কেন অনন্যা শীর্ষদশ প্রদান শুরু করলাম
নারীর কিছু কষ্ট সাপের বিষের মতোই যন্ত্রণার। এক্ষেত্রে নারীর ধনী-গরিব বলে কিছু নেই। নারীর কষ্ট নারীর মতো করে আর কে বুঝতে পারে? যেমনটি বলা হয়—‘চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে!’ কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের এ কবিতার সুরে বলা যেতেই পারে—‘কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে (পুরুষ) কীসে (কীভাবে), কভু আশীবিষে (সাপের বিষে) দংশেনি যারে।’ প্রকৃতই নিজের কণ্ঠস্বর প্রকাশের দুঃসাহস থেকেই ৩৪ বছর আগে আমি ‘পাক্ষিক অনন্যা’ প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করি। অনন্যার মাস্টহেড ডিজাইন করিয়েছিলাম কাইয়ুম চৌধুরীকে দিয়ে। মাস্টহেড ডিজাইন করার জন্য যে পারিশ্রমিক দিতে হয়, সেটাও আমি তখন বুঝিনি। আমি কিছুই জানতাম, বুঝতাম না। শুধু বুঝতাম, আমাকে কিছু একটা করতে হবে। নিজের মতো করে কিছু একটা। সেটা হবে এমন একটি প্ল্যাটফরম যেখানে নারীর চোখে মানুষ বিশ্বটাকে দেখবে। এক প্রবল জেদ প্রবল ইচ্ছা ও বাসনা থেকে আমি ১৯৮৭ সালে পাক্ষিক অনন্যা প্রকাশ করতে শুরু করি। এই ৩৪ বছর পরও সেই প্রকাশনা অব্যাহত রেখেছি। ঠেকেছি এবং শিখেছি অনেক কিছু।
পঞ্চাশের দশকে আমার জন্ম। আমি আজন্ম দেখে এসেছি সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে সাধারণ পর্যায়ে নারীর বিশেষ কোনো দাম নেই। সেজন্য ১৯৯৩ সালে যখন দেখলাম একজন নারীর মাথার দাম ৩০ হাজার টাকা ধার্য করা হয়েছে, তখন আমি ভাবলাম—বাব্বা! একজন নারীর মাথার এত দাম! আমার মাথায় তখন নতুন এক ভাবনা এলো। প্রতি বছরই সমাজের নানান ক্ষেত্রে কিছু নারী চমকপ্রদ কিছু অবদান রাখছেন। আমি তাদের খুঁজে খুঁজে সম্মাননা প্রদান করতে পারি। সেই থেকে শুরু ‘অনন্যা শীর্ষদশ সম্মাননা’ প্রদান। নব্বইয়ের দশকে প্রথম দিকে বছরের আলোচিত দশ জন নারীকে খুঁজে পেতে আমাদের একটু বেগ পেতে হতো বটে। কিন্তু এখন বছরে আলোচিত শতনারী খুঁজে পাওয়া যাবে। আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এটাও একটা বিশাল সফলতা বটে। গত আড়াই দশকের অধিক সময় ধরে ২৬০ জন নারীকে আমরা সমাজে বিশেষ অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ ‘অনন্যা শীর্ষদশ সম্মাননা’ প্রদান করতে পেরেছি। কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, অর্থনীতি, অভিনয়, সংগীত, খেলাধুলা, শিক্ষা, চিকিত্সা, মুক্তিযুদ্ধ, সমাজকল্যাণ তথা আইন, মানবাধিকার, উদ্যোক্তা, রাজনীতি, সাংবাদিকতাসহ সমাজ রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিকূলতা ঠেলে যেসব নারী উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছেন, তাদের কর্মসাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ অনন্যা শীর্ষদশ সম্মাননা আমরা অব্যাহত রেখে চলেছি। বিশেষ কিছু করার ক্ষেত্রে কোনো নারী যদি তাঁর জীবনের অথই নদী পার হওয়ার দুর্গম সময়ে আমাদের সামান্য সহযোগিতা কিংবা অনুপ্রেরণা অথবা উত্সাহ পেয়ে থাকেন, সেটাই আমাদের সফলতা।
