গঙ্গা: মহাভারতের আলো আঁধারি চরিত্র
গঙ্গা—কুরুরাজ শান্তনুর স্ত্রী ও দেবব্রত ভীষ্মের মা। শান্তনু ছিল পাণ্ডব ও কৌরবদের প্রপিতামহ। কুরুর অষ্টম পুরুষের নাম শান্তনু। পূর্বজন্মে শান্তনুর নাম ছিল রাজা মহাভিষ। অনেক তপস্যার ফলে রাজা মহাভিষ স্বর্গে যাত্রা করেন। এরপর স্বর্গের নারীশ্রেষ্ঠা গঙ্গার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে কামনা করেন। গঙ্গা ও শান্তনুর জাগতিক কামনা করে বিধায় ব্রহ্মার অভিশাপে দুজনেই মর্ত্যে জন্মগ্রহণ করে।
রাজা মহাভিষ পূর্বজন্মে গঙ্গাকে পত্নীরূপে পেতে চাইলেও মর্ত্যে জন্মগ্রহণ করে পূর্ব জন্ম ভুলে যায়। একদিন হঠাৎ হস্তিনাপুরের পরম ধার্মিক রাজা শান্তনু মৃগয়ার জন্য বনে যায়। বিভিন্ন স্থান ঘুরে একসময় গঙ্গাতীরে উপস্থিত হয় রাজা শান্তনু। ঠিক তখনই গঙ্গা শান্তনুর সামনে প্রকট হয়। গঙ্গার রূপে মুগ্ধ হয়ে রাজা শান্তনু গঙ্গাকে পত্নীরূপে পেতে ইচ্ছা পোষণ করে। কিন্তু পূর্বজন্মের কথা স্মরণ করে গঙ্গা শান্তনুকে শর্ত দেয়। শান্তনুকে একটি শর্তেই বিয়ে করতে প্রস্তুত যদি তার কোনো কাজেই বাধা প্রয়োগ না করে। আর যেদিন বাধা আসবে, সেদিনই শান্তনুকে ত্যাগ করার কথা বলে। কিন্তু গঙ্গাকে কমানায় রাজা শান্তনু এতটাই বিভোর যে গঙ্গার সব শর্ত নির্দ্বিধায় মেনে নেয়। ফলে শান্তনুর সঙ্গে গঙার বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যায়!
পরম সুখে দিন অতিবাহিত হতে থাকে। একসময় গঙ্গা এক পুত্র সন্তান প্রসব করে। কিন্তু শান্তনু অবাক হয়ে লক্ষ করে গঙ্গা সদ্যজাত সন্তানকে নিয়ে নদীতে নিক্ষেপ করে। পূর্বশর্ত অনুযায়ী রাজা শান্তনু নির্বিকার থাকে। এভাবে একে একে সাত পুত্র প্রসব করলে নদীতে বিসর্জন দেন। কিন্তু অষ্টম পুত্র জন্মগ্রহণ করলে রাজা শান্তনু আর সংযত থাকতে পারে না। সন্তান বিসর্জনের আগেই গঙ্গার উদ্দেশে শান্তনু বলে ওঠে মানবী না কি পিশাচী সে! নিজের সন্তানকে কিভাবে এত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করতে পারলো! তখন গঙ্গা স্বমূর্তি ধারণ করে ও বলে আমি ত্রিধারা গঙ্গা। আপনার ঔরসে আমার গর্ভে যে আটজন পুত্র জন্মগ্রহণ করেছে এরা হলো স্বর্গের অষ্টবসু।
শান্তনুর মৃত্যুতে বা তার পত্নী গ্রহণেও গঙ্গার পক্ষ থেকে কোনোই পদক্ষেপ দেখা যায়নি। কারণ তার চরিত্র নির্মাণে লেখক যেমন আলোর সন্ধান করেছেন, তেমনি তাকে রেখেছেন অন্ধকারে!
মহর্ষি বশিষ্ঠের অভিশাপে মানবজন্ম গ্রহণ করতে হয়। সাতজন বসু জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিলাভ করে স্বর্গে চলে গেছে। কিন্তু অষ্টম পুত্রকে মানবজন্ম অতিবাহিত করতে হবে। শান্তনু শর্ত ভঙ্গ করায় গঙ্গা নবজাতক শিশুকে নিয়ে প্রস্থান করে। ছত্রিশ বছর পরে রাজোচিত শিক্ষা দিয়ে পুত্রকে শান্তনুর হাতে অর্পণ করে। গঙ্গার এই পুত্রই দেবব্রত ভীষ্ম নামে জগতে অসাধারণ খ্যাতি লাভ করে।
গঙ্গার জীবনকাহিনি পুরোটাই দৈববলে নির্মিত। মহাভারতের সাধারণ নারীদের সঙ্গে তাকে মেলানো ভার! মর্ত্যে আসলেও তার কাজই ছিল বশিষ্ঠের অষ্টবসুকে শাপমুক্ত করা! যদি তাই না হবে তাহলে গঙ্গা সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে বংশধর নিয়ে হস্তিনাপুরে রাজরাণী হয়ে থাকতে পারতো। তবে তখন মহাভারতের কাহিনি নির্মাণেই আসতো আমূল পরিবর্তন!
গঙ্গাপুত্র ভীষ্মই হয়তো তখন রাজ্যভার গ্রহণ করতো এবং তার বংশধরেরা হস্তিনাপুর শাসন করতো। কিন্তু কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন তার কাহিনি নির্মাণের গন্তব্যে পৌঁছাতেই যেন গঙ্গাকে দৈববলে নির্মান করেছেন। স্বামী-সংসার ত্যাগ করেও তার মধ্যে কোনো আক্ষেপ-কষ্ট চিত্রিত করেননি। আবার সন্তানকে বড় করে শান্তনুর কাছে প্রত্যার্পণ করলেও সেখানে থেকে গেছে নিস্পৃহ! সন্তানের মঙ্গল কামনায় দূর থেকেই যেন আশীর্বাদ করেছে। শান্তনুর মৃত্যুতে বা তার পত্নী গ্রহণেও গঙ্গার পক্ষ থেকে কোনোই পদক্ষেপ দেখা যায়নি। কারণ তার চরিত্র নির্মাণে লেখক যেমন আলোর সন্ধান করেছেন, তেমনি তাকে রেখেছেন অন্ধকারে!
তাই গঙ্গা চরিত্রটির পরিপূর্ণ রূপ ফিকে হয়ে গেছে। মায়ের মমতার খানিক প্রকাশ ঘটলেও গঙ্গা হয়ে স্রোতযুক্ত হয়েই কেটেছে। সেখানে মানবী নয় বরং দেবী রূপেই থেকেছে! মহাভারতের গঙ্গা নীরবে বয়ে গেছে ভীষ্মের সেবাধর্মের মধ্যে দিয়ে। যে নবজন্ম সৃষ্টি করে একটি বংশের মূল রক্ষক সেই গঙ্গাও থেকেছে নীরবে, নিভৃতে!
অনন্যা/জেএজে