Skip to content

পায়ুপথে বাতাস দিয়ে হত্যা কি খুনের নতুন কৌশল?

পায়ুপথে বাতাস দিয়ে হত্যা কি খুনের নতুন কৌশল?

মাত্র চার বছর বয়স। হাসতে হাসতে গ্যারেজে ঢুকেছিল ছোট্ট আবুবক্কর। কিন্তু কিছু মানুষের ঘৃণ্য কার্যকলাপ তার জীবনটাই কেড়ে নিল। একবার ভাবুন—একটি নিষ্পাপ শিশুকে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করা হলো! কীভাবে আমরা এতটা অমানবিক হতে পারি?

২০২৫ সালের ১৫ এপ্রিল, মিরপুর ১১ নম্বরের বাউনিয়াবাদ এলাকার একটি মোটর গ্যারেজে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। শিশুটি তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে গ্যারেজে গিয়েছিল। সেখানে বড় ভাইকে দোকানে পাঠিয়ে অভিযুক্তরা মাত্র চার বছর বয়সী শিশুটির পায়ুপথে মোটরসাইকেল পরিষ্কারের পাইপ দিয়ে বাতাস ঢুকিয়ে দেয়। ফলে শিশুটি অচেতন হয়ে পড়ে এবং হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।

শিশুটির মা আয়শা বেগম পল্লবী থানায় চারজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। আসামিদের মধ্যে রাজু (২০), মো. সুজন খান (৩৬), এক কিশোর এবং একজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি রয়েছেন। পুলিশ একজন কিশোরকে গ্রেপ্তার করেছে, তবে বাকি তিনজন এখনও পলাতক।

এ ধরনের বর্বরতা বাংলাদেশে নতুন নয়। ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জে একটি কারখানায় ১০ বছর বয়সী শিশু শ্রমিক সাগর বর্মণকে সহকর্মীরা পায়ুপথে কমপ্রেসড এয়ার ঢুকিয়ে হত্যা করে। এই ঘটনায় দুইজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমন কিছু ঘটনার খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে, যেখানে শিশুদের পায়ুপথে কমপ্রেসড এয়ার ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে- ‘মজা’র নামে, ‘শাস্তি’র নামে বা নিছক ক্ষমতা দেখানোর বিকৃত মানসিকতায়।

এই ঘটনার ভয়াবহতা শুধু তাৎক্ষণিক মৃত্যুতে শেষ হয় না, বরং প্রশ্ন তোলে-আমাদের সমাজ কি এতটাই অনুভূতিশূন্য হয়ে গেছে? আমরা কি এখনও বুঝে উঠতে পারিনি, একটি শিশুর শরীরে এই নিষ্ঠুর কাজ কতটা ভয়ানক হতে পারে? কারো শরীরে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে দেওয়া কতটা ভয়াবহ হতে পারে? পায়ুপথে বাতাস দেয়ার কোনো নৈতিক, বৈজ্ঞানিক, চিকিৎসাগত বা যৌক্তিক কারণ নেই- বিশেষ করে যেটা শিশু বা সাধারণ মানুষের উপর প্রয়োগ করা হয়। এটা সম্পূর্ণরূপে অনৈতিক, বিপজ্জনক এবং কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।

১। অনেক ক্ষেত্রেই এমন বর্বর কাজ করা হয় “মজা” করার নামে। যারা করে, তারা হয়তো বুঝতেই পারে না এর পরিণতি কত ভয়ংকর হতে পারে। এটা একধরনের বিকৃত মানসিকতার প্রতিফলন। কিছু বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তি এটিকে একধরনের কৌতুক হিসেবে দেখে, শিশুরা কষ্ট পেলে তারা আনন্দ পায়।

২। ২০১৬ সালের নারায়ণগঞ্জের ঘটনার মতো অনেক সময় শিশুশ্রমিকদের শাস্তি বা শাস্তির নামে এভাবে নির্যাতন করা হয়। কিছু নির্দয় ব্যক্তি এটিকে শাস্তি বা শিক্ষা দেওয়ার নামে ব্যবহার করে।

৩। অনেকেই শিশুদের দুর্বল মনে করে এবং তাদের উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চায়। তারা শিশুদের কষ্ট পেতে দেখে বিকৃত আনন্দ পায় একে বলা হয় SADISTIC TENDENCY.