গত প্রায় দুই বছর আমরা কোভিড মহামারির জন্য অস্বাভাবিক সময় পার করেছি। আপাতত আমাদের দেশে করোনা বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণে এলেও বিশ্বব্যাপী করোনার ওমিক্রন ধরনের জন্য প্রতিটি পদে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ভীষণ জরুরি। গত বছর আমরা অনন্যা শীর্ষদশ ভাচুর্য়ালি অর্থাৎ অনলাইনে করেছিলাম। সকল বিধি মেনে এবার অবশ্য কৃষিবিদ ইন্সটিটিউশন অব বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয় ‘অনন্যা শীর্ষদশ সম্মাননা ২০২০’। যে ১০ জন এবার অনন্যা শীর্ষদশ সম্মাননা পেয়েছেন তাদের নেপথ্য অর্জন সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক।
রূপন্তী চৌধুরী: কুষ্টিয়ার মেয়ে রূপন্তী চৌধুরীর লাঠিখেলা আমি সচক্ষে দেখেছি আমার বাসায়, তার তথ্যচিত্রটির শুটিংয়ের সময়। লাঠিখেলা আবহমানকাল ধরেই প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করার একটি দারুণ পারদর্শিতা। এই উপমহাদেশে লাঠিয়াল বাহিনীর ইতিহাস যথেষ্ট প্রাচীন। তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা কিংবা ফরায়েজী আন্দোলন অথবা ফকির আন্দোলনে লাঠির ব্যবহারের কথা আমরা জানি। কুষ্টিয়ার মেয়ে মঞ্জুরীন সাবরীন চৌধুরী রূপন্তীর লাঠিখেলা আমাকে দারুণভাবে বিস্ময়াভিভূত করেছে। বংশপরম্পরায় লাঠিখেলা রূপন্তীর রক্তে মিশে আছে। তিনি যখন লাঠি হাতে তীব্র গতিতে প্রতিপক্ষ লাঠিয়ালের দিকে তেড়ে যান সে সময় তার চোখে আগুন ঝরে। তাকে ঠেকাতে হিমশিম খেয়ে যায় প্রতিপক্ষ। আর মেয়েরা যদি লাঠিখেলায় পারদর্শী হয়, তাহলে সেই মেয়েকে কে না ভয় পাবে?
জাহানারা আলম: টানা টানা চোখে গাঢ় করে ‘আইলাইনার’ মেখে মাঠে নামেন বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের পেসার জাহানারা আলম। ক্ষিপ্রগতিতে তার বোলিং করার শরীরী ভাষাটাও দুর্দান্ত। বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের ‘অটোম্যাটিক চয়েজ’ তিনি। তাদের হাত ধরেই বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল ওয়ানডে স্ট্যাটাস পেয়েছে। তবে সফলতা থাকলেও তার বিপরীতে অনেক বাধাবিপত্তিও আছে। একটা মেয়ে কেন ক্রিকেট খেলবে, সেটা নিয়ে নাকি তার বাবা-মায়ের কাছেও অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেসব অভিযোগকারীরাই এখন জাহানারাকে তাদের ‘গর্ব’ বলে মনে করে। একদিনের আন্তর্জাতিক ৪২টি ম্যাচে জাহানারা উইকেট পেয়েছেন ৩৯টি। টি-টোয়েন্টিতে ৭১টি ম্যাচ খেলেছেন, উইকেট পেয়েছেন ৫৫টি। উভয় ফরম্যাটে মোট ক্যাচ ধরেছেন ১৮টি এবং রান আউট করিয়েছেন ১১ জন ব্যাটারকে। সর্বোচ্চ উইকেট শিকারের টি-২০-র বিশ্ব র্যাংকিংয়ে জাহানারার বর্তমান অবস্থান অষ্টম।
তাসনুভা আনান: তাসনুভা ট্রান্সজেন্ডার অধিকারকর্মী। তাসনুভাকে নির্বাচিত করার সময় আমার মনে পড়ে যায় আরেকজন ট্রান্সজেন্ডার নারীর কথা—নাদিরা খানম। নাদিরা রংপুর সিটি করপোরেশনে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিল। তথ্যচিত্রে তার সংগ্রামের কাহিনি আমাদের চোখে পানি এনে দেয়। দুঃখজনকভাবে নাদিরা এখন আর বেঁচে নেই। আমাদের এবারের অনন্যা শীর্ষদশ নারী তাসনুভা আনানের শৈশবও অত্যন্ত কষ্টের। যখন