সত্যিই কি আমরা দেশকে ভালোবাসি?
হঠাৎ করেই কয়েক দিনের জন্য ঘুরে এলাম মরিশাস। আফ্রিকা মহাদেশে অবস্থিত মরিশাস দ্বীপরাষ্ট্রটি অত্যন্ত ছোট। মাত্র ২ হাজার ৪০ বর্গকিলোমিটার। ঢাকার চেয়ে মাত্র সাত গুণ বড়। কিন্তু জনসংখ্যা মাত্র ১৩ লাখের কাছাকাছি। হিন্দি সিনেমার অনেক গানের দৃশ্যায়ন আগে প্রায়ই মরিশাসে তোলা হতো। সেই সূত্রে মরিশাসের অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য আমরা আগেই কমবেশি দেখেছি। ইন্টারনেটে সার্চ দিলে অবশ্য অসংখ্য অপূর্ব ছবি দেখা যায়। সেই মরিশাসে হঠাৎই আমার ঝোড়ো সফরের সুযোগ এলো! আমার পায়ের তলায় সরষে লেগেই থাকে। আমিও তাই ছুটলাম মরিশাসে।
এক নারী বন্ধুর কারণে এই দেশে যখন যাওয়ার পরিকল্পনা করছি, তখন বিমানের টিকিট কিনতে গিয়ে প্রথম ধাক্কা খেলাম। যাতায়াত খরচ শুনে আমার চক্ষু চড়কগাছ। বাংলাদেশ থেকে মরিশাসে সরাসরি যাওয়া যায় না। ট্রানজিট রুট ধরে যদি মুম্বাই হয়ে যাই, তাহলে ঢাকা-মুম্বাই বিমানভাড়া ৩০ হাজার টাকা। কিন্তু মুম্বাইতে এক রাত থেকে যেতে হবে অথবা ভোর ৩টায় মুম্বাই টু মরিশাস ১ লাখ টাকা বিমানভাড়া, সময় ছয় ঘণ্টা। মানে সর্বমোট ৯ ঘণ্টা, সেই সঙ্গে মুম্বাইতে ১০ ঘণ্টা লে-ওভার। অথবা ঢাকা-দুবাই এবং দুবাই-মরিশাস হয়েও যাওয়া যায়। ভাড়া আড়াই লাখের বেশি। এ পয়সায় আমেরিকায় ঘুরে আসা যায়। ব্যাপার কী? ভারত-মহাসাগরের একটি দ্বীপ; মনে হয় বাড়ির কাছে আরশিনগর, সে দেশের জনগণের চেহারাসুরত তো আমাদের পড়শিদের মতোনই। তাহলে? পৃথিবী গোল আর আমার মাথাও যেন গোল! তাই আমি গোলকধাঁধায় ধাঁধিয়ে গেলাম। ভূগোল ও এই গোলার্ধের নানা ধাঁধার উত্তর খুঁজতে লাগলাম। মানচিত্র আর গুগল দেখে বোঝার চেষ্টা করলাম। মরিশাসের ইতিহাস নিয়ে সামান্য কিছু নাড়াচাড়া করেই বুঝলাম দেশটি অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং।
যা-ই হোক, বেশ শারীরিক ধকল সয়েই পৌঁছলাম সেই দ্বীপে। বেশ কটি দ্বীপ এই মরিশাসের অন্তর্ভুক্ত। তারমধ্যে মরিশাস, রডরিগ্রস ও অ্যাগালেগা। এছাড়া ছোট ছোট আরো কিছু দ্বীপ আছে। মরিশাস দ্বীপপ্রধান। ছোট্ট আয়তনের দেশটির প্রায় ৫০ শতাংশ জনগণ হিন্দু, ১৭ শতাংশ মুসলমান ও খ্রিষ্টান ৩২ শতাংশ। এছাড়া বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মের লোক আছে। অনেক আফ্রিকার অধিবাসী এবং দক্ষিণ ভারতীয় এখানে এসেছে। কারণ এরা ফরাসি ও ব্রিটিশের উপনিবেশ ছিল। বর্তমানেও তাদের প্রতিপত্তি কিছুটা আছে। তবে অর্থনৈতিক বাজার ভারতীয়দের কাছেই বেশি। বিভিন্ন ভারতীয় কোম্পানির অফিস আছে এখানে। অর্থনীতি বেশ ভালো। জনগণ আমার কাছে গরিব মনে হলেও জনগণের খুব কমপ্লেন করার অভ্যাস নেই। ঔপনিবেশিক যুগে কয়েক শ বছর আগে আখের চাষি হিসেবে এরা সেদেশে শ্রম দিতে গিয়েছিল, অনেকটা দাসের মতো। এজন্য এদের চরিত্র খুবই নরম। পর্যটকব্যবসা এদের প্রধান আয়। ওয়াটার স্পোর্টস বা সমুদ্রের যত স্পোর্টস যেমন পানির তলের রহস্য স্কুবা ড্রাইভিং, স্মাকলিং, সমুদ্রে ঘুড়ি ওড়ানো ইত্যাদি এখানে দারুণ আকর্ষণীয়। ঘোড় দৌড় এবং কার রেসিংয়ের ব্যবস্হা খুব ভালো। খুব উন্নত মোটর ওয়ে তৈরি করেছে; এই ১৩ লাখ জনগণের সুবিধার্থে। ছোট রাজধানী। নাম পোর্ট লুইস। জনগণ বেশির ভাগ ফরাসি ও সামান্য ইংরেজি বলে। নিজস্ব ভাষা আছে, যাকে ‘ক্রিওল’ বলে।
