শিখণ্ডী: মহাভারতের দৃঢ়চেতা নারী
মহাভারতের এক অনবদ্য, অপরিসীম মনোবলের অধিকারী, দৃঢ়চেতা নারীর নাম শিখণ্ডী। যার পূর্বজন্মের নাম চিল ‘অম্বা’। তিনি ছিলেন কাশীরাজের জ্যেষ্ঠ কন্যা। সত্যবতীর গর্ভে ও শান্তনুর ঔরসে জন্মগ্রহণ করে চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য। অবিবাহিত যুবক চিত্রাঙ্গদ গন্ধর্বরাজ চিত্রাঙ্গদের হাতে নিহত হয়। কারণ তাদের দুজনার নাম এক হওয়ায় গন্ধর্বরাজ তাকে যুদ্ধে আহ্বান করেন। এরপর বিচিত্রবীর্য যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হলে ভীষ্ম তার বৈমাত্রেয় ভ্রাতার জন্য কাশীরাজের তিন কন্যা অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকাকে হরণ করে আনেন।
কিন্তু কাশীরাজের জ্যেষ্ঠ কন্যা অম্বা আগেই রাজা শাল্বকে মনে মনে পতিরূপে বরণ করে নেয়। কিন্তু ভীষ্ম তাকে তুলে আনায় শাল্ব রাজ আর গ্রহণ করতে রাজি হননি। সত্যের জয় নিশ্চিত জেনে শাল্বরাজের প্রাসাদ ত্যাগ করে অম্বা। এরপর ফিরে এসে ভীষ্মের পাণিপ্রার্থী হয়। তবে পূর্ব প্রতিজ্ঞার কারণে ভীষ্ম অম্বাকে গ্রহণ করেন না। কারণ ভীষ্ম আজীবন ব্রহ্মচর্য গ্রহণের পাশাপাশি অমরত্ব লাভ করেছেন। কিন্তু অম্বা তার একাগ্রতা বজায় রাখতে উপস্থিত হয় ভীষ্মের গুরু পরশুরামের দরবারে। প্রতিজ্ঞাবলে গুরুর আদেশেও অসম্মত হয় ভীষ্ম। পরশুরাম ও ভীষ্মের যুদ্ধ শুরু হয় কিন্তু কেউই জয়লাভ করে না। তখন পরশুরাম অম্বাকেই ভীষ্মের শরণাপন্ন হতে বলেন। কিন্তু অম্বার প্রতিশোধ স্পৃহা এত বেশি যে, যেকোনো মূল্যে ভীষ্মের প্রাণনাশ করতে স্থির করেন। কারণ ভীষ্মের কারণেই তার ভালোবাসা-প্রেমিক পুরুষ শাল্বকে হারাতে হয়েছে। আবার ভীষ্মও তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
অন্যদের মতো ভাগ্যের দোহায় না দিয়ে আসল অপরাধী ভীষ্ম, সেটা অম্বা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করায়, তাকে শাস্তি দিতে চায়। কিন্তু পরশুরাম বা ভীষ্ম কেউই তার মনোবাসনা স্বীকার করেন না। ফলে অম্বা তপস্যারত হয় এবং তীর্থস্থানে ভ্রমণ করতে করতে গঙ্গার সামনে উপস্থিত হয়। গঙ্গা অম্বার মূর্খতার জন্য তিরস্কার করে এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা থেকে বিরত হতে বলে। কিন্তু অম্বার একাগ্রতা ও প্রতিশোধস্পৃহা থেকে নিবৃত্ত করা সহজ ছিল না। তাই নিজের সর্বস্ব বিলীন করে হলেও অপমান-অপদস্তের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে। একদিকে অম্বা ভালোবাসাকে হারিয়েছে, অন্যদিকে নারী হিসেবে অম্বার মতকে অবমূল্যায়ন করা হয়ে। একজন নারীর নারীত্বকেই যে স্বীকার করেনি তাকে শাস্তি দিয়ে অম্বা নিজের আত্মমূল্যায়ন করেছে। প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী তপস্যারত থেকে মহাদেবকে তুষ্ট করে অম্বা। ভীষ্ম হত্যাই অম্বার একমাত্র কামনা মহাদেবকে জানাতেই সামান্য নারী একাজ করতে পারে না বলে তিনি জানান। কিন্তু অম্বা দমে যাওয়ার পাত্রী নন। দীর্ঘ পথ নিজের একটি চাওয়া পূর্ণ করতেই পাড়ি দিয়েছেন। তাই ভীষ্মের মৃত্যুই তার কাম্য।
