Skip to content

নারী কমিশনের সুপারিশ: বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, হেফাজতের আপত্তি

নারী কমিশনের সুপারিশ: বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, হেফাজতের আপত্তি

কিছু বিষয়ে সমালোচনা করলেও বাংলাদেশে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা৷ অন্যদিকে বিরোধিতা করে কমিশন বাতিলের দাবি করেছে হেফাজতে ইসলাম।

নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে গঠিত নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন শনিবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেন৷ প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর জানিয়েছে, এর পরপরই মন্ত্রণলায় ও বিভাগকে সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেন অধ্যাপক ইউনূস৷

নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা স্বাগত জানানোর পাশাপাশি প্রস্তাবের কিছু বিষয়ের সমালোচনা করেছেন৷ সুপারিশে কিছু অস্পষ্টতা ও দৃষ্টিভঙ্গিগত সমস্যা রয়েছে বলে মনে করেন কেউ কেউ৷ সেই সঙ্গে লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর অধিকারের বিষয় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন৷

অন্যদিকে হেফাজতে ইসলাম সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকারসহ আরো কয়েকটি বিষয়ে বিরোধিতা করেছে৷ শুধু বিরোধিতা নয় কমিশন বাতিলের দাবিও জানিয়েছে তারা৷

প্রস্তাবে যা আছে

নারী বিষয়ক কমিশন মোট ৪৩৩টি প্রস্তাব বা সুপারিশ দিয়েছে৷ অভিন্ন পারিবারিক আইনের মাধ্যমে সব ধর্মের নারীদের জন্য বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণে সমান অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে৷ নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর লক্ষ্যে সংসদীয় আসন বাড়িয়ে ৬০০ করে সেই আসন থেকে ৩০০ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রেখে সরাসরি নির্বাচনের সুপারিশ করা হয়েছে৷

নারী বিষয়ক কমিশন প্রতিষ্ঠা, নারীর প্রতি সহিংসতা ও হয়রানি প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা, বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে ফৌজদারি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা, ধর্ষণের শিকার হওয়া অন্য লিঙ্গের মানুষের বিচার ও আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিতে আইনে ধর্ষণ ধারায় সংস্কার আনা, যেকোনো উপস্থাপনায় অহেতুক নারীর প্রসঙ্গ টেনে নারীবিদ্বেষী বয়ান, বক্তব্য ও ছবি পরিবেশন থেকে বিরত থাকা, নারীর প্রতি সম্মানজনক, মর্যাদাপূর্ণ ও যথাযথ সংবেদনশীল আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির লক্ষ্যে সামাজিক সচেতনতা বিষয়ক কর্মসূচি নেওয়ার সুপারিশও করা হয়েছে৷

পাশাপাশি নারীর মৃত্যুদণ্ড বিলোপ করা, যৌনপেশাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত না করা এবং শ্রম আইন সংশোধন করে যৌনকর্মীদের মর্যাদা ও শ্রম অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে৷ আন্তর্জাতিক চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ‘নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদের (সিডো) দুটি ধারার ওপর সংরক্ষণ প্রত্যাহার, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ১৮৯ ও ১৯০ অনুচ্ছেদ অনুস্বাক্ষর করার সুপারিশ করেছে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন৷

একই সঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো সব প্রতিষ্ঠানে মাতৃত্বকালীন ছয় মাস ছুটি দেয়া এবং পূর্ণ বেতনসহ পিতৃত্বকালীন ছুটি দেয়া, প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপনের মতো সুপারিশ রয়েছে প্রতিবেদনে৷

কমিশনের প্রতিবেদনে গণমাধ্যমের প্রতিটি শাখা ও স্তরে ৫০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা ২০১৪ অনুসরণ করে সব ধরনের গণমাধ্যমে নারীর নেতিবাচক উপস্থাপন বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে৷ গণমাধ্যমে অংশগ্রহণের জন্য নারীকে যৌনবস্তু হিসেবে ব্যবহার না করা, অহেতুক নারীর প্রসঙ্গ টেনে নারীবিদ্বেষী বয়ান বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে৷

নারীর স্বার্থ ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়ন, নারী ও মেয়েশিশুর জন্য সহিংসতামুক্ত সমাজ, জনপ্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণ, নারীর অগ্রগতির জন্য শিক্ষা, প্রযুক্তি ও দক্ষতা বাড়ানো, সব বয়সি নারীর জন্য সুস্বাস্থ্য, শ্রমে অংশগ্রহণ ও সম্পদের অধিকার, নারী শ্রমিকের নিরাপদ অভিবাসন, দারিদ্র্য হ্রাসে টেকসই সামাজিক সুরক্ষা, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিতে নারীর অন্তর্ভুক্তি ও বিকাশ, দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা নারীদের জীবন ও সম্পদ রক্ষার সুপারিশ করা হয়েছে৷

