ভাষা আন্দোলনে নারীর অনন্য অবদান
রফিক, জব্বার, সালাম, বরকতের রক্তের উপর অর্জিত হয়েছিল বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার। ভাষা আন্দোলন শুধুমাত্র ভাষার অধিকার আদায়ের লড়াই ছিল না। এটি ছিল বাঙালির আত্মপরিচয় রক্ষার সংগ্রাম। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানি শাসকদের বাংলা ভাষার ওপর আঘাত আসার পর থেকেই ধাপে ধাপে বাঙালির প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। এই প্রতিরোধের চূড়ান্ত পরিণতি হয় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। তবে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানতে গেলে প্রায়ই নারীদের ভূমিকা আড়ালে পড়ে যায়। যদিও ভাষা আন্দোলনে নারীদের অবদান ছিল অসামান্য।

সেই সময় নারীরা ঘর থেকে বেরিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে নানা সামাজিক বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও তারা থেমে থাকেননি। ঢাকার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে নারীরা ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। তারা মিছিল করেছেন, মিটিংয়ে বক্তব্য দিয়েছেন, পোস্টার লিখেছেন, এমনকি আহত আন্দোলনকারীদের সেবা করতেও পিছপা হননি।
১৯৫২ সালের জানুয়ারিতেই আন্দোলনের উত্তাপ বাড়তে থাকে। ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের ঘোষণা, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’, আন্দোলনকারীদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার করে। ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরিতে আয়োজিত সর্বদলীয় সভায় ইডেন কলেজের ছাত্রী মাহবুবা খাতুন বলেন, ‘প্রয়োজনে মেয়েরা জীবন দিতেও প্রস্তুত।’ এই বক্তব্য নারীদের দৃঢ় অবস্থানের প্রতিফলন ঘটায়।
১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারি ‘পতাকা দিবস’ পালনের সময় প্রায় ৫০০ পোস্টার লেখার দায়িত্ব পালন করেন নাদিরা বেগম ও শাফিয়া খাতুন। তারা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে পোস্টার তৈরি করেন এবং শহরের বিভিন্ন জায়গায় লাগিয়ে দেন।
২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল সফল করতে নারী শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। লায়লা সামাদ, শামসুন নাহার, শাফিয়া খাতুন, সারা তৈফুর, রওশন আরা বাচ্চু, সুফিয়া আহমেদ, রওশন আরা রহমান, হালিমা খাতুন প্রমুখ আন্দোলনকে সুসংগঠিত করতে বড় ভূমিকা রাখেন। তারা বিভিন্ন স্কুল-কলেজে গিয়ে ছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করেন এবং আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করেন।
২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হয় সালাম, রফিক, বরকত, জব্বাররা। তখন নারীরাও সরাসরি রাস্তায় নামেন। দুপুরের দিকে ছাত্রদের একটি দল ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল বের করলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। এরপর নারীদের একটি দলও রাজপথে নামে। এই মিছিলে ছিলেন সুফিয়া আহমেদ, রওশন আরা বাচ্চু, শাফিয়া খাতুন, শামসুন নাহার ও সারা তৈফুর। পুলিশ তাদের ওপরও আক্রমণ চালায়। তবু তারা পিছিয়ে যাননি।
২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী ইউনিয়নের সভায় শাফিয়া খাতুন সভাপতিত্ব করেন এবং ভাষার দাবিতে নারীদের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। ২৩ ফেব্রুয়ারি আজিমপুর কলোনির নারীরা প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন। এই সভায় কমলাপুরসহ বিভিন্ন এলাকার নারীরা অংশ নেন। নারীদের এই ঐক্য ও প্রতিরোধই প্রমাণ করে, ভাষা আন্দোলন শুধু পুরুষদের নয়, নারীদেরও লড়াই ছিল।
দুঃখজনকভাবে ভাষা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক ইতিহাসে নারীদের ভূমিকা এখনও পূর্ণ মর্যাদা পায়নি। আমরা বারবার সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের নাম স্মরণ করি। কিন্তু সেইসব সাহসী নারীদের নাম প্রায়শই উপেক্ষিত থেকে যায়। ইতিহাসের এই শূন্যতা পূরণ করতে হলে আমাদের পাঠ্যবই ও গবেষণায় তাদের অবদান তুলে ধরতে হবে।
বাংলা ভাষার জন্য যারা লড়াই করেছেন, তাদের সবার প্রতি আমাদের চিরঋণী থাকা উচিৎ। সেই সংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায়ের স্বীকৃতি দেওয়া এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে নারীদের আত্মত্যাগের কথা তুলে ধরাই হবে শহীদদের প্রতি আমাদের প্রকৃত শ্রদ্ধাঞ্জলি।