শিক্ষা ও দক্ষতা নারীর বড় শক্তি: শামস আফরোজ চৌধুরী
বলছি একজন স্বাধীন ও সফল নারী বিষয়বস্তু নির্মাতার কথা। তিনি শামস আফরোজ চৌধুরী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তিনি ‘থটস অব শামস’ নামেই পরিচিত। মজাদার সব ভিডিও কনটেন্টে নানা চরিত্রে অভিনয়ের মধ্যে তিনি জয় করেছেন লাখ দর্শকের মন। আর এসব কন্টেন্ট শেয়ার হয়েছে হাজার হাজার। সম্প্রতি পাক্ষিক অনন্যার পক্ষ থেকে এই কনটেন্ট ক্রিয়েটরের মুখোমুখি হয়েছেন তামান্না তাবাসসুম ত্রেয়া।
অনন্যা: স্বাধীনচেতা নারীর ভাবনা সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন…
শামস আফরোজ চৌধুরী : আমার কাছে নারী পুরুষ যেকোনো মানুষের স্বাধীনতা বলতে এই বোঝায় না যে, সে যা ইচ্ছে, তাই করতে পারবে। বা তা করার ক্ষমতা রাখবে। আমি একজন নারী হয়েও কখনোই নারীদের আলাদা করে দেখি না বা আলাদা কিছু ভাবি না। আমার কাছে মনে হয়, নারীরা মানুষ। আলাদা অন্য কিছু নই। আর একজন মানুষের স্বাধীনতা বলতে আমি বুঝি তার সব অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা। তার সুস্থ চিন্তাগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা। আর একজন মানুষ যখন তার সবগুলো অধিকার আদায় করতে সক্ষম হয় এবং তার চিন্তাধারাগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়, তখনই সেই মানুষটাকে স্বাধীন বলা যেতে পারে।
অনন্যা: নারী হিসেবে আপনারা যেই প্রফেশনটিকে বেছে নিয়েছেন, সেখানে কী কী প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। সেগুলো কিভাবে মোকাবিলা করেছেন?
শামস আফরোজ চৌধুরী: আমি নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী মনে করি। কারণ আমি এমন একটি পরিবারে জন্ম নিয়েছি, যেখানে মেয়ে মানে এই না যে, তাকে ১৮/১৯/২০ বছর বয়সেই বিয়ে দিয়ে দিতে হবে, তার লেখাপড়ার অত প্রয়োজন নেই, এবং তার দক্ষতা শুধু ঘরের কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।
অনন্যা: নিজেদের কাজের ক্ষেত্রে বা ব্যক্তিজীবনে এই চলার পথটা কেমন দেখতে চান?
শামস আফরোজ চৌধুরী:আমি ছোটবেলা থেকে দেখেছি, আমার মা একদম শুরু থেকেই আমার লেখাপড়া নিয়ে ছিল অনেক বেশি সচেতন। আমার গ্রাজুয়েশন ও পোস্ট গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার ক্ষেত্রেও আমার মা আমাকে অনেক বেশি এনকারেজ করেছেন। এমনকি লেখাপড়া শেষ করে আমি নিজের পায়ে দাঁড়াবো বা আমার নিজের একটা পরিচয় হবে, সেটা নিয়েও আমার মায়ের কম স্বপ্ন ছিল না। যখন আমি কনটেন্ট মেকিং শুরু করলাম এবং এই কাজকে যখন আমার প্রফেশন হিসেবে নিলাম, তখন আমার পরিবার আমাকে মানসিকভাবে সব রকম সাপোর্ট দিয়েছিল। কিন্তু আফসোস আমাদের সমাজে এখনো এমন অনেক পরিবার আছে, যেখানে মেয়েদের লেখাপড়াকে খুব একটা সিরিয়াসলি নাওয়া হয় না, তাদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ব্যপারে মা-বাবা কোনো উৎসাহ দেন না। অনেক মেয়েকে এই কারণে সারাজীবন সাফার করতে হয়। এমনকি অনেকে মেয়ের জীবনই নষ্ট হয়ে যায়৷ তাই আমার চলার পথটা মসৃণ হলেও খুব দুঃখজনকভাবে বলতে হচ্ছে, অনেক মা-বোনের চলার পথ খুব কঠিন। অনেক ক্ষেত্রে তাদের চলার কোনো পথই নেই। আবার শুধু পরিবারের দোষ দিলেও ভুল হবে। কারণ অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনেক নারী নিজেদের অধিকার আাদায়ে ও সাবলম্বী হওয়ার ব্যাপারে নিজেরাই সচেতন নন। শিক্ষা ও দক্ষতা একটা মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি এবং নারীদের ক্ষেত্রেও তাই।
অনন্যা: সমাজের কী কী বিষয় এই স্বাধীনতার পথে হুমকি বলে মনে করেন?
