আমরা কি কেবল ‘বাজার’ হয়েই থাকব?
গত বছর করোনা ভাইরাস যখন চীন থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল, তখন ইতালি ও আমেরিকার অবস্থা দেখে আমরা চমকে উঠেছিলাম। চীন থেকে ভাইরাসটা ছড়ালেও সর্বশেষ ওয়ার্ল্ডোমিটারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী করোনায় আক্রান্তের সংখ্যার তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও ব্রাজিল যথাক্রমে এক, দুই ও তিন নম্বরে। কিন্তু চীনের অবস্থান কোথায়? ওয়ার্ল্ডোমিটার বলছে চীন সংক্রমণের তালিকায় ৯৬ নম্বরে। মাত্র ৯০ হাজার ৭১৪ জন চীনে আক্রান্ত হয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্তের সংখ্যা ৩ কোটি ৩২ লাখের বেশি। আর ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা ২ কোটির ওপরে। গত বছর এপ্রিলে আমরা প্রবল আতঙ্কে দেখেছি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে করোনায় প্রতিদিন এত মানুষ মারা যাচ্ছিল যে, তাদের ঠিকমতো কবর দেওয়া যাচ্ছিল না। ইউরোপের অবস্থাও খুব খারাপ ছিল। আমরা অপেক্ষায় ছিলাম, কবে করোনা প্রতিষেধক আসবে। আর এবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সুনামির মতো করে ছড়িয়ে পড়েছে ভারত জুড়ে। সেখানে হাসপাতালে মানুষ শুধু অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে। এই ট্র্যাজেডি ঘটছে দিল্লির মতো শহরে। গ্রামাঞ্চলের মানুষের পরিণতি তাহলে কি হচ্ছে, সেটা অনুমান করলে যে কারো গা শিউরে উঠবে।
বাংলাদেশেও সংক্রমণের ঢেউ উঁচু হচ্ছিল। তবে ভারতের মতো সুনামির আকারে নয়। মার্চের শুরুতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫০০-এর কাছাকাছি, এরপর বাড়তে বাড়তে এপ্রিলের শুরুতে ৭ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ভারতে যেখানে বেড়েছে প্রায় ৫০ গুণ মাত্রায়, সেখানে বাংলাদেশে বেড়েছে প্রায় ২০ গুণ মাত্রায়। তবে এটাকে আপাতভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। এখনো ঢিলেঢালা লকডাউন চলছে। কিন্তু ভারতে কেন এমন সুনামি সৃষ্টি হল? এর দুটো কারণ সাদা চোখে দেখা যাচ্ছে। একটি হল, করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট যেটা প্রচণ্ড সংক্রামক, অন্যটি ভারতের পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন। এসব নির্বাচনের প্রচারণা শুরু হয় মার্চের শুরুতে, বিভিন্ন দফার নির্বাচন শেষে ভোট গণনা হয় ২ মে। আমরা দেখেছি, সংক্রমণ যখন বাড়ছে তখনো নির্বাচনী জনসংযোগে দূরত্ব বিধি শিকেয় তুলে লাখ লাখ মানুষ অংশ নিয়েছে। এরপর করোনার আগুনে ঘি ছড়ায় ধর্মীয় উৎসব কুম্ভমেলা। ১৫ এপ্রিল আনন্দবাজারের রিপোর্টে বলছে, সে সময় ভারতে করোনায় আক্রান্তের দৈনিক সংখ্যা যখন ২ লাখ ছাড়িয়েছে, তখন কুম্ভমেলায় কয়েক দিনে অংশ নিয়েছেন ২৩ লাখের বেশি পুণ্যার্থী, যাদের মধ্যে ১৭ শতাধিক করোনায় আক্রান্ত! ভারতের গণমাধ্যমই বলতে শুরু করল, কুম্ভমেলা হয়ে উঠছে করোনার ‘সুপারস্প্রেডার’। এ প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়ে যেতে পারে, গত বছর এপ্রিলের দিল্লির নিজামুদ্দিন মসজিদে তাবলিগি জামাতের কথা। সেই আয়োজনে যে ধর্মীয় সমাবেশ হয়েছিল তা থেকেই বিপুল মানুষের শরীরে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছিল বলে ভারত জুড়ে সমালোচনা উঠেছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যারা ঐ তাবলিগে অংশ নিয়েছিলেন, তারা ভারত সরকারের রোষানলে পড়েছিলেন। তাদের আটক রাখা হয় এবং এ বছর মার্চ পর্যন্ত তাদের অনেককেই দেশে ফিরতে দেওয়া হয়নি, কালো তালিকাভুক্তও করা হয়। কেন? তারা তো নিয়ম মেনে ভিসা করেই সেখানে গিয়েছিলেন।
মহামারি সব সময়ই নতুন নতুন রহস্য তৈরি করে। মহামারির ইতিহাস তো মানবসভ্যতার মতোই প্রাচীন। শতকের পর শতক ধরে বিভিন্ন সময় সংক্রামক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে কোন নির্দিষ্ট এলাকায়, কখনো আবার বিশ্বব্যাপী। কিন্তু গত ৭০-৮০ বছরে করোনা মহামারির মতো ভয়াবহ কোন মহামারি প্রত্যক্ষের অভিজ্ঞতার আমাদের বয়স্ক জনগোষ্ঠীরও কারো নেই। যে কারণে একুশ শতকের আধুনিক সময়ে এসেও মধ্যযুগে প্লেগে ইউরোপের ব্ল্যাক ডেথের স্মৃতি কিংবা ভারতে গুটিবসন্ত, যক্ষ্মা, কলেরা মহামারির মতো আরেক ধরনের মহামারি যে আমাদের এভাবে গৃহবন্দি করে মৃত্যুভয়ে সন্ত্রস্ত করে তুলতে পারে সেটা আমাদের সবার জন্য ছিল কল্পনাতীত ব্যাপার। সর্বশেষ ১৯১৮ ও ১৯১৯ সালের মধ্যে স্প্যানিশ ফ্লুতে আনুমানিক ৫ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। করোনা ভাইরাস কত কোটি মানুষ মারবে এবং কত কোটি মানুষের পেটের ভাত কাড়বে, পৃথিবীর অর্থনীতিকে কত বছরের জন্য পেছনে নিয়ে যাবে এখনো স্পষ্ট নয়।
