কর্মব্যস্ততাই যেন ঈদের আনন্দ

ভোরের আকাশে রোদ ফুটে ওঠার আগেই মসজিদের মিনারে ভেসে আসে তাকবিরের সুর। শান্ত ভোরে এক পবিত্র উৎসবের আহ্বান জানান দেয় সে ধ্বনি। ঈদুল আজহা ত্যাগের মহান শিক্ষা নিয়ে আসে। নতুন জামা, কোরবানির গরুর গলা জুড়ে ঘণ্টার ঝংকার, আর গৃহস্থালির ব্যস্ততা সব মিলিয়ে ঈদের সকাল যেন জীবনের এক ভিন্ন আবেগে মোড়ানো মুহূর্ত।

কোরবানির ঈদ মানেই শুধু কোরবানির তা নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে পরিবারের প্রতি দায়িত্ব, সমাজের প্রতি সচেতনতা, আর নিজের প্রতি যত্ন। আর এই বিশাল কর্মযজ্ঞের বড় একটা অংশই সামলে থাকেন নারীরা। ঈদের দিনটা যেন একাধারে রান্নাঘর, ড্রয়িং রুম, বারান্দা আর ফ্রিজের মাঝখানে দৌড়ানোর দিন। তবুও ঈদের আনন্দে একটুও ভাটা পড়ে না। বরং ব্যস্ততাই যেন উৎসবের রঙটা আরও উজ্জ্বল করে তোলে।
ঘরবাড়ি পরিষ্কার ও সাজানো
ঈদের আগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো বাড়ি-ঘর পরিষ্কার ও গোছানো। বসার ঘর, শোয়ার ঘর, রান্নাঘর সবকিছুতেই নজর দিতে হয়। পর্দা, কুশন কভার, বিছানার চাদর ধুয়ে ফেলা, মেঝে মুছে ফেলা, আসবাবপত্র ঝেড়ে গুছিয়ে নেওয়া হয়। ঈদের সকালে মেহমান এলে যেন ঘরের পরিবেশ স্নিগ্ধ ও পরিপাটি দেখায়, সেটাই মূল লক্ষ্য।
রান্নাঘর গুছিয়ে প্রস্তুতি নেওয়া
কোরবানির ঈদে সবচেয়ে ব্যস্ত সময় কাটে রান্নাঘরে। তাই আগে থেকেই সবকিছু প্রস্তুত রাখলে ঈদের দিন চাপ অনেক কমে যায়। প্রয়োজনীয় মসলা বেটে বা গুঁড়া করে রাখা, হাঁড়ি-পাতিল ধোয়া, ছুরি-বঁটি ধার দিয়ে প্রস্তুত রাখা, রান্নার জন্য বড় পাত্র, ডেকচি, চুলার ব্যবস্থা ইত্যাদি আগেই গুছিয়ে রাখতে হয়।

কোরবানির পশুর যত্ন ও প্রস্তুতি
ঈদের আগেই কোরবানির পশুর জন্য জায়গা নির্দিষ্ট করা, সেই জায়গা পরিষ্কার রাখা, খাবার ও পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা, পশুকে রোদ বা বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করা। সব মিলিয়ে অনেক যত্ন নিতে হয়। পশুর স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও এই সময়কার অন্যতম দায়িত্ব।
ঈদের সকালে নামাজ ও কোরবানির প্রস্তুতি
ঈদের দিন সকালটা শুরু হয় ঈদের নামাজ দিয়ে। নামাজ শেষে শুরু হয় কোরবানির প্রস্তুতি। জবাই, চামড়া ছাড়ানো, মাংস কাটার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আগেই গুছিয়ে নিতে হয়। একসাথে কাজের ধরণ থাকে, তাই বাড়ির সবাইকে একত্রে অংশ নিতে হয় এই পবিত্র কাজটিতে।
কোরবানির মাংস ভাগ ও বিতরণ
কোরবানির অন্যতম শিক্ষা হলো ভাগাভাগি। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও গরিব-দুঃখীদের মধ্যে কোরবানির মাংস বণ্টন করা একটি ধর্মীয় ও মানবিক দায়িত্ব। এজন্য মাংস পরিমাণমতো কেটে সঠিকভাবে পলিব্যাগে ভরে আলাদা করে রাখতে হয় এবং ঠিক সময়ে বিতরণ করতে হয়।
পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা
কোরবানির পর জায়গায় রক্ত, চামড়া, হাড় ও অন্যান্য বর্জ্য জমে যেতে পারে। এতে দুর্গন্ধ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়। তাই প্রয়োজন হয় দ্রুত এবং সঠিকভাবে বর্জ্য পরিষ্কার করে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা। এ কাজে ডিটারজেন্ট, ব্লিচিং পাউডার, চুন ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।
ফ্রিজে মাংস সংরক্ষণ
সব মাংস একদিনে রান্না করা সম্ভব নয়, তাই মাংস সংরক্ষণ খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এজন্য ফ্রিজ ও ডিপ ফ্রিজ পরিষ্কার করে খালি করে রাখা হয়। মাংস পরিষ্কার করে আলাদা ব্যাগে বা পাত্রে ভাগ করে ফ্রিজে রাখা হয় যেন সহজে ব্যবহার করা যায় এবং নষ্ট না হয়।
নিজেকে ও পরিবারকে পরিপাটি রাখা
সব কাজের মধ্যেও নিজের যত্ন নেওয়া জরুরি। ঈদের দিন পরিপাটি হয়ে থাকতে মন ভালো রাখে। নতুন জামা না থাকলেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরা, চুল গুছিয়ে নেওয়া, হাতে মেহেদি পরা, হালকা সাজগোজ। সবই উৎসবের আমেজ বাড়িয়ে তোলে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও প্রস্তুতির দিকে খেয়াল রাখা দরকার, এতে পুরো পরিবেশটাই আনন্দময় হয়ে ওঠে।
সতর্কতা
ঈদের দিন সকালে পশু জবাইয়ের সময় আশপাশে বাচ্চাদের নিরাপদে রাখুন। বর্জ্য নিষ্পত্তির জন্য স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশ মেনে চলুন। মাংস বণ্টনের জন্য আলাদা পাত্র ও ব্যাগ তৈরি করে রাখুন। গরিব, প্রতিবেশী, আত্মীয় সবাইকে মাংস দিতে ভুলবেন না। এখানেই ঈদের মানবিক দিক।
ব্যস্ততা থাকবেই কিন্তু তাতে ঈদের আনন্দ ম্লান হয় না। বরং এই ব্যস্ততা এই ঘরের সবার জন্য কিছু করার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে ঈদের আসল সৌন্দর্য। তাই, যত কাজই থাকুক, একটু থেমে, একটু হাঁফ ছেড়ে, একটা কাপ চা হাতে ঈদের গন্ধটা যেন ঠিকঠাকভাবে টেনে নিতে ভুলবেন না।