থেকে তার নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ার বয়স শুরু হয়, তখন থেকেই বুঝতে পারেন আর দশজনের থেকে তিনি একটু আলাদা। তার মনে হয়েছিল একটি ভুল শরীরে জন্ম নিয়ে ফেলেছেন। তাসনুভাকে জোর করে পুরুষ বানানোর চেষ্টা চলছিল। এটা ছিল তার কাছে অত্যন্ত যন্ত্রণার। তিনি একটি পর্যায়ে মানুষের বিনোদনের খোরাক হতেন। অসহ্য ছিল সেই দিনগুলো। সেসব যন্ত্রণা ফুরোবার নয়। ক্রমশ তিনি মেধার জোরে নিজেকে অন্য স্তরে উন্নীত করেছেন। পাশে পেয়েছেন কয়েক জন আলোকিত মানুষকে। তাসনুভা বাংলাদেশের প্রথম ট্রান্সজেন্ডার নারী, যিনি দেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরে সংবাদপাঠিকা হিসেবে কাজ করেছেন। আমরা চাই, তাসনুভাদের দেখে ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে এ দেশের মানুষের চিন্তার পরিধিটা বাড়ুক।
সেঁজুতি সাহা: সেঁজুতি সাহা যেন বিজ্ঞানী হওয়ার জন্যই জন্মগ্রহণ করেছেন। যখন তিনি সেই ছোট্টটি ছিলেন, দেখতেন রাতের বেলা খাবার টেবিলে কথা হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, সংক্রামক রোগ নিয়ে। সেঁজুতির বাবা ড. সমীর সাহা মাইক্রোবায়োলজির অধ্যাপক। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জ নিয়ে তিনি যখন যা জানতে পারতেন, তা নিয়েও কথা বলতেন ঐ টেবিলে। ঐসব আলাপ সেঁজুতির ওপর বড় ছাপ ফেলেছিল। সেঁজুতি সাহা এগারো বছর কানাডায় পড়ালেখার পর দেশের জন্য কিছু করার বাসনা থেকে ২০১৬ সালে ফিরে আসেন বাংলাদেশে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে শিশুদের মধ্যে মেনিনজাইটিসের সংক্রমণ হঠাত্ অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু এর কোনো ব্যাখ্যা মিলছিল না। সেই সময় সেঁজুতি শিশুদের জিনগত উপাদান বিশ্লেষণ করে এর রহস্য উন্মোচনে সক্ষম হন। বাংলাদেশে প্রথম সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের জিনোম সিকুয়েন্সিংও করেন সেঁজুতি সাহার দল।
স্বপ্না ভৌমিক: স্বপ্না ভৌমিক যখন ২০০৬ সালে মার্চেন্ডাইজার হিসেবে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড মার্কস অ্যান্ড স্পেনসারে যোগ দিতে চাইলেন, তখন তার আগের অফিসের সহকর্মীদের প্রায় সবাই তাকে নিরুত্সাহিত করলেন। কিন্তু স্বপ্নার স্বপ্ন ছিল কীভাবে ব্র্যান্ডটিকে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। মার্কস অ্যান্ড স্পেনসারের ঢাকা কার্যালয় তখন ছোট। লোকবল কম। নিজের দক্ষতা দিয়ে ব্র্যান্ডের কর্তাব্যক্তিদের নজর কাড়লেন স্বপ্না। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে তিনি এমঅ্যান্ডএসের বাংলাদেশের প্রধানের দায়িত্ব পেলেন। ২০১৩ সালে যখন তিনি দায়িত্বটি নেন, তখন ব্র্যান্ডটি বাংলাদেশ থেকে আমদানি করত ১৩ কোটি ডলারের পোশাক। স্বপ্নার নেতৃত্বে ইতিমধ্যে এমঅ্যান্ডএস বাংলাদেশ থেকে আমদানির পরিমাণ শতকোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বড় পদে গেলেও নারী শ্রমিকদের কথা ভোলেননি স্বপ্না ভৌমিক। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মপরিবেশ উন্নত করার পাশাপাশি নারী নেতৃত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নিয়েছেন।
