‘খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার এই তোমাদের পৃথিবী?’
মাশা আমিনি। মাত্র ২২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করে এই তরুণী। কারণ সে হিজাব সঠিকভাবে পরেনি, ফলে তার কেশের অংশবিশেষ দেখা যাচ্ছিল, যা ইরানে নীতিবহির্ভূত। ইরানে ছোট থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত সব নারীকে পর্দাপ্রদা বাধ্যকতামূলকভাবে মানতে হয়, সমস্ত শরীর ঢোলা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়। তবে ২০১৮ সালে আমরা নারীদের একটি দলের সঙ্গে যখন ইরানের ইস্পাহান শহরে গিয়েছিলাম, তখন কিন্তু অসংখ্য আধুনিক ইরানি নারী দেখেছি, যারা মাথায় স্কার্ফ দিয়ে চুল ঢেকেছেন এবং ট্রাউজারের ওপর থেকে নিতম্বের নিচ পর্যন্ত জামা বা শার্ট পরেছেন। বিকেল থেকে রাত ৮টা-৯টা পর্যন্ত নারী-পুরুষরা পরিবার নিয়ে পার্কে অথবা পাবলিক প্লেসে কিংবা বাগানে ফরাস বিছিয়ে ক্যাসেট প্লেয়ার নিয়ে রাতের খাবার খাচ্ছেন পিকনিক স্টাইলে, গান শুনছেন, আনন্দ করছেন। ছেলেরা পরেছে শার্ট জিনস।
উচিত। ধর্ম যার যার, বেঁচে থাকার অধিকার সর্বজনীন। ইসলামে পোশাকের শালীনতা নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাইকে পালন করার কথা বলা হয়েছে। এটা খুবই ভালো বিষয়। কারণ, আমাদের তো সমাজে বাস করতে হয়। তবে কোনো আচার ও বিধি চাপিয়ে দিলে তা একপর্যায়ে শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে ওঠে। কেবল নারীকে কেন সব বাধানিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ করার প্রবণতা দেশে দেশে যুগে যুগে চলে এসেছে? আজকের বিশ্বে নারীকে জনসম্পদ বা হিউম্যান রিসোর্স হিসেবে দেখা হয়। একটি পরিবারে নারীর অনুপস্থিতি পরিবারটিকে অকার্যকর করতে পারে। নারী হচ্ছে প্রতিটি পরিবারের স্তম্ভ। তাই একে সম্পদ ও সম্ভাবনাই ভাবা বুদ্ধিমানের কাজ। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে উপলব্ধি করেন। আজ বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তার লৌহমানবী হয়ে ওঠা এবং গত দুই যুগের বেশি সময় বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা সেই নারীশক্তির কথাই বারবার স্মরণ করিয়ে কি দেয় না? তিনি কি আপাদমস্তক কাপড়ে আবৃত করে বহির্বিশ্বে নিজেকে নিয়ে যাচ্ছেন; এ বছর জাতিসংঘে যেটা উঠে এসেছে ‘নারী নেতৃত্বের জয় জয়কার’ হিসেবে?
সম্প্রতি ইসলামিক ঐতিহ্যের দেশ উজবেকিস্তানের বিভিন্ন শহরে বেড়িয়ে এলাম। ইসলামের ইতিহাসের নানা নিদর্শনের স্থান এই দেশটি। ইমাম আল বুখারির জন্মস্থান উজবেকিস্তানের ‘বুখারা’ শহরে, ৮১০ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি তার জীবনের শেষ দিনগুলো সমরকন্দে থেকেছেন। তিনি হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর সকল হাদিসের সর্বপ্রথম সংগ্রহকারী। তিনি প্রথমে ৭ হাজার ২৭৫টি হাদিস সংগ্রহ করেন। জীবনের ৪২টি বছর তিনি এই হাদিস সংগ্রহের কাজেই নিযুক্ত ছিলেন। বাগদাদ, দামেস্ক ও বসরা ভ্রমণ করেন তিনি হাদিস সংগ্রহের জন্য। ইমাম আল বুখারির লেখা সহিহ (Sahih) হাদিস হচ্ছে আল-কোরআনের পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় গ্রন্থ। ১৯৯৪ সালে ইমাম বুখারির ১২২৫ বছর উদযাপিত হয় উজবেকিস্তানে। আমরা বাহাউদ্দিন নকশবন্দের মসোলিয়ামেও (mausoleum) গিয়েছিলাম সমরকন্দ শহরে। বাহাউদ্দিন নকশবন্দ (১৩১৮-১৩৮৭) ছিলেন সুফিজম প্রচারের ক্ষেত্রে একজন আধ্যাত্মিক পির, জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব। তাকে ‘শাহ-ই-নকশবন্দি’ বলে জানে ইসলামি বিশ্বে। তার শিক্ষার মূলমন্ত্র ছিল ‘আল্লাহ তোমার হৃদয়ে এবং তোমার হাতে; কর্মের মাধ্যমে।’ তার একটি উদ্ধৃতি সেখানে লিখিত ছিল :Occupy your heart with Allah and your hands with work.
আমার কাছে এ কথার মানে হলো—কর্মই ধর্ম, ধর্মই কর্ম। ভালো কাজের মধ্যেই সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। আর একটি সুন্দর বচন আমার মনকে নাড়া দিয়েছে, যা সেখানে লেখা আছে, No one can be a Muslim until he governs his greed। ‘যতক্ষণ তুমি লোভ সংবরণ করতে পারবে না, ততক্ষণ তুমি একজন সঠিক মুসলিম অর্থাৎ মোমেন মুসলমান নও।’
ইদানীং ছাত্রছাত্রী আবাসগুলোতে যে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার, ভিআইপি কালচার, ধর্ম বা মানুষকে ভালোবাসা অপেক্ষা টাকার প্রতি ভালোবাসাটাই বড় হয়ে উঠেছে। আমরা যদি আমাদের লোভ সংবরণ করতে না পারি, এই যদি হয় বাস্তব অবস্থা—তাহলে আমরা সঠিক মুসলমান হতে পারব কী করে? আজ যখন পথেঘাটে ধর্মের নামে লেবাস ও নানা আয়োজন মানুষের চলনে বলনে দেখি, আর খবরের কাগজে সামান্য জমি নিয়ে খুন, বিভিন্ন দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থোপার্জনের খবর দেখি, তখন মনে হয়—সত্যি কি আমরা আল্লাহকে ভয় পাই? ভয় পেলে তো এত বাড়াবাড়ি, এত অনিয়ম-দুর্নীতি ও খারাপ কাজ আমাদের করারই কথা নয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিভৃতে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে—আসলেই আমরা প্রকৃত ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত মানুষ হতে পারছি? এই নিবন্ধটি লেখার সময় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা একটি পুরোনো গানের কলি কানে বাজছে :
‘খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার
এই তোমাদের পৃথিবী
এর বাইরে জগৎ আছে তোমরা মানো না
… তোমরা নিজেই জানো না।’
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক ও পাক্ষিক অনন্যা