মহাদেব উত্তরে বলেন, অম্বার নবজন্ম হবে এবং কিছুদিন পর পুরুষরূপ প্রাপ্ত হবে। এখানে অম্বা নারী হিসেবে তার প্রতিকার পায়নি! কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন অম্বাকে একাগ্র করেছেন কিন্তু নারী পরিচয়ে ন্যায় পাইয়ে দেননি। বরং তাকে পুরুষ হয়েই তার প্রপ্যটা পেতে হয়েছে। কিন্তু অম্বার জীবন ভাগ্যবিড়ম্বিত। সে না পেয়েছে ভালোবাসার মানুষকে না পেলো জীবন। বরং ভালোবাসা না পাওয়াকে কেন্দ্র করে তাকে নবজন্ম নিতে হয়েছে! এখানে নারীর হতভাগ্য জীবনের চিত্রই প্রতিবিম্বিত হয়েছে। সমাজ-সংসারে নারীর প্রতি চিরন্তন অবহেলা-অবদমন কখনোই কম ছিল না! ভীষ্ম এখানে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধি। যদিও দৈববল প্রাপ্ত কিন্তু নারীর কাছে পুরুষ সবসময়ই দৈবজ্ঞান করা হয়। কারণ সমাজে তাদের শক্তি সামর্থ্য কম নয়। দৈববল এখানে অনেকটা রূপকার্থে ব্যবহার করা যায়। অম্বার আগুনে আত্মহুতি যেমন একদিকে ন্যায় পাওয়ার অদম্য বাসনা, অন্যদিকে নারীকে অবমূল্যায়নের চরমতম লজ্জা, ঘৃণা নিয়ে সমাজের পৃষ্ঠপ্রদর্শনও। অম্বা তাই মহাভারতের ভাগ্যবিড়ম্বিত চরিত্র হলেও আবহমান নারীর চিরচেনা রূপ।
যমুনা তীরে চিতা প্রজ্বলিত করে অগ্নির মধ্যে মিলিয়ে যায় অম্বা। এই সময় দ্রুপদ রাজের কোনো সন্তান না হওয়ায় তিনি মহাদেবের তপস্যারত হন। তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মহাদেব বর দেন। বরের আর্শীবাদে দ্রুপদের ঘরে অম্বা নবজন্ম নেয়। মহাদেবের আশীর্বাদে পুত্রী লাভ করলেও পুত্ররূপেই তাকে স্বীকার করে। এই কন্যার নাম হয় শিখণ্ডী। মহাদেবের বরে শিখণ্ডী পুরুষ হবে ভেবে দ্রুপদের স্ত্রী দর্শাণরাজ হিরণ্যবর্মার সঙ্গে শিখণ্ডীর বিয়ে দেয়। কিন্তু কিছুদিন পর হিরণ্যবর্মা শিখণ্ডীর কাছ থেকে সব জ্ঞাত হলে দ্রুপদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পিতামাতার দুঃখের কারণ হয়ে শিখণ্ডী বনে গিয়ে বাস করতে শুরু করে। এই অরণ্যে কুবেরের অনুচর স্থূণাকর্ণ নামে এক যজ্ঞ বাস করত। নিজের পুরুষত্ব শিখণ্ডীকে দান করে নিজে নারীর রূপ গ্রহণ করে স্থূণাকর্ণ। সে শিখণ্ডীকে বলে হিরণ্যবর্মার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষ হলে তার পুরুষত্ব তাকে ফিরিয়ে দিতে কিন্তু কুবের স্থূণাকর্ণের এমন দশা দেখে শাপ দেয়। ফলে শিখণ্ডী পুরুষ হয়েই জীবন পরিচালনা করতে থাকে। এরপর দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রশিক্ষা, ধনুর্বেদ বিদ্যা ও রথীশ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠে।
