবস্থা। তবে সকল কিছুর পরেও বাংলা নববর্ষ এখনো আমাদের অন্তরকে বিকশিত করে চলেছে। চেনাচ্ছে নিজেদের মাটিকে, শেকড়কে। এজন্য প্রতিবারের মতো এবারো আমরা অনন্যা বৈশাখ-সংখ্যা তৈরি করেছি বিচিত্র সম্ভারে। এর পাশাপাশি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাতে চাই যে, ২৫ বছরের ধারাবাহিকতায় বছরের আলোচিত শীর্ষদশ নারীকে পাক্ষিক অনন্যা এবারো সম্মাননা জ্ঞাপন করেছে গত ২৩ মার্চ। এই সম্মাননার দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের নারীসমাজের ভেতরে যদি সামান্য উৎসাহেরও জোগান দিতে পারে, সেটা অনন্যার কম অর্জন নয়।
নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। একটুখানি উৎসাহে, সাহসে, ভাঙতে পারছে বাধার কঠিন পাহাড়। নারীদের এই কঠিন পাহাড়ের সিঁড়ি হতে চায় অনন্যা।
সকলের মঙ্গল হোক। শুভ নববর্ষ।
-তাসমিমা হোসেন