৪। অনেক অপরাধী জানেই না যে, পায়ুপথে বাতাস প্রবেশ করালে শরীরের অভ্যন্তরে কতটা ক্ষতি হতে পারে যেমন, অস্ত্র ফেটে যাওয়া, রক্তক্ষরণ, দ্রুত অচেতন হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত

এমন অপরাধীরা অনেক সময় মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত বা অপরাধপ্রবণ হয়ে থাকে। তারা সহানুভূতি, সহমর্মিতা, বা নৈতিকতা বোধ হারিয়ে ফেলে। এই ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক ক্ষোভও নিন্দা প্রকাশ করা হয়েছে। অনেকেই শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন।

পায়ুপথ দিয়ে জোর করে বাতাস প্রবেশ করানো শরীরের ভেতরে এমন ভয়ংকর বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে, যা চোখে দেখা বা তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা সম্ভব নয়। শিশুরা দুর্বল, তাদের অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলো অতিরিক্ত সংবেদনশীল। যখন কমপ্রেসড এয়ার বা জোরে প্রবাহিত বাতাস শরীরে প্রবেশ করে, তখন শরীরের ভিতরে ঘটে যায় মারাত্মক ক্ষতি-যা কোনো সময় হয়তো তাৎক্ষণিক মৃত্যু ডেকে আনে, আবার কোনো সময় ধীরে ধীরে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নষ্ট করে দেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে,

১। বাতাসের চাপে অন্ত্র বা কোলন ফেটে গিয়ে পেটের ভেতরে রক্তক্ষরণ, সংক্রমণ (Sepsis) ও মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

২। যখন বাতাস রক্তনালিতে ঢুকে পড়ে, তখন সেটি হৃদপিণ্ড বা মস্তিষ্কে পৌঁছে গিয়ে হঠাৎ মৃত্যু ঘটাতে পারে। এটি তাৎক্ষণিক ও ভয়ংকর ঝুঁকি। যাকে বলা হয় Air Embolism.

৩। Abdominal Distension ঘটে থাকে অর্থাৎ বাতাস জমে পেট অত্যন্ত ফুলে যায়, যা অসহনীয় যন্ত্রণা সৃষ্টি করে এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

৪। চাপের কারণে অভ্যন্তরীণ টিস্যু ছিঁড়ে যায় ও ভেতরে রক্তপাত শুরু হয়, যা দৃষ্টিগোচর না হলেও প্রাণঘাতী হতে পারে।

৫। এতে মলদ্বার ছিঁড়ে যেতে পারে, বা এর কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার দরকার হতে পারে- এমনকি সার্জারিও।

৬। আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে ব্যাকটেরিয়া ঢুকে সিরিয়াস ইনফেকশন বা সেপ্টিসেমিয়া হতে পারে।

৭। শিশু বা বড় যেই হোক, এমন বর্বর কাজ চরম মানসিক ক্ষতি করে ভয়, আতঙ্ক, ট্রমা, ও আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলা হয়। যা একটি Psychological trauma.

উপরে বলা যেকোনো একটি বা একাধিক ক্ষতির কারণে অবিলম্বে বা কিছুক্ষণের মধ্যে মৃত্যু ঘটতে পারে – যা একাধিক ঘটনায় ইতিমধ্যেই ঘটেছে।

একটি শিশু যখন নিষ্পাপ চোখে পৃথিবী দেখতে শেখে, তখন তার সবচেয়ে বেশি দরকার নিরাপত্তা, ভালোবাসা, আর সম্মান। কিন্তু যখন সেই শিশুই হয় “মজার উপকরণ” বা “শাস্তির পাত্র”, তখন তা শুধু একটি ব্যক্তিগত অপরাধ নয় – বরং গোটা সমাজের বিবেকের পরাজয়। পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে নির্যাতন করা কোনো দুষ্টুমি নয়, এটি একটি ভয়াবহ, প্রাণঘাতী এবং আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এই অপরাধ শুধু শারীরিক ক্ষতি করে না, এটি একটি শিশুর জীবনকে একেবারে থামিয়ে দেয়। এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ব্যাপক সচেতনতা তৈরি করতে হবে। আইনকে কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে, এবং অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে-যাতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের নিজেদের ভেতরে মানবিকতা ও সহানুভূতির আলো জ্বালাতে হবে। একটি জীবন, একটি ছোট্ট হাসি, একটি পরিবার-সব কিছু হারিয়ে যায় যদি আমরা চুপ থাকি। এখনই সময় জেগে ওঠার।

পায়ুপথে বাতাস দেওয়া কোনো খেলনা নয়। এটি একটি অপরাধ। এটা হত্যা!” যে করে, তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। এর জন্য জিরো টলারেন্স থাকা উচিত পরিবার, সমাজ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সকল স্তরে।