অম্বার শিখণ্ডী রূপ এবং তার দৃঢ় প্রত্যয় মহাভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চরিত্রে রূপ দিয়েছে। অম্বার মতো এতটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ চরিত্র মহাভারতে নেই। অম্বাকে যদি দ্রৌপদীর স্থানে বসানো যায়, তবে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ ও পুত্রহারিয়ে আরও দৃঢ় এবং প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু দ্রৌপদী নিজে মহাভারতের যুদ্ধে যুক্ত নাহয়ে পঞ্চপাণ্ডবকে আগ্রহী করেছে। এক্ষেত্রে দ্রৌপদী শিখণ্ডীর অনুজা হলেও দুবোনের মধ্যে বিস্তর ফারাক! শিখণ্ডী নিজ প্রতিজ্ঞাবলে একের পর এক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে জীবন পার করে। এমনকি অম্বা থাকা অবস্থায় প্রতিশোধ স্পৃহা প্রবল থেকে প্রবলতর হওয়ায় আত্মহুতি দিয়েছে।
ভারতীয় সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী চরিত্র হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় অম্বাকে। সেইসঙ্গে তার মনোবল প্রশংসার দাবিদার। শেষমেশ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধরত অবস্থায় নয়টি তীক্ষ্ণ বাণ দিয়ে ভীষ্মের বক্ষ বিদ্ধ করে শিখণ্ডী। মহাভারতের যুদ্ধে পাণ্ডবদের জয়ের অন্যতম শক্তি হয়ে ওঠে শিখণ্ডী। যদি ভীষ্মের মৃত্যু নিশ্চিত করা না যেতো, তাহলে কোনোভাবেই পাণ্ডবরা যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারতো না।
একদিকে ভীষ্মের অপরিসীম পরাক্রম শক্তি, অন্যদিকে ইচ্ছেমৃত্যুর বর। কিন্তু শিখণ্ডীর অবদানে সবই পাণ্ডবদের পক্ষে এসেছে। এক্ষেত্রে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন অত্যন্ত সচেতনার সঙ্গে শিখণ্ডী চরিত্রটি নির্মাণ করেছেন। কোথাও কোনো খুঁত রাখতে চাননি। এমনকি যুদ্ধের শর্ত অনুযায়ী পুরুষই কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে থাকতে পারবে। সেক্ষেত্রেও কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব মেধার পরিচয় দিয়েছেন। কৌশলে শিখণ্ডীকে পুরুষরূপে দাঁড় করিয়েছেন। মহাভারতের অন্যান্য চরিত্রের প্রতি লেখকের যতটা উদাসীনতা, শিখণ্ডী চরিত্র নির্মাণে ঠিক ততটাই সতর্ক পা ফেলেছেন। পুরো মহাভারতটাকেই যেন এক অম্বা-শিখণ্ডীর পরিচালনার ফল! কিন্তু শিখণ্ডী পরিচলার ভার নিলেও নিজে থেকেছে রিক্ত, শূন্য! শেষমেশ অশ্বত্থামার খড়গাঘাতে শিখণ্ডীর মৃত্যু! দৃঢ়চেতা, বলিষ্ঠ, একাগ্র হয়েও শিখণ্ডী শুধু দিয়ে গেছে। নিজের প্রতিশোধের সামান্য আত্মতৃপ্তি ছাড়া ভাগ্যে কিছুই জোটেনি তার!
অনন্যা/এসএএস