পৃথিবীর অসুখ আবার সেরে উঠবে
কিন্তু আজ, ১০ মাস পর, ২০২১-এর শুরুতে এসে দেখছি, সবকিছু থেকেই আমরা ক্রমশ বেরিয়ে আসতে পারছি। বাংলাদেশে সবকিছুতেই ভয়াবহ যেই অব্যবস্থাপনা—আমরা তো প্রথমে ভেবেছিলাম, দেশটি বুঝি ধ্বংসই হয়ে যাবে! পথে পথে লাশ পড়ে থাকবে! কিন্তু বাংলাদেশে বিশ্বের বড় বড় দেশের তুলনায় লোক কম মারা গেল। সৃষ্টিকর্তা আসলে আমাদের কী শেখাতে চেয়েছিলেন? আমি বেশ কিছু দিক নতুন করে অনুভব করলাম। যেমন—আমাদের অনুভূতিগুলি কমে গেল, আমরা একলা থাকতে শিখলাম, আমরা বুঝলাম যে বেঁচে থাকতে এত জিনিসের দরকার নেই। এমনকি আমরা যে কোনো সময় চলে যেতে পারি। আমরা মানুষকে ভালোবাসতে চাই, কিন্তু ভালোবাসার বাহ্যিক প্রকাশগুলো নিষিদ্ধ হয়ে গেল। যেমন—হ্যান্ডশেক, জড়িয়ে ধরা, মুখোমুখি কথা বলা। মানুষের বেশি কাছে যাওয়ার ওপর বিধিনিষেধ তৈরি হলো। আমরা নিজেদের বন্দি করে ফেলতে শিখে নিলাম। এগুলো করলাম বাঁচার স্বার্থে। কারণ আমরা বেঁচে থাকতে ভালোবাসি।
সেই যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’। আমরাও এই সুন্দর ভুবনে বেঁচে থাকতে চাই। যতই বয়স হোক, সাধারণত বেঁচে থাকার তৃষ্ণা কারো মধ্যেই মরে না কখনো। করোনাও আমাদের জীবনতৃষ্ণা বাড়িয়ে দিল। এর পাশাপাশি আমরা খরচ কমাতে শিখলাম। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেল, আমরা অল্প জিনিসে এবং অল্প কেনাকাটায় বেঁচে থাকতে শিখলাম। যেসব ধনী মানুষ কথায় কথায় সকাল-বিকাল বিদেশে ঘুরতে যেতেন, তারাও যে যেখানে ছিলেন সেখানে আটকে রইলেন। আমরা জানলাম যে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। আগেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব ছিল, কিন্তু করোনা এসে বুঝিয়ে গেল, স্বাস্থ্যকর ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশে বসবাস করাটা আমাদের অস্তিত্বের জন্য কতটা অপরিহার্য। আগেও আমরা বায়ুদূষণের জন্য শ্বাসকষ্টের শিকার হতাম, কিন্তু মাস্ক পরতাম না। এখন দেখলাম, মাস্ক শুধু করোনার জন্য নয়, আরো অনেক রোগ থেকে বাঁচায়।
তবে অনেক সতর্কতার পরও আমরা অনেক মানুষকে হারালাম। একেকটা পরিবারে অনেকেই একাধিক কাছের মানুষকে হারাল, যাদের এভাবে এখনই চলে যাওয়ার কথা ছিল না। অনেক মহত্ মানুষ মারা গেলেন। কিন্তু কী দুঃখের বিষয়, আমরা তাদের মৃতদেহে শ্রদ্ধা জানাতে পারলাম না, কবরের কাছে যেতে পারলাম না, জানাজায় যেতে মানুষ ভয় পেল। একজন মানুষের জীবনের শেষ গোসল করানো হলো দায়সারাভাবে, কত রকমের বিধিনিষেধের মধ্যে। মৃতদেহও আমাদের কাছে মূর্তিমান করোনা ভাইরাসের কারখানা হয়ে গেল। পত্রিকায় কিংবা ফেসবুকে অনেকের মৃত্যুখবর জানলাম আর ছোট্ট কমেন্টে শোক প্রকাশ করলাম মাত্র। একজন মানুষ সারা জীবন ধরে শত শত সম্পর্ক নির্মাণের পর হঠাত্ করোনায় মৃত্যুর পর তার জন্য কি না শুধু ডিজিটাল শোকবার্তা পড়ে রইল! কী ভয়াবহ ট্র্যাজেডি!