ইক্ষু বা আখ ছাড়া আর কোনো ফসল ফলে না। একর একর খালি জমি পড়ে আছে। বাংলাদেশ থেকে ২/৩ কোটি শ্রমিক পাঠালে তারা মরিশাসকে সবজি ফলফলাদির স্বর্গ বানিয়ে ফেলত কয়েক বছরে। এ আমার ব্যক্তিগত ধারণা। বেশ কিছু আমাদের বাঙালি ভাইয়েরা সেখানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। রেল রোড তৈরি ও বিল্ডিং তৈরিতে তারা আছেন। মরিশাসের তরুণ শিক্ষিত কিছু ছেলেমেয়ের কথায় তাদের প্রশংসা শুনে ভালো লাগল। তারা বলল, বাংলাদেশিরা কঠোর পরিশ্রমী ও ভদ্র। ১৯৯৮ সালে করাচিতে এক শ্রীলঙ্কান নার্স এক বাংলাদেশিকে বিয়ে করে। সে আমার এক আত্মীয়ের বাসায় কাজ করত। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি বাঙালি ছেলে কেন পছন্দ করলে? তার উত্তর ছিল, বাঙালি বহুত আচ্ছা লাভার হোতা। সেই সত্যতা আজকাল ফেসবুকে প্রায় পাই। ইদানীং ফেসবুকের পরিচয়ে অনেক বিদেশি ভালোবাসার টানে বাংলাদেশে চলে আসছে। বিয়েশাদিও করছে। বাঙালি কখনই ক্রীতদাস হয় না। তবে সেবিকা বা ভালোবাসার দাস হতে বোধহয় দ্বিধা করে না। একেই আমরা অতিথিপরায়ণও বলতে পারি। যা-ই হোক, মরিশাস একটি অতি সুন্দর স্বর্গের কাছাকাছি নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর দেশ। সেটা ভারত মহাসাগরের সৌন্দর্য আর এর আবহাওয়া বিষুবীয় রেখার নিচে বলে অস্ট্রেলিয়ার মতো। ছয় মাস শীত, ছয় মাস গ্রীষ্ম। জানুয়ারি থেকে জুলাই শীত আর জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গরম। পূর্ব আফ্রিকা থেকে খুব কাছে। এখানে এসে পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোর হাজার বছরের শোষণের ইতিহাস উপলব্ধি করা যায়। সমুদ্রের অতলে যে প্রাচুর্য আছে, সেদিকে ভারত ও চীনের শ্যেন দৃষ্টির কাহিনী স্থানীয় তরুণের কিছু গল্পে উঠে এলো।
লেখাটা লেখার সময় আজ সকালে বাড়ির পাশের রাস্তা থেকে হট্টগোলের আওয়াজে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। কাজের ছেলেটাকে বললাম দেখে আসতে। সে কিছুক্ষণ পরে এসে জানাল, তার সারসংক্ষেপ হলো—একটি গাড়ি আইন ভঙ্গ করলে ট্রাফিক পুলিশ তাকে থামায়। সেই ড্রাইভার ও গাড়ি সংসদ সদস্যের—এই অজুহাতে পুলিশের সঙ্গে খারাপ আচরণ করায় পুলিশ তাকে ধাওয়া করতে করতে আবাহনী মাঠের কোনায় নিয়ে যায়; তখন জনগণও তাকে ধরে গাড়ি আটক করে।