কোভিড যখন গত বছর মার্চে বাংলাদেশে এলো, বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবর্ষের অনুষ্ঠানও সরকার পুরোপুরি সীমিত করে দিল। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিন্তু প্রথম থেকেই সতর্ক ছিলেন। সেই তুলনায় বিশ্বের সবচাইতে শক্তিশালী দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ডোনাল্ড ট্রাম্প কোন কিছু না মেনেই নির্বাচনী প্রচারণায় মেতে ছিলেন। ট্রাম্প নিজে ডুবেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রকেও করানোয় জর্জরিত করেছিলেন। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, এক বছর পর ট্রাম্পকে ফলো করে ভারতের প্রধানমন্ত্রীও একই কাজ করলেন। নিরাশার মধ্যে আশার কথা হল, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে রেকর্ড ভেঙে সবচাইতে স্বল্প সময়ের মধ্যে বেশ কার্যকর কয়েকটি ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়।
আমরা আগের মহামারির কথা ভুলে গেছি। আর বিভিন্ন গ্যাজেট নিয়ে নতুন প্রজন্ম এতটাই ব্যস্ত যে, তারা কিছুই জানে না। আগামী দিনে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আরো কত ধরনের বিপত্তি আর মহামারি আসতে পারে, সেটা আমরা কল্পনাও করতে পারছি না। অনেকেই বলছেন, করোনা সহজে যাবে না, এটাকে মানিয়ে নিয়েই আমাদের চলতে হবে। আমাদের লাইফস্টাইল ও চিন্তাধারার পরিবর্তন আনতেই হবে।
সুতরাং আমাদের নিজের ওপর ভরসা করতে শিখতে হবে। আমরাও কিন্তু ভ্যাকসিন তৈরির তালিকায় ছিলাম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকায় বাংলাদেশের গ্লোব বায়োটেকের নাম আছে। যে ১৫৬টি টিকা পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পূর্বাবস্থায় আছে, তার মধ্যে গ্লোবের তিনটি টিকা আছে। কিন্তু আমাদের এখানে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার তুলনা হয় না। স্বাস্থ্য খাতে গবেষণা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ওষুধ তৈরিতে আমাদের যেসব প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলাম, গত কয়েক দশকে সেগুলো নষ্ট করেছি। অনেকে মনে করেন, আমরা পরনির্ভরশীল থাকতে পছন্দ করি, আমদানির মাধ্যমে কাউকে কাউকে কিছু টুপাইস আয় করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। অথচ টিকার ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য অসামান্য। এই সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদর দপ্তরে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনের (গ্যাভি) থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ হিসেবে পুরস্কৃত করা হয়। সুতরাং সময় এসেছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ করে আবার টিকা উৎপাদনে যাওয়ার। রাশিয়ার সঙ্গে ভ্যাকসিন উৎপাদনে যে কথা চলছে, সেটার অপার সম্ভাবনা রয়েছে।
আগামী দিনে বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে অন্যতম টিকা উৎপাদনকারী দেশ। শুধু নিজেদের জন্য নয়, বিশ্ববাজারের জন্যও। টিকার প্রয়োজন বহাল থাকবে দীর্ঘদিন, হয়তো-বা চিরদিন। আসলে, আমরাও অনেক কিছু পারি। কিন্তু বিশ্বায়নের পাল্লায় পড়ে আমরা এখন কেবল স্রেফ ‘বাজার’ হয়ে যাচ্ছি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, সাধারণ মানুষ কীভাবে পলিসির কাছে মার খাচ্ছে। রাজনীতি এখন সম্পূর্ণ ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে। নেতৃত্ব বলে আর কি কোন জিনিস আছে? অথচ আমাদের শীর্ষ নেতৃত্ব তৃতীয় বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের চেয়ে অনেক বেশি ভালো। কিন্তু আমরা নিজেরা নাগরিক হিসেবে যে দায়িত্ব পালন করছি না, আমরা দায়িত্ববান হলে আমাদের লিডারও অনেক চ্যালেঞ্জ অনেক সহজে মোকাবিলা করতে পারেন, এটা আমাদের বুঝতে হবে। আমাদের নেতৃত্বের যদি কিছু ভুল হয়ে থাকে, সেটা সবার দোষে হচ্ছে, শীর্ষ নেতৃত্বের নিজস্ব ভুলে নয়। সুতরাং আমাদের নিজ নিজ জায়গা থেকে যার যার কর্তব্য পালন করতে হবে। কেবল রাজনৈতিক কারণে বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করার মানসিকতা থেকে সরে আসতে না পারলে আমরা মহামারি থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারব না। আমরা বরং নিজেরাই এক- একটা মহামারিতে পরিণত হব। নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস করে ফেলব। এভাবেই মানবতা ধ্বংস হবে, পৃথিবী ধ্বংস হবে।
লেখক : সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক ও পাক্ষিক অনন্যা