মানবতা যে কোথায় গিয়ে মুখ লুকাবে, তা প্রথমদিকে স্পষ্ট হয়ে গেছিল বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার চিত্র দেখে। এই মহামারির মধ্যেও দেখলাম, কিছু মানুষ তাদের লোভ-লালসা ভুলতে পারে না। বরং তারা কোথাও আগুন লাগলে আলুপোড়া খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। করোনা নিয়েও মিথ্যা ব্যবসা শুরু করলেন রিজেন্ট হাসপাতালের সাহেদ ও জেকেজির চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরী। এর মধ্যেই রাজনীতিও কিন্তু থেমে নেই। অন্যদিকে ইউরোপে যখন মৃত্যুর মিছিল দেখলাম, আমেরিকা যখন করোনার থাবায় দিশেহারা হয়ে গেল, তখন আমরা অবাক হলাম। উন্নত বিশ্ব নিয়ে আমাদের যে বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে, সেখানে এভাবে মানুষ মারা যেতে পারে না—আমাদের সেই ভুল ধারণা ভাঙল। আমেরিকার অবস্থা দেখে আমরা নতুন করে বুঝলাম, একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান কত নির্মম ও অদ্ভুত হতে পারেন! আমেরিকার মতো দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত ধরেই নিতাম যে তিনি সব জানেন, তিনি যথার্থ শিক্ষিত মানুষ। তাকে ঘিরে যেসব পারিষদ থাকেন, তারাও বিচক্ষণ হবেন নিঃসন্দেহে। কিন্তু আমাদের সেসব ধারণা আমূল বদলে দেয় ট্রাম্পের আমেরিকা। সব ধরনের বিজ্ঞান ও যুক্তিকে অগ্রাহ্য করে ট্রাম্প কীভাবে নিজের এজেন্ডাকে বাস্তবায়ন করতে মরিয়া ছিলেন, সেটা দেখেছে সারা বিশ্ব। তার সর্বশেষ ঘটনা ঘটেছে গত ৬ জানুয়ারি। ট্রাম্পের সমর্থকরা ক্যাপিটল হিলে যেই নজিরবিহীন হামলা চালালেন, যেভাবে চারটি তাজা প্রাণ ঝরল, যেভাবে সিনেটরদের গোপন কুঠুরিতে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করতে হলো, এমন ঘটনা বিশ্বের কেউ কখনো কল্পনাতেও আনেননি। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের অনেক ক্ষমতাধরদের মতো ট্রাম্পও যে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যে কোনো কিছু করতে পারেন, ৬ জানুয়ারি ছিল তারই কদর্য প্রকাশ।
আমেরিকাকে যেটা আমরা মেল্টিং পট বলতাম, সেই পটের একটা আলাদা রূপ দেখা যাচ্ছে। সেটা যে চূড়ান্ত পর্যায়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, কেউ জানে না। ট্রাম্পের উগ্র শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী সমর্থকরা কিছুতেই মানতে পারছেন না যে একজন ইমিগ্র্যান্ট অশ্বেতাঙ্গ নারী আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট হতে পারেন! এটা বলতে দ্বিধা নেই যে, কমলা হ্যারিসকে আমরা যত দেখি ততই বিস্মিত হই। কমলার মা ভারতীয় আর বাবা আবার জ্যামাইকা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। কমলা কিন্তু নিজেকে কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবেই পরিচয় দিয়ে এসেছেন। আমরা দেখেছি—যৌক্তিক ও মানবিক বোধে কমলা অত্যন্ত দৃঢ়চেতা। তার ধারালো ও গোছানো ভাবনা-চিন্তা ও মানসিক শক্তি দেখে আমি অবাক হয়ে ভাবি—একজন অশ্বেতাঙ্গ নারী কেমন করে এভাবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারেন! কীভাবে গড়ে তুলতে পারেন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী নারী নেত্রী হিসেবে! অন্যদিকে বাইডেনের মতো একজন ডেমোক্র্যাট, যিনি সোশ্যালিজমের কথা বলেন, সব মানুষের কথা বলেন—তাকেও ট্রাম্পের উগ্র সমর্থকরা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিতে পারছেন না। রিপাবলিকান দলেও তো কত ভালো নেতা ছিলেন। কিন্তু ট্রাম্পের উগ্র মতাদর্শ যেন রিপাবলিকানদের কাঁধে এখন সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে বসেছে। আরো একটা অ্যালার্মিং দিক হলো, ট্রাম্পের ভুল নীতির জন্য আমেরিকায় করোনায় ২ কোটি ১৪ লাখ মানুষ আক্রান্ত হলো, ৩ লাখ ৬১ হাজার মানুষ মারা গেল, তার পরও ট্রাম্প কী করে এত ভোট পেলেন? তার পপুলার ভোট ৪৭ শতাংশের কাছাকাছি। তার মানে, এত খারাপ কাজ করার পরও আমেরিকার ভেতরে বর্ণবিদ্বেষ ও উগ্র ট্রাম্পনীতি অন্তঃসলিলার মতো চোরাস্রোত হয়ে বয়ে যাচ্ছে!