যদিও ধানমন্ডি একটি অতি পুরোনো এবং তথাকথিত সম্ভ্রান্ত আবাসিক এলাকা। আমিই এই বাড়িতে অর্ধশত বছর ধরে আছি। এত ভিড়, আওয়াজ, রাস্তায় ময়লা আর নার্সারি ব্যবসায় সমগ্র ফুটপাত দখল, এমন আর কখনো ছিল না। শব্দদূষণের কথা বাদই দিলাম। কাগজে বলছে, পরিবেশদূষণে ঢাকাবাসীর পাঁচ-সাত বছর জীবনকাল কমে যাচ্ছে। শব্দদূষণে নার্ভের এবং শ্রবণক্ষমতা কতটা কমছে, তার হিসাব কি করে দেখেছে কেউ? জনগণই তো বাংলাদেশের সম্পদ। এসব দূষণ ও অব্যবস্হাপনা যে উপযুক্ত মানবসম্পদের ক্ষয় দ্রুত বাড়িয়ে দিচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
যারা মেয়র হয়, যারা এমপি হয়, তাদের কিছু কিছু সদস্য হঠাৎ ‘আমি কি হনু রে’ হয়ে ওঠে। সবাই ভাবে সাধারণ জনগণ না হয়ে জনগণের প্রতিনিধি হওয়া গেলে সবচেয়ে সহজে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা যায়। প্রথমে ওয়ার্ড কমিশনার, তারপর দলীয় পদ, তারপর এমপির চেলা ইত্যাদি ইত্যাদি। তোমার দেশের সেবায় সাত খুন মাপ।
অর্থ মন্ত্রণালয় প্রকাশিত অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলছে, রাষ্ট্রীয় ৩০ করপোরেশনের মধ্যে ২৪টির কাছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ ৩৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৪টি করপোরেশন ঋণখেলাপি। যারা আরো ডিটেইল জানতে চান, তারা অর্থনৈতিক সমীক্ষা দেখে নিন। এবার আসি আমাদের দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় উড়োজাহাজ সংস্থা বাংলাদেশ বিমানের ব্যাপারে। এক সময় এই সংস্থাটি আমার জন্য সবচেয়ে সাশ্রয়ী ও আরামদায়ক ছিল। ইদানীং এটা ব্যাবসায়িক ও অব্যবস্হাপনা, সেই সঙ্গে বিমানবন্দরের দায়িত্বে যে এভিয়েশন ডিপার্টমেন্ট আছে, তাদের সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমে যেসব রিপোর্ট আসছে, অতটুকু পড়লে এবং আমার ব্যক্তিগত বিদেশ সফরে যেসব অভিজ্ঞতা হয়, তার সারসংক্ষেপ করলে এটা দাঁড়ায় যে, দেশের মধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত কিছু কর্তাব্যক্তি তাদের লোভলালসা, ছলচাতুরির মাধ্যমে দেশটাকে অচলায়তনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একজন পাইলটের দোষে নতুন একটা ড্রিম লাইনার অকেজো হয়ে আছে। কিন্তু সেই পাইলট আজও স্বস্হানে আছে।
কিন্তু বিমানের ক্ষতি হয়েছে ১.৫ মিলিয়ন টাকা। এখন আবার ১৪টি পাইলট নিয়োগের দুর্নীতির খবর পত্রিকায় বেরিয়েছে। এদিকে যে ব্যক্তি চিফ অব ট্রেইনিং বিমানের, তিনি তার পাইলট স্ত্রী সিলেট-ঢাকা ড্রাশ-৮ প্লেনের যান্ত্রিক ক্ষতিসাধন করেন স্ট্যান্ডার্ড অপারেশন ভায়োলেশনের জন্য, তবু তার কোনো শাস্তির ব্যবস্হা করা হয়নি। তার চাকরি বিমানেই সংরক্ষিত আছে। কারণ ট্রেইনিং অফিসার তার স্বামী। যদিও বিমান মন্ত্রণালয় এসব বিষয় এখন অনুসন্ধান করছে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমগুলো সজাগ থেকে জানিয়ে দিচ্ছে, নিজ নিজ ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কতিপয় ব্যক্তিরাই দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিরাট বিরাট ক্ষতির দায়ভার বহন করছেন। ইতিপূর্বে খবরে প্রকাশ পেয়েছে যে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের অ্যাকাউন্টস বিভাগের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ট্রাভেল এজেন্টদের সঙ্গে টিকিট বিক্রির দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন বলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তদন্তে জানা গেছে। জড়িত ছিলেন অ্যাকাউন্টস বিভাগের দ্বিতীয় শীর্ষ কর্মকর্তাও।
