বেহুল
উপমায় নীলাভ বেশে, তোমায় দেখতে চেয়েছি
পুরো আকাশ জুড়ে;
শেষ দেখা হবে তো তোমার সাথে আমার নাকি তাও হবে না। কত কাল দেখি না তোমায়, দেখি না বাইরের জগৎ। ঘরের বাইরে রাখা হয় না দু-চরণ, দিনশেষে আমি একাই লড়ি। একাই মরি।
ছাত্র পড়ায় দু-হান, লোকের বাড়ি গিয়া সেলাই শেখায়। আপনেরে দেখবার লাগি নামাজে বসি কত কাঁদিছি। আপনেরে দেহনের লাইগা, মনডা ভীষণ ছটফট করে আমার; সেদিন রাইতে আপনেরে আবছা স্বপ্নে দেখছিলাম। আমার চুলে জবা ফুল গাঁইতা দিতাছেন।
রোজ মনডা চাই, আপনে আমারে সময় দেন কিন্তু আপনে তো মোরে দেখায় দিতে চান না। কেমন মানুষ আপনে! মোর লাগি আপনের প্রাণ-ডা বুঝি কাঁন্দে না।
মুঁই বেহুল কইতাছি, থাহি ঢাহা শহরে। আমার সামীর খবর জানেন নি আন্নে।
আপনার স্বামীর কী নাম?
কেমনে কই আন্নেরে ইনার নাম-ডি, মুখে সামীর নাম লইতে নাই। আল্লাহ মাফ করেন। আমার সামীর নাম হইতাছে গিয়া। রেজাউল করিম।
জ্বী না এই নামে এখানে কেউ থাকে না।
দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো বেহুল। খালি পা দুটোর দিকে নজর যেতেই মন খারাপ হয়ে গেলো। কত শখ ছিলো তার আলতা পায়ে, তার স্বামী নূপুর পড়িয়ে দিবে।
সারাদিন কাজ করে বাসায় এসে তাকে একটু সময় দিবে। সে তার স্বামীর ঘামে ভিজে যাওয়া শরীর মুছে দিবে তার পরণের শাড়ীর আঁচলখানা দিয়ে।
শুক্রবার পবিত্র জুম্মাবারে বিকেলে নামাজ শেষ করে ঘুরতে বের হবে দুজনে, তার স্বামী থাকে ঝালমুড়ি কিনে দিবে। দুজন বসে বসে ঝিলের ধারে বসে প্রেম করবে।
ফুচকা খেতে মন চাই কিন্তু স্বামীর যা ৩০টাকা খরচ হয়ে যাবে তাই ১০ টাকায় সীমাবদ্ধ থাকে বেহুল।
আজকাল নৈব্যক্তিক শীট করে দিয়ে ২০ টাকা করে পাচ্ছে সে, এইচএসসি পর্যন্ত পড়া হয়েছে শুধু পরীক্ষা-টা দেওয়া হয় নি।
অনলাইনের কী সব কাজ করে অল্পক্ষাণিক ইনকাম করে। স্বামী তো নেই এখন, ইন্ডিয়ায় থাকে।
রোজ রোজ মা-বাবার খোঁটা শুনতে কার ভালো লাগে। তাদের উপর ছোটবোনটার দায়িত্ব রয়ে গিয়েছে যা এখনো, বেহুলের হঠাৎ চোখ দুটো লেগে এলো।
তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো এক ভয়ানক সময়, তার প্রেমিক ইরফান হাসান। অনেক ভালোবাসতো তাকে কিন্তু সেই ভালোবাসার সুযোগ নিয়ে সে আমার চরিত্রে যা দাগ লাগিয়ে গেলো।
সমাজের কারো কাছে মা-বাবা এখনো মুখ তুলে তাকাতেই পারে না।
ভালোবাসার টানে গিয়েছিলাম অতি আবেগে কিন্তু জোর পূর্বক আমার সাথে শারীরিক সর্ম্পকের সেই ভিডিও ক্লিপ দিয়ে বেহুল কে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে।
হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠে বসে নিজের বিছানায় বেহুল। তার নামের সাথে আরো একটা নাম যুক্ত হয়েছে আজকাল, ধর্ষিতা!