ইতিবাচকতা ও সমালোচনা

সুপারিশগুলোকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা৷ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, ‘‘এপর্যন্ত সংবাদমাধ্যম থেকে কমিশনের সুপারিশের ব্যাপারে যা জেনেছি তাতে আমার প্রস্তাবগুলো ইতিবাচকই মনে হয়েছে৷ এখন প্রশ্ন হলো এগুলো কবে বাস্তবায়ন হবে, কীভাবে হবে?’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার, নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন, এগুলো আমাদের দাবি ছিল৷ নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনসহ আসন ৬০০ করার প্রস্তাব ভালো৷ তবে এরইমধ্যে কোনো কোনো গোষ্ঠী এর বিরোধিতা শুরু করেছে৷ আমার কথা হলো কোনো ধর্মের ভিত্তিতে নয়, রাষ্ট্রের নাগরিক ও মানবাধিকারের ভিত্তিতে নারীর জন্য আইন ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে৷’’

তার মতে, যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসবে স্বীকৃতির বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক আছে৷ কোনো অসম্মানজনক পেশা বা জোর করে যে পেশায় বাধ্য করা হয় সেটা পেশা কিনা আগে ভাবতে হবে৷ ‘‘তবে নারীর জন্য কোটা রাখতেই হবে,” অভিমত তার৷

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সমালোচনা করে বলেন ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বলেন, “যৌনকর্মী যেন নারীরাই হয় এই ধরনের চিন্তার প্রতিফলন আমি দেখতে পেয়েছি এই প্রতিবেদনে৷ এটা নারী পুরুষ বা অন্য লিঙ্গের হতে পারে৷ ফলে এখানে দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা আছে৷”

নারীদের জন্য নির্দিষ্ট আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিষয়টি নিয়ে অস্পষ্টতা রয়ে গেছে বলে মনে করেন তিনি৷ আসন কীভাবে বন্টন করা হবে, শ্রমিক নারী কতজন হবে, বেদে বা হিজড়াদের কতটি আসন থাকবে এমন সব বিষয় অস্পষ্ট রয়ে গেছে বলে মত তার৷

“তালাক আর সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে যা বলা হয়েছে তা আমার ভালো লেগেছে৷ কিন্তু অবিবাহিত নারী শিশু দত্তক নিতে পারবে কিনা তা পরিস্কার করা হয়নি৷ লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর যারা আছেন তাদের অধিকারের বিষয়গুলো একদমই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে,” বলেন তিনি৷

তিনি বলেন,” এখনও শব্দ চয়নে জেন্ডার বৈষম্য আছে৷ তা দূর করার প্রস্তাব নেই৷ রাষ্ট্রপতি শব্দ বহাল আছে৷ ধর্ষণের শিকার না বলে ধর্ষিতা বলা হচ্ছে৷ আর যৌনকর্মী বলতে শুধু নারীদেরই বোঝানো হয়েছে৷ যেকোনো লিঙ্গের মানুষই যৌনকর্মী হতে পারেন৷ আবার সম্পত্তির সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে৷ কিন্তু প্রতিবন্ধি নারী ও শিশুর জন্য কী বিধানের কথা বলা হয়েছে? আমার চোখে পড়েনি৷”

বিতর্কের বিষয়

তবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, ‘‘আমি যতটুকু জেনেছি তাতে এখন পর্যন্ত সুপারিশগুলো আমার কাছে ইতিবাচকই মনে হয়েছে৷ কিন্তু এগুলো বাস্তবায়নের আগেই হেফাজতে ইসলাম এর বিরোধিতা শুরু করেছে৷ তারা কমিশনই বাতিল চেয়েছে৷ তাহলে সরকার তাদের কীভাবে সামলাবে সেটা তারা দেখবে৷”

তিনি বলেন,” ইসলামের কথা বলে তারা সম্পত্তিতে নারীদের সামান অধিকারের বিরোধিতা করছে৷ কিন্তু দেশে আইন আছে যে পিতা-মাতার ভরণপোষনের দায়িত্ব ছেলে মেয়ের উভয়ের সমান৷ তার বিরোধিতা তারা করছে না৷ আবার তারা যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার বিরোধিতা করছে, কিন্তু যে পুরুষ যৌনকর্মীদের কাছে যায় তাদের ব্যাপারে কিছু বলছে না৷ তারা যেখানে ধর্ম ব্যবহার করায় সুবিধা সেখানে ব্যবহার করছে৷”

অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মুফতি আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, ‘‘কমিশন মুসলিম পারিবারিক আইনের বিরোধিতা করেছে৷ ইসলামই নারী পুরুষের সম্পত্তির অধিকারে বিধান করে দিয়েছে৷ ইসলাম নারীর অধিকার দিয়েছে৷ সমান অধিকার কোনো ন্যায্য কথা নয়৷ ন্যায্য কথা হলো যার যা অধিকার তা সে পাবে৷ আর তারা ২০১২ সালের নারী নীতিমালা পুনর্বাহলের সুপারিশ করেছে৷ আমরা ওই নারী নীতিমালা আগেই প্রত্যাখ্যান করেছি৷ আর যৌনকর্মীদের যে শ্রমিকের অধিকার দেয়ার কথা বলা হয়েছে এটা গ্রহণযোগ্য নয়৷ এটা কোরান ও সুন্নাহ বিরোধী৷”

তিনি বলেন, ‘‘আমরা সংবাদ সম্মেলন করে এই কমিশন বাতিল চেয়েছি৷ ৩ মে আমাদের মহাসমাবেশ আছে৷ তার আগে আমরা সংবাদ সম্মেলন করে এ নিয়ে আরো বিস্তারিত আমাদের অবস্থান জানাবো৷’’