বাবার চিঠি

বাবা, আজ তোমাকে খুব বেশি মনে পড়ছে। বিশেষ করে তোমার লেখা সেই চিঠির কথা। মাত্র পাঁচটি বাক্য আমাকে জীবনের দিকনির্দেশনা দিয়েছিলে। ভুলিনি আজও একটি শব্দও। সেকি ভোলা যায়?
বাবা ছিলেন একটি বেসরকারি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার আমাদের। সার্বক্ষণিক আত্মমর্যাদা নিয়ে চলতে হয়। আমার দেখা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবাদের একজন আমার বাবা। সৎ, আদর্শবান, নীতিবান মানুষদের অন্যতম উদাহরণ ছিলেন তিনি। জীবনে কখনো ভুল করেও মিথ্যা বলতে শুনিনি। আপস করেনি কোনো অন্যায়ের সঙ্গে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ তাকে বিশ্বস্ততার প্রতীক হিসাবে জানতেন।
সেই বাবার বাউণ্ডুলে ছেলে আমি। পাঁচ ভাই বোনের তৃতীয়। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আর নেশার জগতে ছিলাম আমি। লেখাপড়ায় যতটা ছিলাম, তাতে এইসব অন্যায় মোটামুটি ব্যালেন্স হয়ে যেতো।
আজও মনে পড়ে আমাকে লেখা বাবার শেষ চিঠির কথা। সময়টা ছিল ১৯৯৪ সাল। জানুয়ারি মাসের ৭ তারিখ। আমি বরিশাল শহরের নিউ কলেজ রো একটি মেসে থাকতাম। মোট ২৮ জন ছাত্র ছিলাম মেসে। তখন বিএম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের হিসাব বিজ্ঞানে অনার্স পড়ি। আগেই বলেছি, আমার অভ্যাসের কথা। সেই সূত্রেই যথারীতি আমার রুমে বসছে তাস খেলার মহাআসর। খেলোয়াড় চার জন আর পাশে আট থেকে দশজন। প্রায় সবার মুখেই সিগারেট, পাশে দিব্যা ভারতীর বিশাল ছবি, সাউন্ডবক্সে উচ্চস্বরে হিন্দি গানের ঝংকার। ছোট্ট একটি রুমে এসবের ফলে কী অবস্থা হয়, বলাবাহুল্য। বিপত্তিটা হলো ঠিক তখনই। বিকেল ৪টা হবে হয়তো। ভেজানো দরজা দিয়ে আমার বাবা উঁকি দিলেন। পরিস্থিতি দেখে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন। সবাই যে যার মতো অবনত মস্তকে দ্রুত বেরিয়ে গেলো। দ্রুত এলোমেলো রুমটা যথাসাধ্য গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সিগারেটের ধোঁয়ায় রুম তখনো অন্ধকার।
বাবা প্রবেশ করলেন সাবলীলভাবে। আমি বিচলিত। কিংকর্তব্যবিমুঢ় অসহায় এক আসামি হয়ে নিশ্চুপ ছিলাম। বুঝতেই পারেন তখন আমার অবস্থা। তিনি কথা শুরু করলেন এমনভাবে যেন কিছুই হয়নি। মনে হচ্ছে কিছুই দেখেননি। বললেন, ‘এক মাসের ট্রেনিং আছে তাই ঢাকা যাচ্ছি। ভাবলাম তোকে একটু দেখে যাই। চল লঞ্চ ঘাটে যাই’। লঞ্চে উঠিয়ে দিলাম। যতক্ষণ সঙ্গে ছিলাম বারবার খুঁজে চলেছি কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া পরিস্থিতির ছাপ। রিকশায় বসে স্বাভাবিক কথাবার্তা। আশ্চর্য! তার চোখে-মুখে ঘটনার বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া দেখতে পাইনি। আমার ভয়টা কিন্তু এখানেই। বাবা বরাবরই চাপা স্বভাবের ছিলেন। হজম করে নিতেন সহস্র কষ্ট।
রুমে এসে আমার কৃতকর্ম আর বাবার আচরণ নিয়ে অনেক ভাবলাম। মিলছে না কিছুতেই। রেজাল্ট পেলাম ১১ জানুয়ারি ১৯৯৪, বেলা তখন ১২টা। ডাকপিয়ন একটি চিঠি দিয়ে গেলো। খাম হাতে নিতেই দেখলাম বাবার লেখা। আমি ভয়ে চিঠি খুললাম। দেখলাম পাঁচ লাইনের একটি ছোট্ট চিরকুট। একটা ডিকশনারি। কেন ডিকশনারি বললাম? ওই পাঁচটি বাক্য পড়তে আমার আধাঘণ্টার বেশি সময় লেগেছিলো সেদিন। প্রতিটি বাক্য বিশ্লেষণ করলে দশ পৃষ্ঠা লেখা সম্ভব।
সেই চিঠির একটি বাক্য হলো,
‘বাবা , আমরা চোখে যা দেখি, পুস্তকে যা শিখি, তার থেকেও বাস্তবতা অনেক পিচ্ছিল , যা-কিছু করো লক্ষ্য থেকে সরে যেও না।’
এটাই ছিল বাবার শাসন। বাবার আদেশ, উপদেশ, পরামর্শও। আজও গর্ব করে বাবার পরিচয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।
বাবা তোমার লেখা চিঠিটা আজও আমাকে শিক্ষা দেয়। চিঠিটা আর খুঁজে পাই না। তোমার দেওয়া শিক্ষাই প্রতিমুহূর্তে লালন করি অন্তরে। আজ ভাবতেও পারি না, তুমি নেই। আমার মানিব্যাগে প্রায় বিশ বছরেরও বেশি সময় তোমার ছবি রাখা আছে। মা! তিনিও চলে গেছেন ৩১ জানুয়ারি ২০২১। শূন্যে ভেসে বেড়াই আমি । মহান আল্লাহ তোমাদের জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন। আমিন।
পৃথিবীর প্রত্যেক বাবার প্রতি রইলো আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
অনন্যা/জেএজে