শামস আফরোজ চৌধুরী:একদল মানুষ আছে এই সমাজে। যাদের আমার সবচেয়ে বড় হুমকি বলে মনে হয় নারীদের স্বাধীনতার পথে। এরা বসে থাকে দেখার জন্য মেয়েটা দেখতে কেমন, গায়ের রঙ কী, বিয়ে হলো কি না, বাচ্চা হলো কি না, স্বামীর ঘর টিকল কি না, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই দলের লোকগুলোর জন্য নারীরা আর মানুষের মতো করে বাঁচতে পারে না, তাদের অধিকার আদায় করা তো দূরের কথা। এই মানুষগুলো মেয়েদের জীবনকে অভিশাপ্ত করে তোলে। মানসিকভাবে মেয়েদের ভেঙে দেয়। এমনকি এদের যন্ত্রণায় একটা মেয়ে নিজের মতো করে নিঃশ্বাস পর্যন্ত নিতে পারে না। তাই প্রথমত এই দলের মানুষগুলোকে জীবন থেকে মাইনাস করতে হবে। হোক সে যত কাছের, যতই আপন। এদের বাদ দিয়ে চলতে পারলেই একটা মেয়ের জীবনের অর্ধেক সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।
অনন্যা: কিভাবে এই সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণের মধ্য দিয়ে সমাজে নারীদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা আনা সম্ভব বলে মনে করেন?
শামস আফরোজ চৌধুরী: প্রত্যেক নারীর মধ্যে নিজে কিছু করার ইচ্ছা শক্তি থাকতে হবে। বাবার টাকা, ভাইয়ের টাকা, স্বামীর টাকায় জীবন পার করার মানসিকতা থেকে সরে আসতে হবে। নিজের বল সবচেয়ে বড় বল এটা বুঝতে হবে আমাদের। আমরা যেদিন নারীদের সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখা শুরু করবো সেদিন থেকেই আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন আসবে। পরিবর্তন আসবে আমাদের নারীদের জীবনেও।
অনন্যা:সমাজের কী কী বিষয় এই স্বাধীনতার পথে হুমকি বলে মনে করেন?
শামস আফরোজ চৌধুরী:একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই , আমাদের সমাজে কিন্তু এমন একদলকেও দেখা যায়, যারা কোনোভাবেই নারীদের সম্মান দেখাতে চায় না। নারী মানে দুর্বল, নারী মানে অপারগ, এই ধরনের মানসিকতা পোষণ করে। এদের ঘরের নারীদেরও তারা পঙ্গু করে রেখে দেয়।
অনন্যা: এই সমস্যা মুক্তির পথ কী?
শামস আফরোজ চৌধুরী: আমি সকল অবহেলিত নারীকে বলবো, নিজের ইচ্ছা শক্তি দিয়েই নিজেকে তৈরি করতে হবে। আর আপনি যখন মা হবেন এবং আপনার ঘরে যখন কোনো কন্যা সন্তান জন্ম নেবে, তখন তার শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার নিয়ে ঠিক সেভাবেই সচেতন থাকবেন, যেভাবে আপনি আপনার ছেলে সন্তানের লেখাপড়া ও ক্যারিয়ার নিয়ে থাকবেন। এখানে কোনো প্রকার পার্থক্য করা যাবে না।