সেই ষাটের দশকে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র যখন বলেছিলেন—আই হ্যাভ আ ড্রিম। তিনি বলেছিলেন—‘আমার একটি স্বপ্ন আছে যে আমার ছোট চারটি সন্তান একদিন এমন একটি জাতির মধ্যে বসবাস করবে, যেখানে গাত্রবর্ণ দিয়ে আর তাদের বিচার করা হবে না, করা হবে চরিত্রগুণ দিয়ে…।’ কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি আমেরিকার পুলিশ কীভাবে হাঁটু দিয়ে চেপে জর্জ ফ্লয়েড নামের একজন কৃষ্ণাঙ্গের দম বন্ধ করে দিয়েছে। ফ্লয়েড চিত্কার করে বলেছেন—আই কান্ট ব্রিদ—আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। ফ্লয়েডের এ কথা যেন আমেরিকার ভেতরকার রুদ্ধনিঃশ্বাসের অনেক গোপন গল্প বলে দেয়। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকা জানাচ্ছে, ফ্লয়েডের মৃত্যুর আগেও আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে নিহতদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে বেশির ভাগই কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান। আশার কথা হলো, কমলা হ্যারিসের কথা শুনলে মনে হয়, পৃথিবী যেন আবার ঠিকঠাক মানবিক ছন্দে চলতে পারবে। পৃথিবীর অসুখ আবার সেরে উঠবে। কিন্তু ট্রাম্পের মতো যারা অসুখের কারবারি, তারা কি কমলাদের মতো নেতাদের সহজে কাজ করতে দেবে? এবং আমরা আতঙ্কিত যে, ট্রাম্প যে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে গেলেন, যেসব নেতাকে সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন, চার বছর পর তারা নতুন এক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে মরিয়া হয়ে উঠবেন হয়তো!
বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত লেখক প্রমথনাথ বিশী স্যাটায়ার করে বলেছেন—‘পাগলের কোনো সমস্যা নাই, একমাত্র পাগলামি ছাড়া! সে সমস্যাও আবার প্রকৃতিস্থের (স্বাভাবিক মানুষের) কাছে। স্বাভাবিক মানুষ না থাকিলে সেই শেষ সমস্যাটিও নাই। কাজেই যত শীঘ্র প্রকৃতিস্থের সংখ্যা লোপ পায়, পৃথিবীর ততই মঙ্গল।’ ট্রাম্পের মতো অস্বাভাবিক মানুষ হয়তো চান, পৃথিবী থেকে সব স্বাভাবিক মানুষ বিদায় নিক।
আমাদের মতো মানুষ, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পঞ্চাশের দশকে বেবি বুমার্সের সময় জন্ম নিয়েছিল, সেই সময়ের যেই চিন্তাধারা আর এই মিলেনিয়ামের পর জন্ম নেওয়া নতুন প্রজন্মের চিন্তাভাবনার মধ্যে আকাশপাতাল তফাত রয়েছে। কাজেই আমাদের বয়সি যারা নীতিনির্ধারক আছেন, রাজনীতিতে আছেন, তাদের এই পরিবর্তিত জামানার পালস বুঝতে হবে। নতুন প্রযুক্তি এবং এই প্রযুক্তির ভেতর দিয়ে বড় হওয়া নতুন প্রজন্মের ভাষা বুঝতে হবে। এরাই তো আমাদের ভবিষ্যত্। সুতরাং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রতিনিয়ত কীভাবে হালনাগাদ করতে হবে, সেটা জানতে হবে। করোনার জন্য স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় আমাদের শিশু-কিশোররা নতুন ধরনের মানসিক সমস্যার মধ্যে পড়েছে। বাবা-মায়ের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে এরই মধ্যে ঢাকাসহ অন্যান্য শহর ছেড়েছে বহু শিশু, অর্থনৈতিক দুর্দশার শিকার হয়ে কাউকে কাউকে বই-খাতা ছেড়ে বসতে হয়েছে বিয়ের পিঁড়িতে, কেউ কেউ যাচ্ছে কলকারখানায়, কেউ গাড়ির হেলপারি করছে। এই পরিস্থিতিতে মহামারি শেষে স্কুল খুললে বাংলাদেশে কতসংখ্যক শিশু লেখাপড়ার বাইরে চলে যাবে, সেটা আমরা কল্পনাও করতে পারছি না। অনেকেই মনে করছেন কমপক্ষে ৪০ শতাংশ শিশু ঝরে পড়তে যাচ্ছে। সংখ্যাটি কিন্তু বিপুল। আমি দেখেছি, আমাদের দেশের মানুষের খুব বেশি চাহিদা নেই। এদের একটু পথ দেখালেই এরা অনেক কিছু করতে পারে। সেই যে একটা জনপ্রিয় গান আছে—‘মন রে কৃষি কাজ জানো না। এমন মানবজমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা।’ আমাদের দেশের বিপুল মানবজমিনকে কাজে লাগাতে হবে। ঠিকমতো আবাদ করলে সোনা যে ফলবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক ও পাক্ষিক অনন্যা
অনুলিখন: তাপস কুমার দত্ত