চয়নিকা চৌধুরী: চলচ্চিত্র পরিচালক, শিল্পনির্দেশক ছোট পর্দার জনপ্রিয় নাট্যনির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী। দীর্ঘ ২০ বছরের বেশি সময় ধরে যুক্ত আছেন নাট্য নির্মাণে। ১৯৯৮ সাল থেকে নাট্যকার হিসেবে যাত্রা শুরু হলেও পরিচালনায় আসেন ২০০১ সালে। এখন পর্যন্ত ১৫০-এর বেশি নাটক লিখেছেন। পরিচালনা করেছেন ৪১৫টি একক ও ১৬টি ধারাবাহিক নাটক। সর্বশেষ গত বছর ১১ ডিসেম্বর চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে তার অভিষেক হয় বড় পর্দায়। ‘বিশ্বসুন্দরী’ নামের চলচ্চিত্রটি শুধু মানবপ্রেমের কথা বলেনি, বলেছে দেশপ্রেমের কথাও।
অল্পনা রানী: যুগে যুগে নারীরা প্রাকৃতিক সম্পদ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে টিকিয়ে রেখেছে প্রাণবৈচিত্র্য এবং আমাদের খাদ্যভান্ডার। সারা দেশে যখন বইছে হাইব্রিড বীজে চাষাবাদের জোয়ার, তখন সাতক্ষীরার অল্পনা রানী মিস্ত্রী চলেছেন বিপরীত স্রোতে। দেশি বীজ সংগ্রহ করে চাষাবাদ করছেন তিনি। বাড়ির আঙিনাকে পরিণত করেছেন সবজির খেতে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় অনেক জাতের ধান ও সবজির এখন উত্পাদন হয় না। কিন্তু স্থানীয় জাতের বীজ স্থানীয় পরিবেশের সঙ্গে সবচেয়ে ভালোভাবে খাপ খাওয়াতে পারে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিস্থিতিতে এ ধরনের বীজই সবচেয়ে উপযুক্ত। দেশীয় বীজে চাষাবাদ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন সাতক্ষীরার অল্পনা রানী মিস্ত্রী। শুধু নিজেই দেশীয় বীজে চাষাবাদ করছেন না অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করতে বিনা মূল্যে বীজ বিতরণ করছেন।
লাফিফা জামাল: কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিয়ারিং নিয়ে পড়ার সময় রোবটিকস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং নিয়ে কাজ করেছেন লাফিফা জামাল। সুতরাং ২০১৫ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হয় দেশের প্রথম রোবটিকস শিক্ষার বিভাগ তখন সিএসই বিভাগের নিয়মিত কাজের বাইরে রোবটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগে শিক্ষকতায় যুক্ত হন লাফিফা। ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ লাফিফা জামালকেই এই নতুন বিভাগ গড়ার দায়িত্ব দেয়। সাড়ে তিন বছর ধরে তিলে তিলে বিভাগটিকে তৈরি করেছেন লাফিফা, তার সহকর্মীদের নিয়ে। তারই নেতৃত্বে ২০১৮ সালে ফিলিপাইনে আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো যোগ দিয়ে লাভ করে স্বর্ণপদক। ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রেখে ২০১৯ সালেও স্বর্ণপদক পেয়েছে বাংলাদেশ। দারুণ ব্যাপার হলো, রোবট অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই নারী।