কিন্তু খবরে জানা যায়, বিমানের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক দায়িত্ব পাওয়া মাত্রই স্রেফ ভর্ত্সনা জানিয়ে সব কর্মকর্তাকে দায়িত্বে পুনর্বহাল করেন। বিমানের পারফরম্যান্সে এর ফলটাও তাত্ক্ষণিকভাবেই দেখা যায়। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা অনলাইনে টিকিট বিক্রি বন্ধ করে দিয়ে অফলাইনে টিকিট বেচার পুরোনো নিয়ম ফিরিয়ে আনে। এর ফলে যাত্রী পরিবহনের হার ভালো হওয়া সত্ত্বেও এপ্রিল মাসে বিমানের আয় ২০০ কোটি টাকা হ্রাস পায়। হঠাৎ আয় নেমে যাওয়ায় বিমান নিজেই আরেকটি তদন্ত শুরু করে। জানা যায়, ২০১৯ সালের তদন্তে মার্কেটিং ও সেলস বিভাগের মহাব্যবস্থাপককে টিকিট নিয়ে দুর্নীতির প্রধান দোষী হিসেবে সাব্যস্ত করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ায় তাকে বিমান থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কিন্তু বিমানের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসে ২০২১ সালের মার্চে দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তাকে দায়িত্বে পুনর্বহাল করেন।
বিমান বাংলাদেশ যদি ঠিকমতো পরিচালিত না হয়, যথাযথ সার্ভিস দিতে না পারে, তাহলে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো এ দেশে তাদের ব্যবসা আরো প্রসারিত করবে। তার দৃষ্টান্ত আমরা এখনই দেখতে পাচ্ছি। আমাদের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও, দারুণ অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও কতিপয় অসৎ দুর্নীতিবাজ দেশপ্রেমহীন কর্মকর্তার কারণে বিমান যদি পিছিয়ে থাকে, তবে সেটা আমাদের দেশের জন্য নিদারুণ আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির কারণ হবে।
কথা হলো, একজন শেখ হাসিনা আর কত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবেন—যদি ১৮ কোটি বাঙালি তার পাশে না থাকতে চায়! দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “কবিগুরু তোমার কবিতা আজ মিথ্যা হয়েছে। ‘সাত কোটি সন্তানের, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করনি’—আজ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে, বাঙালি আজ স্বাধীন হয়েছে।” কিন্তু হায় বঙ্গবন্ধু! সেজন্যই কি তুমি নিজ দেশের প্রিয় বাঙালিদের দ্বারা জীবন বিসর্জন দিলে? বাঙালি কি সত্যিই মানুষ হয়েছে? সত্যিই কি আমরা বাঙালিরা নিজের দেশকে ভালোবাসি?
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক ও পাক্ষিক অনন্যা