সমাজ ধর্ষিতা কে নিয়ে যতো আগ্রহ দেখায়, তেমন আগ্রহ যদি ধর্ষণকারীর ব্যাপারে দেখাতো। তাহলে হয়ত এতদিনে অনেক আত্মা শান্তি পেতো।
সমাজ কী চাই না নারীরা নিজের পায়ে দাঁড়াক; সমাজ কী চাই না নারী ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পুলিশ হোক।
তাহলে তাদের স্ত্রী বা মা অসুস্থ হলে মহিলা ডাক্তার কেন খুঁজে বেড়ায় সবসময়। গর্ভবতী মহিলাদের জন্য কেন মহিলা ডাক্তার খুঁজে।
অনেক ভেবে ও এসব প্রশ্নের উত্তর পায় নি বেহুল। সারাদিন বিছানায় বসে রুমের দরজা বন্ধ করে জানালা দিয়ে স্বামীর ফিরে আসার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে ফ্যাল ফ্যাল করে।
তার দৃষ্টি বহুদূর প্রসারিত হয় কিন্তু সেই চোখের ভাষা যেন শেষ। এই চোখ দুটো আজকাল কিছু বলে না, কিছু বলতে চায় ও না কাউ কে;
সারাদিন রুমে পরে থাকে মুখ গোমাড়া করে বেহুল।
কারো সাথে কথা কই না, ঘরের বাইরে কাজ ছাড়া পা রাখে না।
ঘর থেকে এজন্যই বের হয় না পাছে না কোনো দম্পতি কে একসাথে দেখে ফেলে। কোনো দম্পতি কে দেখলে তার স্বামীর কথা মনে যায়। বুকের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙ্গে যায় কাঁচের টুকরোর মতো, কখনো বাইরের কাউ কে বুঝতে দেয় না।
সারাক্ষণ খালি রুমের ভেতর দরজা বন্ধ করে চোখের জলে কপোল ভাসিয়ে দেয়।
আজকাল নামাজে বসলে দুটো জিনিস চাই আল্লাহর কাছে বেহুল!
তার স্বামী যেন বাড়ী ফিরে আসে আর তার ধর্ষণকারীর যেন শাস্তি হয়।
নামাজে বসে কত চোখের জল ফেলে কিন্তু কোনো কাজ হয় না। তার ধর্ষণকারী তার সামনেই চলাফেরা করছে দিব্যি।
আজ হঠাৎ কাজল দিতে বসে খুব অবাক করে আয়নায় নিজের দিকে চেয়ে আছে। চোখের নিচে তো এমনিতেই কালো দাগ পড়ে গিয়েছে।
সে কত সুন্দর করে সাজতো আগে, নাকে নথ, কানে দুল, খোঁপায় জবা গুঁজে, চোখে মাখত কাজোল।
ঐ ভালাবাসা তার জীবনে কাল হয়ে এসে সব শেষ করে দিয়ে গিয়েছে। তার জীবনে মা হওয়া আর হবে না। মা ডাক শোনা তার কপালে নেই।
তার স্বামী তার খোঁজ ও নেয় না। কখনো মনের কথা কাউ কে বলতে পারে নি বেহুল।
সবাই তার পিঠপিছে তাকে নিয়ে সমালোচনা করে, কেউ কেউ তো আবার দরদাম করতে আসে।
অসুস্থ লাগে আজকাল তার নিজে কে, ভীষণ অসুস্থ লাগে। রাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে আবার সকাল হতে হতে দিব্যি ভালো।
এই কেমন অসুখ তার, এই অসুখেও কোনো সুখ নেই, স্মৃতি নেই।
জ্বর হলে কেমন সব স্মৃতি ভেসে আসতো আগে, এখন তাও আসে না। মাঝে মাঝে মনে হয় হায়াত বোধহয় কমে আসছে কিন্তু পরক্ষণেই মন কে বলে না না এই হতে পারে না।
তার স্বামী ফিরবে, তার ধর্ষণকারীর একটা বিচার হবে। এসব তার দেখে যেতে হবে।
মাঝরাতে যখন সবাই ঘুমাই তখন সে টুক করে উঠে ঝুম বৃষ্টি তে ভিজে নেয়। দারুণ লাগে তাকে ভেজা চুলে, কপালের মাঝখানে কালো টিপটা লেগে থাকে।
বৃষ্টির শব্দে ওর শেষরাতটা ও পাড় হয়ে যায়। বেহুল মাঝে মধ্যে ভাবতে ভাবতে কপোল ভিজিয়ে ফেলে।
এত দুঃখ কেন তার জীবনে?
বিধি কী তার দিকে মুখ তুলে চাইবে না কোনো দিন, এই ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো।
পরদিন সকালে ভীষণ দেরী করে ঘুম ভাঙ্গলো। মায়ের বকা শুনতে শুনতে তাও আবার,
হো মহারাণীর সময় হইছে ঘুমোতেন উডিবার।
খালি খাই আর ঘুমায় কোনো কাইজ-কাম নাই হেতির, জন্ম লইনের সময় মইরলি না ক্যান।
এইকথা বলতে বলতে কান্না করে দিলো বেহুলের মা। তার কত হাসিখুশি আর আনন্দে ভরা মেয়েটার জীবন শেষ হয়ে গেলো এক ঝটকায়।
সূর্য তখন ঠিক মাথার উপর বেলা বারোটা বাজে, বেহুল নায়তে গিয়ে ভেজা কাপড়ে ঘরের গোসলখানায় ডুকে শাড়ী পাল্টাতে পাল্টাতে চোখ গেলো গোসলখানার এক দেয়ালের দিকে, ভালো করে দেখে কী! দুটো ইটের মাঝে হালকা একটু আলো প্রবেশ করছে গোসলখানায়।
একটু পর দেখে সেই আলো নিভে গেলো মানে হয়ত কেউ সেই ইটের ফাঁকে চোখ রাখলো তাকে দেখার জন্য,
কে ওহানে? কে কন কইতাছি?
কাপড় পড়ে বের হওয়ার আগেই পালালো সেই চোর, যে চুরি করে তাকে দেখছিলো।