শাহীদা বেগম: ৩২ বছর ধরে কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন ফরিদপুরের শাহীদা বেগম। পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের বাড়ির কাছেই তার শ্বশুরবাড়ি। আর সেখানেই ২০০৪ সাল থেকে পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছেন শাহীদা বেগম। শুধু ফরিদপুর জেলাই নয়, দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ বীজ উত্পাদন করে থাকেন তিনি। গত বছর তিনি পেঁয়াজের বীজ বিক্রি করেছেন ৪ কোটি টাকার। উত্পাদন খরচ বাদ দিলে শাহীদার আয় হয়েছে প্রায় ৩ কোটি টাকা। কৃষিকাজ অত্যন্ত পরিশ্রমের। নিবিড় যত্নে প্রতিটি চারাগাছ বড় করে তুলতে হয়, ঠিক যেভাবে মা তার সন্তানকে বড় করে তোলেন। শাহীদা বেগম কেবল সফল উদ্যোক্তাই নন, তার মাধ্যমে তৃণমূল স্তরের শত নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানও হয়েছে। তার প্রমাণ পাওয়া গেছে করোনা মহামারির সময়।
কামরুন্নাহার জাফর: চট্টগ্রামের বিশিষ্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. এ কে এম আবু জাফরের সঙ্গে জীবনটা বেশ চমৎকার কেটে যাচ্ছিল বেগম কামরুন্নাহার জাফরের। স্বামী জাফর ছিলেন ভাষা আন্দোলনের সম্মুখসারির কর্মী, আর উনসত্তরের স্বাধিকার আন্দোলনের আগেই কামরুন্নাহার জাফর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের মহিলা কমিটির একনিষ্ঠ কর্মী হয়ে ওঠেন। ১৯৭১ সালে স্বামী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। সবকিছু ভালোই চলছিল; কিন্তু ১৯৭৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি কামরুন্নাহারের স্বামী ডা. জাফর অকস্মাৎ মৃত্যুবরণ করেন। ডা. জাফরকে স্নেহ করতেন বঙ্গবন্ধু। জাফরের মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু বেগম কামরুন্নাহারের ছেলেমেয়ের পড়ালেখায় সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসেন। কিন্তু এর কিছুদিন পরই ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নির্মম হত্যার শিকার হন। ছয় ছেলেমেয়ের সংসার চালাতে কামরুন্নাহার একটি কাজের খোঁজে নেমে পড়েন। কামরুন্নাহারের স্বামী সেনাবাহিনীর চক্ষুচিকিত্সক ছিলেন বিধায় জিয়াউর রহমান কামরুন্নাহারকে চিনতেন। সেই সুবাদে কামরুন্নাহারের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায় শুরু হয়। তিনি ১৯৭৯ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য, জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। ‘ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট’—এটা কামরুন্নাহার জাফরের নেতৃত্বে বাংলাদেশে প্রথম হাজার ইউনিয়নে ক্লিনিক করে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর তিনি ১৯৮০ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৮১ সালে শ্রম, সমাজকল্যাণ এবং জনশক্তি উন্নয়নের উপমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সালে ভারপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৮৯ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। বেগম কামরুন্নাহার দেশ ও জাতিকে ভালোবেসে কাজ করেছেন সততার সঙ্গে। নারী নেতৃত্বের অন্যতম অগ্রপথিক বেগম কামরুন্নাহার জাফর।
এবারের অনন্যা শীর্ষদশ সম্মাননাপ্রাপ্ত সবাইকে জানাই সাদর সম্ভাষণ ও অভিনন্দন।
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক ও পাক্ষিক অনন্যা